Ajker Patrika

মেডিকেল ভর্তি কেলেঙ্কারিতে ভারত তোলপাড়, ৩০-৩২ লাখ টাকায় প্রশ্নপ্রত্র বিক্রি 

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২০ জুন ২০২৪, ২১: ৫৬
Thumbnail image

মেডিকেল কলেজসহ চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারিতে ভারতজুড়ে তোলপাড় চলছে। ৩০-৩২ লাখ টাকায় এই প্রশ্ন বিক্রি হয়েছে বলে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে জানিয়েছে পুলিশ। কেলেঙ্কারিতে আরজেডির নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলে বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবের নাম আসায় তা আগুনে ঘি ঢেলেছে। 

ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি এন্ট্রান্স টেস্ট আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ২০২৪ (NEET-UG 2024) নামে এই পরীক্ষা ১৮ জুন অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠলে এক দিনের মাথায় গতকাল বুধবার এই পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। বহু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পুনরায় পরীক্ষার দাবি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে কয়েক ডজন পিটিশন হয়েছে। সেগুলো সুপ্রিম কোর্টের পর্যালোচনাধীন আছে। তবে এই পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা এনটিএ কর্মকর্তারা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই ঘটনার জের ধরে এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার অন্যতম হোতা অমিত আনন্দকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, নিট-২০২৪–এর প্রশ্নপত্র ৩০-৩২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পরীক্ষার আগের দিন ছয়জন ‘পেপার মাফিয়ার’ কাছে ওই প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়। 

ভারতের গণমাধ্যমগুলো বলছে, বিহারের মুঙ্গের জেলার বাসিন্দা অমিত আনন্দ এজি কলোনি এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে এই প্রশ্নপত্র বিক্রির ‘দোকান’ দিয়ে বসেছিলেন। সেখান থেকেই চলত প্রশ্নপত্র বিক্রির কারবার।

এনডিটিভির খবরে বলা হয়, বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিনহা নিট প্রশ্নপত্র দুর্নীতির ঘটনায় রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আরজেডির নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের তেজস্বী যাদবের নাম টেনে আনায় নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।

বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রীর দাবি, যাদবেন্দু নামের এক অভিযুক্তের জন্য ‘রুম বুক’ করে দেন তেজস্বী যাদবের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি প্রীতম কুমার সিকান্দার। এরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। 

এই সিকান্দারও গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। অনুরাগ যাদব নামে এক নিট পরীক্ষার্থীর চাচা হন এই সিকান্দার। তিনি পেশায় প্রকৌশলী। অনুরাগ পুলিশকে বলেছে, সিকান্দার তাঁকে কোটা থেকে ডেকে পাঠায় এবং প্রীতম কুমারের সাহায্যে একটি গেস্ট হাউসে রাখেন৷ 

এই প্রীতম কুমারই তেজস্বীর সেক্রেটারি বলে বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রীর দাবি। বিহারের বর্তমান উপমুখ্যমন্ত্রীর দাবি, যাদব পরিবারের সঙ্গে সিকান্দারের ঘনিষ্ঠতা আছে। লালু প্রসাদ যাদব যখন রাঁচির জেলে বন্দী ছিলেন, তখন তিনি লালুর দেখাশোনা করতেন।

বিজয় সিনহার দাবি, তেজস্বীকে জনসমক্ষে জানাতে হবে যে এই প্রীতম কুমার এখনো তাঁর সেক্রেটারি কি না এবং এই সিকান্দারের সঙ্গে তাঁদের কী সম্পর্ক। যদিও নিট-কাণ্ডে বিজেপি ও নীতীশের জেডির (ইউ) ওপরই পাল্টা দায় চাপিয়েছে আরজেডি।

এনইইটি পরীক্ষা নিয়ে শোরগোল কেন

মূলত স্নাতক পর্যায়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য দ্য ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এনট্রেন্স টেস্ট (এনইইটি) পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়। এটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকে দেশটির ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) নামের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। যারা ভারতের অন্য আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার দায়িত্বেও থাকে।

লাখ লাখ শিক্ষার্থী মেডিকেল পরীক্ষাটিতে অংশ নেন। কিন্তু মাত্র অল্পসংখ্যকই কলেজে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় নম্বর তুলতে পারে। কিন্তু এই বছর চ্যালেঞ্জ যেন আরও বেশি। কারণ, চলতি বছরের পরীক্ষায় অনেক প্রার্থীই বেশ ভালো নম্বর পেয়েছে। এতে কাট মার্কস বেশি হয়েছে। যার ফলে ভালো নম্বর পাওয়া অনেকেরই ভর্তি প্রায় অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। আর এ কারণে ভারতজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। 

এ বছর ৫ মে ভারতজুড়ে ও বিদেশে এনইইটি পরীক্ষা হয়। ৪ জুন ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় হাজার হাজার পরীক্ষার্থী অস্বাভাবিকভাবে বেশি নম্বর পেয়েছেন। এরপর প্রশ্নপত্রে ভুল থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। এ জন্য পুনরায় পরীক্ষার দাবি ওঠে; আদালতে কয়েক ডজন পিটিশনও দাখিল করা হয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান অভিযোগ স্বীকার করে গত রোববার বলেছেন, কোনো কোনো পরীক্ষাকেন্দ্রের ‘কিছু অনিয়ম’ সামনে এসেছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী বলেন, ‘অনিয়ম পাওয়া গেলে এনটিএ কর্মকর্তাসহ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

এর আগে গত মঙ্গলবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এনটিএর প্রতি নোটিশ জারি করেছে। সেখানে বলা হয়, ‘যদিও কারও পক্ষ থেকে ০.০০১ ভাগও অবহেলা হয়ে থাকে, তবে এটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা উচিত।’

কিন্তু ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থীর জন্য এসব কথা সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই না। কারণ, অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষার জন্য তাঁদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চাকরির সংকট থাকায় ভালো মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির জন্য ভারতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অসম্ভব পরিশ্রম করে।

বিবিসি বলছে, চলতি বছর প্রায় ২৪ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেওয়া এনইইটি পরীক্ষায় মাত্র ১ লাখ ১০ হাজারটি আসনের জন্য প্রতিযোগিতা করেছিল। এটি থেকেই বোঝা যায়, পরীক্ষাটি কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এ ক্ষেত্রে মোট আসনের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার আসন সরকার পরিচালিত কলেজগুলোর জন্য। আর বাকিগুলো বেসরকারি কলেজের অন্তর্ভুক্ত।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সরকারি কলেজে পড়ার জন্যই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেননা, একটি সরকারি কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস কোর্সের জন্য প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ রুপির প্রয়োজন হয়। যেখানে বেসরকারি কলেজগুলো এই খরচ ১০ গুণেরও বেশি।

তবে চলতি বছরের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, সবাইকে অবাক করে ৬৭ জন পরীক্ষার্থী শতভাগ (৭২০ নম্বরের মধ্যে ৭২০ নম্বর) নম্বর পেয়েছে। যদিও ২০১৬ সালে পরীক্ষাটি শুরু হওয়ার পর প্রতিবছর গড়ে এক থেকে তিনজন করে শিক্ষার্থী শতভাগ নম্বর পেয়ে আসছিল। এমনকি কোনো কোনো বছর স্বাভাবিকভাবেই কেউই তা তুলতে পারে না।

শুধু তা–ই নয়; চলতি বছরের পরীক্ষায় ৬৫০-৬৮০ নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতের শীর্ষ মেডিকেল কলেজগুলোতে আসন পাওয়ার প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করেছে।

অস্বাভাবিক এই ফলাফল অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার পরিচালনা ও গ্রেডিংয়ে অনিয়মের অভিযোগ এনে তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু এনটিএ অনিয়মের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। সংস্থাটির দাবি, পরীক্ষার নিয়মের সঙ্গে আপোস করা হয়নি। বরং চলতি বছর বেশি নম্বর পাওয়ার কারণ বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে৷

এদিকে পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার পরপরই বিহার পুলিশ প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। এ ক্ষেত্রে গত ১০ মে চার শিক্ষার্থীসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ১৫ জুন জড়িত সন্দেহে আরও নয়জন পরীক্ষার্থীকে নোটিশ পাঠায়।

পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা মানবজিৎ সিং ধিলোন টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকাকে জানান, ১৩ জন অভিযুক্ত কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার এক দিন আগে একটি ‘সেফ হাউসে’ ৩০ জন পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

মেডিকেল কলেজসহ চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারিতে ভারতজুড়ে তোলপাড় চলছে। ছবি: সংগৃহীতএই কেলেঙ্কারির ঘটনায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ‘স্বপ্নের সঙ্গে বিজেপির জোট সরকার বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে।

মোদি সরকারের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ তুলে অনিয়ম নিয়ে তিনি দলের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের সম্পৃক্ততায় তদন্তেরও দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আগামী ৮ জুলাই পরীক্ষা–সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে শুনানি করতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে পরীক্ষা বাতিলের অনুরোধও রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত