Ajker Patrika

ওয়াশিংটন-কিয়েভ বিচ্ছেদে নয়া স্বপ্ন মস্কোর

অনলাইন ডেস্ক
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কিকে ট্রাম্পের তরফ থেকে ভর্ৎসনা করার পর আশায় বুক বেঁধেছে মস্কো। ছবি: দ্য আটলান্টিক
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কিকে ট্রাম্পের তরফ থেকে ভর্ৎসনা করার পর আশায় বুক বেঁধেছে মস্কো। ছবি: দ্য আটলান্টিক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওভাল অফিসে ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তীব্র ভর্ৎসনা করা ছিল একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক ফাঁদ। ট্রাম্প প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে এটি সাজিয়েছিল, যাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে অসম্মানিত করা যায় এবং ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে, তাতে যেন তিনি কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ান। এমনটাই মনে করছেন অনেক অভিজ্ঞ কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক।

এটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, মস্কো হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির এই বাগ্‌বিতণ্ডা দেখে আনন্দিত হয়েছে। মস্কো এখন আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক পুনর্গঠনের আলোচনা অব্যাহত থাকবে, এমনকি আসন্ন সপ্তাহগুলোতে তা আরও গতি পাবে।

এই বিষয়ে জনসমক্ষে এখনো কিছু ঘোষণা করা হয়নি, তবে আড়ালে আলোচনা চলছে যে, ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠক দ্রুতই আয়োজন করা হবে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই বৈঠক নিয়ে আলোচনা চলছিল, কিন্তু এখন তা আরও গতি পেয়েছে।

এ ছাড়া, মস্কোতে নতুন করে আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের দূরত্ব বাড়ায় ইউক্রেন যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য কঠিন আলোচনা এখন পেছনের সারিতে চলে যাবে। একই সঙ্গে, এর বদলে সম্ভাব্য লাভজনক যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া অর্থনৈতিক চুক্তির বিষয়টি এগিয়ে যাবে। এই বিষয়টি নিয়েও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ গত মাসে এই ব্যতিক্রমী আলোচনার প্রথম দফার নেতৃত্ব দেন, যেখানে ইউক্রেনকে উপেক্ষা করা হয়। সিএনএন জানতে পেরেছে যে, দ্বিতীয় দফার প্রস্তুতি এরই মধ্যে শুরু হয়েছে, যা শিগগিরই আয়োজিত হতে পারে। সম্ভবত, এই বৈঠক কোনো একটি উপসাগরীয় দেশেই অনুষ্ঠিত হবে।

এরই মধ্যে ক্রেমলিনের আলোচনায় প্রধান অর্থনৈতিক দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভ সিএনএনকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতায় ‘জ্বালানি’ চুক্তির মতো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে, যদিও এ বিষয়ে এখনো কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

এদিকে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন পুনরায় চালুর জন্য মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। এই পাইপলাইনটি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং জার্মানি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের শুরুতেই এই পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়।

কিরিল দিমিত্রিয়েভ ট্রাম্প প্রশাসন ও রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা ‘মানবতার জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে’ একযোগে কাজ করে এবং বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অগ্রগতি ও ‘মঙ্গল গ্রহ অভিযানসহ’ দীর্ঘমেয়াদি বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে মনোনিবেশ করে।

এমনকি দিমিত্রিয়েভ ইলন মাস্কের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘এক্সে’ একটি সুসংহত কম্পিউটার গ্রাফিক পোস্ট করেছেন। যেখানে একটি কল্পিত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-সৌদি আরবের যৌথ মঙ্গল মিশন দেখানো হয়েছে এবং এই মিশন স্পেসএক্সের রকেটে পরিচালিত হবে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে।

ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিগুলো একদিকে রাখলে, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপুল মুনাফা অর্জনের সুযোগ স্পষ্ট। উল্লেখ্য, রাশিয়া বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিরল খনিজ সম্পদের মজুতের মালিক। ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার এই মজুতের পরিমাণ অনেক বেশি।

এই বিষয়টি বাণিজ্যকেন্দ্রিক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। ট্রাম্পের লাগাতার লাভজনক চুক্তি অনুসন্ধানের মানসিকতা এখন রাশিয়া কাজে লাগাচ্ছে। দিমিত্রিয়েভ এক্সে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ট্রাম্পের বাণিজ্যিক দক্ষতা বাইডেনের অবস্থানকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়াকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’

জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেকের পর থেকে যা দেখা যাচ্ছে, তা কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়েও বেশি কিছু; এটি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের এক মৌলিক পুনর্গঠন। ক্রেমলিনকে আলিঙ্গন করে ট্রাম্প প্রশাসন পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে, যার ফলে ইউরোপ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে এবং ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক অবস্থানে এক বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে।

এমনকি ক্রেমলিনও ঘটনাপ্রবাহের দ্রুত গতিতে কিছুটা বিস্মিত হয়েছে এবং এটি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ রুশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘নতুন (মার্কিন) প্রশাসন খুব দ্রুত সমস্ত বৈদেশিক নীতি পুনর্গঠন করছে। এটি অনেকাংশে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।’

কিন্তু কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের ছেড়ে ক্রেমলিনের দিকেই ঝুঁকছেন, তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা চলছে। বেশির ভাগ ব্যাখ্যার কোনো প্রমাণ নেই। যেমন, ট্রাম্প কোনোভাবে ক্রেমলিনের এজেন্ট বা পুতিনের কাছে ঋণী, এগুলোর কোনো প্রমাণ নেই।

হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী আদর্শিক গোষ্ঠীগুলোর কল্পনা যে, রাশিয়া ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক মিত্র হতে পারে এবং দেশটিকে তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব—এই চিন্তাভাবনাই ওয়াশিংটনের নাটকীয় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে কাজ করছে।

কিন্তু হতবাক বহু পর্যবেক্ষকের মতে, ট্রাম্পের ক্রেমলিনের প্রতি আকস্মিক ঝোঁকের ব্যাখ্যা—চাই তা আদর্শিক হোক বা রাজনৈতিক—দুটোই সমানভাবে বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছে। সাধারণত টানাপোড়েনপূর্ণ, এমনকি বৈরী, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক এখন এক নতুন এবং কট্টর পর্যায়ে প্রবেশ করছে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত