Ajker Patrika

মার্কিন-ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে প্রস্তুত ইরান, যেভাবে সাজাচ্ছে প্রতিরক্ষা

অনলাইন ডেস্ক
ইরানের এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ছবি: এএফপি
ইরানের এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চললেও, তেহরানের আশঙ্কা যেকোনো সময় ইসরায়েলি বা যুক্তরাষ্ট্রের হামলা হতে পারে। এমনকি এই দুই দেশ যৌথভাবেই ইরানে হামলা করে বসতে পারে। আর এই বিষয়টি মাথায় রেখেই নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাচ্ছে ইরান। গত বছর ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার সরাসরি সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ আছে।

সম্প্রতি ইসরায়েলি হামলার মুখে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তেহরান সামরিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর ও এপ্রিলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের উন্নত ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও রাডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বেশ ক্ষতি হয়। এই হামলার পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে, ইরান গত কয়েক দশকের মধ্যে বিমান হামলার দিক থেকে সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় আছে।

ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের মতো ইরানের মিত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা চালিয়েছে এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেছিলেন, প্রক্সিদের ওপর এই হামলা ইরানের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক পশ্চিমা গোয়েন্দা মূল্যায়ন এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের পর্যালোচনা করা স্যাটেলাইট চিত্র ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। তারা বলছেন, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষার অনেক উপাদান অক্ষত আছে বা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেগুলো মেরামত করা হয়েছে।

ইরান এস-৩০০ সিস্টেমসহ বেশ কয়েকটি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার নাতানজ ও ফোরদোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার কাছে সরিয়ে নিয়েছে। গত মাসে তেহরানে আর্মি ডে উদ্‌যাপনে একটি এস-৩০০ লঞ্চার ও একটি রাডার ট্রাক প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা হয়, যা ইরানের সক্ষমতা প্রদর্শনের একটি প্রয়াস।

গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক মহড়ার সময় একটি এস-৩০০ ইউনিটকে ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি রাডার ব্যবহার করে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করতে দেখা গেছে। মার্কিন থিংক ট্যাংক কার্নেগি এনডাউমেন্টের নিকোল গ্রাজেউস্কি মনে করেন, এটি সম্ভবত এস-৩০০ সিস্টেমের মূল রাডার অকার্যকর হওয়ার কারণে করা হয়েছে।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও প্রস্তুতির ‘উল্লেখযোগ্য উন্নতি’ এবং ‘কয়েকগুণ বিনিয়োগ বৃদ্ধির’ কথা উল্লেখ করে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ইরানের আকাশসীমার যেকোনো লঙ্ঘন আক্রমণকারীদের জন্য ‘উল্লেখযোগ্য ক্ষতি’ বয়ে আনবে। ইরান কেবল রাশিয়ার তৈরি সিস্টেমের ওপর নির্ভর করছে না, বরং দেশটি স্থানীয়ভাবে বাভার-৩৭৩ (দূরপাল্লা) এবং খোরদাদ-১৫ (মাঝারি পাল্লা)—এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তৈরি করছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী ফ্যাবিয়ান হিনজ বলেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে উন্নত এস-৪০০ সিস্টেম সরবরাহে ধীর গতি ও অস্বীকৃতির কারণে এই দেশীয় অস্ত্রের উন্নয়ন শুরু হয়েছে। এটি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর একটি চেষ্টা।

ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। তবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইরানের সঙ্গে পূর্বের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করেছিলেন। এবারও তিনি, চলমান আলোচনা ভেঙে গেলে ইরানের ওপর হামলার হুমকি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ছয়টি বি-২ বোমারু বিমান ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটিতে মোতায়েন করেছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো হামলার সম্ভাব্য সূচনা বিন্দু হতে পারে এই ঘাঁটি।

ইরানের একটি অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ড্রোন। ছবি: এক্স
ইরানের একটি অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ড্রোন। ছবি: এক্স

যদি যুক্তরাষ্ট্র হামলা করেই তাহলে বি-২ বোমারু বিমানগুলো সম্ভবত সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে ভারী ৩০ হাজার পাউন্ডের ‘জিবিইউ-৫৭ বাংকার ব্লাস্টার’ বোমা ফেলবে। ইসরায়েল একা হামলা চালালে তাদের বিকল্প সীমিত হবে। কারণ, দেশটির কাছে ভারী বোমারু বিমান বা এত বড় আকারের অস্ত্র সরবরাহ করার সক্ষমতা নেই। এ ক্ষেত্রে তারা সম্ভবত এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার ব্যবহার করবে। এই বিমানটিতে করে ইসরায়েল ২ হাজার পাউন্ডের বিএলইউ-১০৯ নির্ভুল লক্ষ্যমাত্রার বোমা বহন করতে পারে অথবা এফ-১৫ বোমারু বিমান ৪ হাজার পাউন্ডের জিবিইউ-২৮ বোমা বহন করবে। এ ধরনের বোমার জন্য পারমাণবিক স্থাপনার ‘কঠিন আশ্রয়কেন্দ্র’ ভেদ করতে একই অবস্থানে একাধিকবার আঘাত করতে হবে। এর জন্য অনেক উড্ডয়ন এবং সম্ভবত মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরার জন্য ট্যাংকার ব্যবহার করতে হতে পারে। আর এসব ট্যাংকারই আবার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলার বিপরীতে অরক্ষিত হতে পারে।

ইসরায়েল এবং ইরান উভয়ই সম্ভাব্য এরিয়াল ফাইট বা আকাশ যুদ্ধের জন্য কয়েক দশক ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা মূল্যায়ন অনুসারে, তেহরান মনে করে—গত বছরের আকাশ প্রতিরক্ষা ‘দুর্বল’ ছিল এবং তারা এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য লঞ্চার ও রাডার পুনরায় স্থাপন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে।

আকাশ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ইউরি লিয়ামিন বলেছেন, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখন আরও বেশি মোবাইল (অর্থাৎ, চলাচলে সক্ষম) এবং দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করে আশ্রয়কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকতে পারে, যা তাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে তুলনামূলক সুরক্ষিত করে তোলে।

ইসরায়েল ইরানের ওপর ‘এরিয়াল বা আকাশপথে আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠা করলেও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘ এবং ব্যাপক বিমান যুদ্ধ শুরু করতে পারে। এতে ইসরায়েলি পাইলটদের ‘ক্লান্তি এবং বিপদ’ বাড়তে পারে। এমনকি ইরানের কম উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রও সফল হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৮ সালে সিরিয়া এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়ে ইসরায়েলি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে দেখিয়েছিল। সেই বিমানে থাকা উভয় পাইলটই অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলেন।

লিয়ামিন মনে করেন, একটি সফল হামলার ফলাফল আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেছেন, ‘সেরা দলই জিতবে।’ এই পরিস্থিতি ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যেখানে যেকোনো ভুল পদক্ষেপ বড় ধরনের পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

তথ্যসূত্র: ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত