Ajker Patrika

সত্তর সালের যে ছাত্র আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৬ মে ২০২৪, ১৩: ১৬
Thumbnail image

সময়টা ১৯৭৯ সালের ৪ মে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত দিন। সেদিন দেশটির ন্যাশনাল গার্ডের গুলিতে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অন্তত চার শিক্ষার্থী নিহত হন। যাঁরা ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেদিনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের রেখা স্পষ্ট করে তুলেছিল। 

সেই ঘটনার পরপরই তৎকালীন আলোচিত সংগীতশিল্পী ক্রসবি, স্টিলস, ন্যাশ ও ইয়ুং একটি গান প্রকাশ করেন ঘটনাটি স্মরণীয় করে রাখতে। আর সেই গানের সূত্র ধরে চার শিক্ষার্থী অ্যালিসন ক্রাউস, জেফ্রি মিলার, স্যান্ড্রা স্কুয়ার এবং উইলিয়াম শ্রোয়েডার হত্যার ক্ষোভ রূপ নেয় দেশব্যাপী আন্দোলনে। যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুরু হয় বিক্ষোভ। 
 
উত্তাল সেই সময়ের একটি ছবি মার্কিনিদের দৃষ্টি কেড়েছিল। ন্যাশনাল গার্ডের গুলিতে নিহত এক শিক্ষার্থীর মরদেহের ওপর এক তরুণী কাঁদছেন—এমন ছবি মার্কিন জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ছবিই শেষ পর্যন্ত সেই ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

যুক্তরাষ্ট্র কাঁপিয়ে দেওয়া ১৯৭০-এর সেই ছাত্র আন্দোলন ৪ মের পর বেগবান এবং সর্বব্যাপী রূপ নিলেও এর পটভূমি তৈরি হয় সে বছরের এপ্রিলে। সেই মাসে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভিয়েত কংদের মোকাবিলায় কম্বোডিয়া আক্রমণের অনুমতি দেন। মার্কিন সমাজে বিভাজনের সূত্রপাত এখান থেকেই। 
 
নিক্সনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যেসব স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয় তার মধ্যে ওহাইওর কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি অন্যতম। মে মাসের প্রথম দিনে আন্দোলন শুরু হয় এবং ক্রমেই সেই আন্দোলন সংঘর্ষে রূপ নেয়। ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকায় পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং কয়েকটি দোকানেও ভাঙচুর চালানো হয়। 

এই ঘটনার পরদিন কেন্টের মেয়র ওহাইওর গভর্নরের কাছে কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর অনুরোধ জানান। তারপরও টানা দুদিন ধরে চলে এই সংঘর্ষ। এমনকি ক্যাম্পাসে অবস্থিত রিজার্ভ অফিসার ট্রেইনিং কর্প ভবনটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছিল তা কখনোই জানা যায়নি। 

পরে ৪ মে ক্যাম্পাসে আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়। অবশ্যই এরই মধ্যে ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সব ধরনের বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এই বিষয়ে অবগত ছিলেন না এবং অনেকেই সেই নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে মিছিল শুরু করে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে, সেদিন সকালে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। 
 
দুপুর নাগাদ ন্যাশনাল গার্ড শিক্ষার্থীদের মিছিল বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যান। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিক্ষোভকারীরা ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে থাকেন। জবাবে তারা টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে এবং একপর্যায়ে ন্যাশনাল গার্ড মিছিল লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই চার শিক্ষার্থী মারা যান এবং ৯ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে দুজন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। 
 
ন্যাশনাল গার্ডের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার পর মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় মার্কিন সমাজ। একদল শিক্ষার্থীর আন্দোলনের পক্ষে এবং একদল বিপক্ষে। পিট সেলমন নামে এক গ্যারেজমালিক বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের (শিক্ষার্থী) জন্য দুঃখ বোধ করি না। তাদের কারণেই এমনটা হয়েছে। তাদের তো এখানে থাকার কথা ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনাটি (শিক্ষার্থীদের মৃত্যু) দুঃখজনক কিন্তু আপনি তো দিনের পর দিন আন্দোলনের নামে কারও বিরক্তি উদ্রেক করতে পারেন না...তারা এটি দীর্ঘদিন থরে করে আসছিল।’ 

তবে আন্দোলনের পক্ষের লোকদের অবস্থান ভিন্ন। বিবিসি সে সময় কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একাধিক আন্দোলনকারীর সঙ্গে কথা বলেছিল। তাদের একজন সে সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন, ‘হতাশা থেকেই কেবল সহিংসতার সৃষ্টি হয়। সহিংসতা সর্বশেষ আশ্রয়।’ 

দেশজুড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে সেই আন্দোলনকারী বলেন, ‘এটা তো স্পষ্ট যে, দেশজুড়ে কী ঘটেছে এবং এ কারণেই রাজনৈতিক বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। আর আমরা সবাই জানি, এসব আন্দোলনের ক্ষেত্রে স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা করলে কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়।’ 

সে সময় দেখা গেছে, মূলত ‘কর্মজীবী মানুষেরাই’ সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তবে কর্মজীবীদের এই বিরোধিতা কেন—এ বিষয়ে সেই আন্দোলনকারী বলেন, ‘কারণ তাঁরা কমবেশি এক ধরনের প্রচারণার শিকার। যে খবরের কাগজগুলো তিনি পড়েন, তিনি যে তথ্য পেতে অভ্যস্ত তা খুবই একতরফা। তাঁকে একটি নির্দিষ্ট ধরনের তথ্য সরবরাহ করা হয় যেখানে তাঁকে বিচার বিশ্লেষণের জন্য বিপরীত মতের তথ্য পেতে বাধা দেওয়া হয় এবং বিপরীতে মতাদর্শকে কট্টর বা কমিউনিস্ট তকমা দিয়ে সেগুলোকে চাপা দেওয়া হয়।’ 
 
অপর একজনের ভাষ্য আবার আন্দোলনকারীদের পক্ষে। তাঁর মতে, মোটামুটি উচ্চ আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরাই এই ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁরা মূলত চান, একটু দামি পোশাক, একটি ভালো বাড়ি, দুটি গাড়ি এবং বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য একটি মাঠ এবং আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ মানুষের চাওয়াই এটি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।’ ওই ব্যক্তি ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতাকারীদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ‘নীরব সমর্থক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। 

সব মিলিয়ে বলা যায়, ১৯৭০ সালের সেই ছাত্র আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিল। যার একপক্ষে নতুন প্রজন্মের তরুণেরা এবং বিপরীতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় একটি অংশ। এবং এ কারণেই সেই চার শিক্ষার্থীর হত্যার তদন্তে একাধিক কমিটি গঠন করা হলেও তাঁরা কেউই প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করতে পারেননি। 

বিবিসি থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত