Ajker Patrika

অবস্থাপন্ন নেতারা আয়ের তথ্য গোপন করছেন, দলীয় চাঁদা সংকটে সিপিএম

আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪: ১২
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম)। ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম)। ছবি: সংগৃহীত

দলীয় সদস্যদের মধ্যে আয়ের তথ্য গোপণ করার প্রবণতা বেড়েছে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম)। মাসিক চাঁদার ক্ষেত্রে এমন বিষয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে দলকে। দলের শীর্ষ নেতাদের অভিমত, এই ঝোঁক শহরাঞ্চলের সদস্যদের মধ্যে বেশি দেখছেন তারা। সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলের সদস্যদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক কম। তবে এ নিয়ে খুব কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই দল থেকে।

এ নিয়ে দলটির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘লেভি দেওয়া এবং প্রকৃত আয় পার্টিকে জানানোর ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে কড়াকড়ি করে কিছু হবে না। তার জন্য দরকার পার্টি সম্পর্কে বোধ তৈরি করা। সেটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।’

ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার প্রতিবেদনে বলছে, মূলত সিপিএমের এলাকাভিত্তিক সম্মেলন প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে দলের মধ্যে। জানুয়ারি মাস থেকে সিপিএমের সদস্যদের পদের নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এর মধ্যেই চলবে জেলা সম্মেলনের কাজ। এর মধ্যে দলের বিত্তশালী সদস্যদের একটি অংশ তাদের ‘সঠিক আয়’ নথিভুক্ত করছেন না।

সিপিএমের কর্মীদের মধ্যে একটি প্রচলিত বাক্য রয়েছে, সেটি হলো-‘আমরা টাকা দিয়ে পার্টি করি, টাকা নিয়ে নয়।’ যার অর্থ সিপিএমের সদস্যরা দলকে টাকা দেন। দলের কাছ থেকে টাকা নেন না।

দলের গঠনতন্ত্রেই উল্লেখ রয়েছে, সিপিএমের সদস্য হতে গেলে নির্দিষ্ট আয়ের ভিত্তিতে দলকে নির্দিষ্ট শতাংশ হারে চাঁদা দিতে হবে। যাকে দলীয় পরিভাষায় বলা হয় ‘লেভি’। যেমন যাদের আয় হাজার টাকার কম, তাঁদের মাসে এক টাকা দিতে হয়। আবার এক হাজার এক টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত যাদের আয়, তাঁদের মাসিক লেভির হার আয়ের ০.৫ শতাংশ। বেশি টাকা রোজগার যাদের, তাঁদের লেভির হারও বেশি। যেমন, যাদের মাসিক আয় ২০ হাজার ১ টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা, তাঁদের লেভির হার আয়ের ২ শতাংশ। ৩০ হাজার এক টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা যাদের মাসিক রোজগার, তাঁদের লেভির হার ২.৫ শতাংশ। আবার ৮০ হাজার টাকার বেশি যাদের মাসিক রোজগার, তাঁদের লেভির হার সর্বোচ্চ—৪ শতাংশ।

প্রতিবছর দলীয় সদস্যপদ নবায়নের সময় আয় উল্লেখ করতে হয় দলীয় সদস্যদের। বছরের গোড়াতেই হয় সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই গোড়ার হিসাবেই গলদ থেকে যাচ্ছে বলে জানতে পারছেন দলীয় নেতারা। বিশেষ করে যারা বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বা পেশায় ব্যবসায়ী, সেই সদস্যদের মধ্যে আয় গোপন করার প্রবণতা বেশি। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা রয়েছে, তবে তা অন্যভাবে।

সিপিএম সূত্র জানিয়েছে, যে সব শিক্ষক বা অধ্যাপক দলের সদস্য, তাঁরা বছরের শুরুতে বেতন গোপন করেন না। কিন্তু তাঁরা প্রাইভেটে টিউশন পড়ালে সেই আয় দলকে জানান না। তবে কিছু কিছু জায়গায় তার ব্যতিক্রমও আছে। কোথাও কোথাও এমনও দলীয় সদস্য রয়েছেন, তাঁরা ‘পে স্লিপ’ দেখিয়ে লেভি প্রদান করেন। আবার বছরের মাঝে বেতন বাড়লে সেটাও দলকে অবগত করেন এবং বর্ধিত হারে লেভি গ্রহণের আবেদন জানান। তবে তাঁদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা।

গ্রামাঞ্চলে এই প্রবণতা কম কেন, আলোচনায় তার ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, গ্রামাঞ্চলে যিনি ১০০ দিনের কাজ করেন বা খেতমজুর, তাঁর আয় কম। ফলে তাঁর লেভির হারও কম। তাঁর মাসে ২০ টাকা বা ৩০ টাকা দিতে গায়ে লাগে না। কিন্তু যার বেশি আয়, যাকে মাসে ১৫০০ বা ২০০০ টাকা দিতে হবে। সেই অংশই আয় গোপন করছে।

এ দিকে সব বুঝেও ‘নিরুপায়’ শীর্ষস্থানীয় নেতারা। দলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকের বক্তব্য, কড়াকড়ি করতে গেলে অনেকেরই খাতা থেকে নাম কেটে দিয়ে সদস্যপদ বাতিল করতে হবে। এই ‘দুর্দিনে’ সেটা সবখানে করা যাচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন তারা। তাঁদের বক্তব্য, এমনিতেই ভোট নেই। এখন ‘কঠোর’ হলে সাংগঠনিক কাঠামো টিকিয়ে রাখা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে তাদের। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার জন্যই এ বিষয়ে ‘আপস’।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিপিএমের এক প্রবীণ নেতা অন্য দিকটিও ব্যাখ্যা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন তরুণ হয়তো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো ছোট কাজ করে মাসিক ১০ হাজার টাকা রোজগার করছেন। সংসার চালাতে সেই তিনিই হয়তো সন্ধ্যা থেকে রাত উবের বা র‍্যাপিডো বাইক চালাচ্ছেন। তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গেই দেখতে হবে দলকে। চাপিয়ে দিলে হবে না।’

ধারণা করা হয় সে কারণেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘লেভি দেওয়া এবং প্রকৃত আয় পার্টিকে জানানোর ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে কড়াকড়ি করে কিছু হবে না। তার জন্য দরকার পার্টি সম্পর্কে বোধ তৈরি করা। সেটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।’

তিনি স্বীকার করেছেন যে, এই বিষয়ে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। ২০১৫ সালেই কলকাতা প্লেনামে (সাংগঠনিক সংস্কারের সম্মেলন) এটি চিহ্নিত হয়েছিল।

এ নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেছেন, ‘একটি বড় জেলায় যদি ৫০০ জন প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে লেভি কম দেন, তা হলে জেলা কমিটির ক্ষতি হয় আড়াই লাখ টাকা। যে টাকা হোলটাইমার নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত