Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /বিদ্রোহীদের উত্থান ও ইরানের অনিশ্চয়তায় গাজায় অস্তিত্বের লড়াইয়ে হামাস

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৫, ১৬: ১২
২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর গাজায় হামাসের সমর্থনে স্থানীয় বাসিন্দাদের র‍্যালি। ছবি: এএফপি
২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর গাজায় হামাসের সমর্থনে স্থানীয় বাসিন্দাদের র‍্যালি। ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস গাজায় এখন কঠিন চাপের মুখে। টানা ২০ মাস ধরে ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনে সংগঠনটির বড়ধরনের ক্ষতি হয়েছে। কমান্ডার-যোদ্ধাসংকট, টানেল বা সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের বড় অংশ ধ্বংস, বিদ্রোহী গোত্রের উত্থান ও মিত্র ইরানের সহযোগিতা নিয়ে অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত হামাস।

হামাসের ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্র জানিয়েছে, হামাসের যোদ্ধারা এখন নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বাধীনভাবে লড়ছে। তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যত দিন সম্ভব টিকে থাকার। তবে গোষ্ঠীটি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, ইসরায়েল সরাসরি হামাসবিরোধী কিছু গোত্রকে সমর্থন দিচ্ছে।

গাজায় মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ আকার নেওয়ায় যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। হামাসও এখন মরিয়া হয়ে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে, জানিয়েছে হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র। সূত্রটি আরও বলেছে, যুদ্ধবিরতি হলে শুধু সাধারণ গাজাবাসীর জন্য স্বস্তি আসবে না, হামাসও এই সুযোগে কিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, কিছু গোত্র ও ত্রাণ লুটপাটে জড়িত অপরাধীদের দমন করতে পারবে।

হামাসের ঘনিষ্ঠ ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ১৬ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তারা হামাসের বর্তমান অবস্থার যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যায়—গোষ্ঠীটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিছুটা প্রভাব ও সামরিক সক্ষমতা এখনো রয়ে গেছে, তবে পরিস্থিতি খুবই কঠিন।

তবে এখনো হামাস আঘাত হানতে সক্ষম। গত মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজায় হামলায় তারা সাতজন ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের তিন কূটনীতিকের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভেঙে পড়েছে। এখন তারা কেবল ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন হামলা চালাচ্ছে।

অন্যদিকে অব্যাহত মানবিক সংকটে গাজায় সাধারণ মানুষ হামাসের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে যুদ্ধবিরতির জন্য। হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, সংগঠনটি এখন যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া। কারণ, এতে শুধু সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে না, হামাসও এই সুযোগে বিদ্রোহী গ্রুপ, লুটেরা ও কিছু গোত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এই পরিস্থিতিতে হামাসের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে ইয়াসির আবু শাবাব নামের এক বেদুইন নেতা। তিনি দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় অবস্থান করছেন। হামাসের তিনটি সূত্র জানিয়েছে, আবু শাবাবকে হত্যা কিংবা আটক করতে শীর্ষ যোদ্ধাদের পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো ইসরায়েলি সেনাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আড়ালে আছেন।

হামাসের অভিযোগ, আবু শাবাব ইসরায়েলের সহযোগিতায় সংগঠনটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। আবু শাবাবের গোষ্ঠী অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা কোনোভাবেই ইসরায়েলের সহযোগিতা নেয়নি। বরং নিজেদের ‘জনগণের জন্য কাজ করা বাহিনী’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে, যারা ত্রাণের ট্রাক পাহারা দেয় এবং লুটপাট ঠেকায়। তারা হামাসের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর ও ভিন্নমত দমনের অভিযোগ তুলেছে।

হামাসের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘যেকোনো মূল্যে আমরা এই সহযোগিতাকারী ইয়াসির আবু শাবাবের গ্যাংকে নির্মূল করব। তারা গাজায় বিশৃঙ্খলা তৈরি ও আইনশৃঙ্খলা ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে।’

ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তাদের দাবি, তারা এখন পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। গাজার উপকূলীয় এলাকায় কয়েক শ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ ধ্বংস বা অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। গাজার বড় অংশ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে জানা গেছে, হামাস এখন হতদরিদ্র, বাস্তুচ্যুত তরুণদের মধ্য থেকে নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ করছে। ফলে সংগঠনটির যোদ্ধাদের গড় বয়স প্রতিদিনই কমছে।

গাজা সিটির বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সী নির্মাণশ্রমিক এসসাম বলেন, ‘তারা (হামাস) আগের মতো শক্তিশালী নেই। তবে মাঝেমধ্যে তারা দেখা দেয়—রুটির দোকানে লাইন নিয়ন্ত্রণ করে, ত্রাণ পাহারা দেয়, অপরাধীদের শাস্তি দেয়। তারা আছে, তবে আগের মতো আর নয়।’

রয়টার্সের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে হামাসের শীর্ষ নেতা সামি আবু জুহরি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ বন্ধে আলোচনায় রাজি আছি, সব বন্দীকে একসঙ্গে মুক্তি দিতেও প্রস্তুত। তবে আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা চাই হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক, ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করুক।’

গাজার পরিস্থিতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞ গবেষক ইয়াজিদ সাইঘ বলেন, হামাসের এখন বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। সামরিকভাবে টিকে থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও সংগঠনটি বড় সংকটে পড়েছে। বৈরুতের ‘কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের’ এই জ্যেষ্ঠ গবেষক রয়টার্সকে বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ না হলে হামাস শুধু মাঠ থেকে নয়, গাজার সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ থেকেই মুছে যেতে পারে। তারা এখন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চালাচ্ছে।’

গাজার স্থানীয় রাজনীতি ও গোত্রের ভূমিকা নিয়েও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁরা হামাসবিরোধী কিছু ফিলিস্তিনি গোত্রকে অস্ত্র দিচ্ছেন। তবে তিনি কোন কোন গোত্রের কথা বলেছেন, তা খোলাসা করেননি। রাফাহের আবু শাবাবের গ্রুপই এখন হামাসের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। তারা পূর্ব রাফাহ নিয়ন্ত্রণ করে।

ফেসবুকে তাদের পোস্ট করা ছবিতে দেখা গেছে, তারা কারেম শালোম ক্রসিং দিয়ে ত্রাণের ট্রাক প্রবেশে সহায়তা করছে। আবু শাবাবের গোষ্ঠী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা কোনো প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা শুধু বলছে, রাফাহ থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া লোকজন যেন ঘরে ফিরে আসে, তাদের জন্য খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

এদিকে গাজার উত্তরের কিছু গোত্রও হামাসের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি তারা উত্তরের গাজায় ত্রাণের ট্রাক লুটপাট ঠেকিয়েছে। হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনায় হামাস তাদের অনুমতি দিয়েছিল। তবে ইসরায়েল দাবি করেছে, ত্রাণের ট্রাকগুলো হামাসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। হামাস ও সংশ্লিষ্ট গোত্রগুলো অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

হামাসের আরেকটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে ইরানের ভূমিকা নিয়ে। এত দিন ইরানের সহযোগিতায় হামাসের সামরিক শাখা শক্তিশালী হয়েছিল। বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও জটিল হামলার কৌশল শিখিয়েছিল ইরান। কিন্তু সম্প্রতি ইরানে ইসরায়েলের হামলায় রেভল্যুশনারি গার্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সাঈদ ইজাদি নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। ইজাদি সরাসরি হামাসের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন।

হামাস ইরানকে সমবেদনা জানিয়ে ইজাদিকে ‘ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছে। তবে হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ইরানের সহযোগিতা কমার ঝুঁকি রয়েছে। এতে হামাসের অর্থায়ন ও সামরিক দক্ষতা বাড়ানোর সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে হামাসের অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা সামি আবু জুহরি বলেন, ‘ইরান বড় ও শক্তিশালী দেশ, তাকে সহজে হারানো যাবে না। ইরানের সহযোগিতার ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে।’

গাজা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আকরাম আতা-আল্লাহ মনে করেন, ইয়াসির আবু শাবাবের উত্থান মূলত হামাসের দুর্বলতারই প্রতিফলন। তিনি বলেন, আবু শাবাবের মতো কেউই সফল হতে পারবেন না, কারণ, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতাকে ঘৃণা করে। তবে একই সংস্কৃতির ভেতর থেকে এমন শত্রু থাকাটা হামাসের জন্য বড় হুমকি। যত দিন পর্যন্ত তাঁকে সরিয়ে ফেলা না যায়, হুমকি থেকেই যাবে।

গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে থাকা কূটনৈতিক মহল এবং বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, হামাস এখন আর আগের মতো সংগঠিত ও শক্তিশালী নেই। সংগঠনটির সামনে টিকে থাকার জন্য কেবল সামরিক নয়, বড় রাজনৈতিক যুদ্ধও অপেক্ষা করছে। আর সেই যুদ্ধে হামাস কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করছে যুদ্ধ থামার সুযোগ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির মোড় ঘোরানোর ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালদূষণকারী কারখানা পেল পরিবেশবান্ধব পুরস্কার

ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ভারতের সংসদীয় কমিটির দীর্ঘ বৈঠক

ইস্পাহানে বাংকার বাস্টার মারেনি যুক্তরাষ্ট্র, অক্ষত ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম

বাবুই পাখির কান্না কেউ শুনল না, কেটে ফেলা হলো তালগাছটি

গোষ্ঠীস্বার্থে বহু মানুষের স্বপ্ন নষ্ট করেছে এই প্ল্যাটফর্ম: দায়িত্ব ছেড়ে উমামা ফাতেমার পোস্ট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত