Ajker Patrika

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিম তীরে ১০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল

অনলাইন ডেস্ক
বহুদিন পর পশ্চিম তীরে ট্যাংক প্রবেশ করিয়েছে ইসরায়েল। ছবিটি কয়েক দিন আগে তোলা। ছবি: আনাদোলু
বহুদিন পর পশ্চিম তীরে ট্যাংক প্রবেশ করিয়েছে ইসরায়েল। ছবিটি কয়েক দিন আগে তোলা। ছবি: আনাদোলু

ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে দখলকৃত পশ্চিম তীরে সহিংসতা আরও বাড়িয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সেখানে তারা এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ যখন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিল, তখন পশ্চিম তীরে দখলদার সেনাবাহিনী ও অবৈধ ইহুদি বসতির বাসিন্দারা ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়ন আরও বাড়িয়ে দেয়।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে পশ্চিম তীরে সহিংস অভিযান বাড়িয়েছে ইসরায়েল। পাশাপাশি, ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীদের ওপর ইসরায়েলি দখলদার বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ঘটনা আরও বেড়েছে, যা থামানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলিদের হাতে সর্বশেষ নিহত ব্যক্তি হলেন—সামির বাসেম আল-জাগারনে। ১ জুলাই তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। ফিলিস্তিনের সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, আল-জাগারনে পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমকে বিভক্তকারী ‘সেপারেশন ব্যারিয়ারের’ কাছে নিহত হন। ২০০২ সালে ওই ব্যারিয়ার নির্মাণ শুরু করে ইসরায়েল, যা বহু ফিলিস্তিনি জনপদ ও কৃষিজমি বিভক্ত করে দিয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও অবৈধ ইহুদি বসতি গড়ে তোলা সন্ত্রাসী দখলদারেরা পশ্চিম তীরকে গ্রাস করে ফেলছে। এই দখলদারেরা আকস্মিক বিভিন্ন শহরে হামলা চালায়, ঘরবাড়িতে আগুন দেয়, আক্রমণ করে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। একই সঙ্গে ইসরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনী বিভিন্ন শরণার্থীশিবির ঘিরে রেখেছে, নিয়মিত সেখানে অভিযান চালাচ্ছে, বাসিন্দাদের বের করে দিচ্ছে স্থায়ীভাবে।

অনেক দখলদারকে আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে ‘একীভূত’ করা হয়েছে। কারণ, গাজায় যুদ্ধ চালানোর জন্য সেনাবাহিনীর বড় অংশ মোতায়েন থাকায় পশ্চিম তীরে ‘বিকল্প বাহিনী’ হিসেবে এই দখলদারদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে দখলদারদের সহিংসতা আরও বেড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষজ্ঞ, অধিকারকর্মী ও পর্যবেক্ষকদের মতে, এই সহিংসতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে—ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে জমি দখল এবং পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে একীভূত করা। ইসরায়েলি অধিকার সংগঠন ‘পিস নাউ’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের যত জমি দখল করেছে, তা গত ২০ বছরের সম্মিলিত জমি দখলের চেয়েও বেশি।

এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ‘সেটেলমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নামে একটি নতুন দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেন। এই পদ ব্যবহার করে তিনি পশ্চিম তীরের ওপর ইসরায়েলের বেসামরিক আইন চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

স্মতরিচ একের পর এক নতুন অবৈধ বসতি অনুমোদন দিচ্ছেন, জমি দখল করছেন এবং তথাকথিত ‘নির্মাণ-বসতি নীতিমালা’ চালু করছেন। আসলে, ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করতে এবং নতুন অবৈধ বসতি গড়ে তুলতে তিনি সেনাবাহিনী ও দখলদারদের সহিংসতাকে কাজে লাগাচ্ছেন।

ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের নামে গঠিত স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা শিরিন মনিটরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম এক মাসে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত দুই মাসে নিহতের সংখ্যা ৩৪ জন।

এসব হত্যার বড় অংশই নিয়মিত ইসরায়েলি অভিযানের ফলে ঘটেছে। ইসরায়েলের দাবি, তারা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করতে অভিযান চালাচ্ছে। ২০২১ সাল থেকে পশ্চিম তীরে এসব গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, কারণ তখন থেকে ইসরায়েলের দমন-পীড়ন আরও তীব্র হয়।

তবে বাস্তবতা হলো—অঞ্চলটিতে ইসরায়েলি বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ উদাহরণ সৃষ্টি করছে। তারা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে, নিহতদের পরিবারকে দাফনের সুযোগ দিচ্ছে না এবং পুরো পাড়া-মহল্লা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, যাতে আরও বেশি ফিলিস্তিনি ঘরহারা হয়। জেনিন, তুলকারেম, নূর শামস, ফারা’আ এবং নাবলুসের শরণার্থীশিবিরে চলছে এসব অভিযান। এসব স্থানে ইসরায়েল গাজায় যেভাবে পুরোপুরি অবরোধ আরোপ করেছিল, এখানেও তাই করছে। ফলে ব্যাপক মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। ইসরায়েল হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে, তুলকারেম ও জেনিন শিবিরে বোমাবর্ষণ করছে, এতে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু বাড়ছে।

টেক ফর প্যালেস্টাইন নামে মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম তীরে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি দখলদার হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে দখলদারদের হামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১৪। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

এসব হামলার বেশির ভাগ ঘটছে পশ্চিম তীরের ‘এরিয়া সি’ অঞ্চলে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তিতে পশ্চিম তীরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—এরিয়া এ, বি ও সি। এরিয়া এ পুরোটাই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, এরিয়া বি-তে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের, কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের। আর এরিয়া সি—যা পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা—পুরোটাই ইসরায়েলের প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে।

ইসরায়েল থামবে এমন কোনো লক্ষণ নেই। বিপরীতে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হামলা আরও বেড়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েল এরিয়া সি-র মাসাফের ইয়াত্তা অঞ্চলের ১২টি ফিলিস্তিনি কমিউনিটি উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। তারা এলাকাটিকে ‘সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকা’ ঘোষণা দিয়ে এই উচ্ছেদকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। গত কয়েক দশক ধরেই ফিলিস্তিনিদের জমি দখলের জন্য ইসরায়েল এই অজুহাত ব্যবহার করে আসছে।

সর্বশেষ, ২৫ জুন কাফার মালিক গ্রামে ১০০ জনের বেশি ভারী অস্ত্র সজ্জিত ইহুদি দখলদার ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়। তারা ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। ফিলিস্তিনিরা বাধা দিলে তিনজন নিহত হন। পাশের টাইবেহ গ্রামে দখলদাররা একটি গাড়িতে আগুন দেয়। পরে ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বেতসেলেমের সংগ্রহ করা ভিডিওতে গাড়ির পুড়ে যাওয়া অবস্থা দেখা যায়।

আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বহু ফিলিস্তিনি জানিয়েছেন, তারা আরও বড় হামলার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা প্রায়ই বলেন, তাদের কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। আর প্রতিরোধের চেষ্টা করলে দখলদার ও সেনাদের হাতে আরও ভয়াবহ হামলার শিকার হতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টেলিগ্রামে সংগঠিত হচ্ছে আ.লীগ, হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে টাকা নিচ্ছেন ওবায়দুল কাদের

আগামী ১১ দিন নৈরাজ্যের আশঙ্কা, ঠেকাতে এসপিদের এসবির চিঠি

প্রাথমিকে পাঠদান: বাইরের ২০ কাজের চাপে শিক্ষক

প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হলেন মাহফুজ আনাম, নূরুল কবীরসহ ১২ জন

‘চাঁদা না পেয়ে’ ১০ দোকানে তালা, জামায়াত নেতা ও বিএনপির কর্মীসহ গ্রেপ্তার ৪

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত