Ajker Patrika

নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না দিয়েই ইউক্রেনের খনিজ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চুক্তি শিগগির

অনলাইন ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

ইউক্রেন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির খনিজ সম্পদ বিষয়ে একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। তবে বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি দেবে না। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ তথ্য জানিয়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার হোয়াইট হাউসে যাবেন বিরল খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরে, তবে এই চুক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে কোনো উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে না।

ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সামরিক সহায়তার জন্য ব্যয় করা শত শত বিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করতে পারবে। কয়েক দিনের তীব্র আলোচনার পর চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়। আলোচনার সময় জেলেনস্কি চেয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়।

তবে চুক্তির সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। চুক্তির খসড়ায় একটি যৌথ তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে ইউক্রেনে পাওয়া বিরল খনিজ ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ পদার্থের খনন থেকে অর্জিত রাজস্ব রাখা হবে, পাশাপাশি তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে অর্জিত রাজস্বও এতে থাকবে।

ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন পাসে মলিকর্পের বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে সেরিয়াম অক্সাইড, বাস্টনাসাইট, নিওডিমিয়াম অক্সাইড ও ল্যান্থানাম কার্বোনেটের নমুনা প্রদর্শন করা হয়। এর আগে, ট্রাম্প দাবি করেন, ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরল খনিজ পদার্থ সরবরাহ করতে হবে। মূলত, তাঁর দাবির কাছে নতি স্বীকার করেই ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে।

গত বুধবার মার্কিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন যে, জেলেনস্কি শুক্রবার ওয়াশিংটনে আসবেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে। এই বিষয়টিকে তিনি ‘খুব বড় একটি চুক্তি’ বলে আখ্যা দেন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে চুক্তির খসড়া স্বাক্ষর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। খসড়া অনুযায়ী, এই যৌথ তহবিলের মালিকানার শতভাগই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকার কথা ছিল। তবে জেলেনস্কি এতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘আমি এমন কোনো কিছুতে স্বাক্ষর করব না, যার মূল্য ১০ প্রজন্ম ধরে ইউক্রেনীয়রা পরিশোধ করবে।’

এরপর থেকে আলোচনায় কয়েক দফা পরিবর্তন আনা হয়। ইউক্রেন দীর্ঘ মেয়াদে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের আরও স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি চাইছিল। এই বিষয়ে ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয়, চুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে কী ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবেন তিনি? জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি খুব বেশি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে যাচ্ছি না। আমরা চাই ইউরোপ এ বিষয়ে দায়িত্ব নিক।’

ট্রাম্প ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, ‘ন্যাটো নিয়ে ভাবার দরকার নেই। সম্ভবত এই কারণেই পুরো ঘটনাটি শুরু হয়েছে।’ গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চুক্তির খসড়ায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সম্পর্কে অস্পষ্ট ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

জেলেনস্কি চুক্তিটিকে ‘প্রাথমিক’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, ‘এটি কেবল শুরু, এটি কেবল একটি কাঠামো। এটি বড় সাফল্যে পরিণত হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, যদি তিনি শুক্রবার হোয়াইট হাউসে যান, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করবেন, তারা ইউক্রেনকে সমর্থন করবে কি না। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না পাই, তাহলে অস্ত্রবিরতি সম্ভব নয়, কিছুই কাজ করবে না, কিছুই না।’

জেলেনস্কির এই মন্তব্যের আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, ইউক্রেনে ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনাকে মস্কো প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি ট্রাম্পের আগের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা বাহিনীর উপস্থিতিকে সমর্থন করেন না।

লাভরভ বলেন, ‘ট্রাম্প বলেছেন, শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত শুধু তখনই সম্ভব, যদি উভয় পক্ষ—আমরা এবং ইউক্রেন—তাতে সম্মত হয়। কিন্তু কেউ আমাদের এমন কিছু নিয়ে জিজ্ঞাসাও করেনি।’

এদিকে, আগামী রোববার লন্ডনে ইউরোপীয় নেতারা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বৈঠক করবেন, যেখানে ইউক্রেনে ইউরোপীয় সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সমর্থিত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অস্ত্রবিরতির পর ইউক্রেনে ৩০ হাজারের কম ইউরোপীয় সেনা মোতায়েন করা হতে পারে। এসব সেনা রণক্ষেত্রে থাকবে না। তারা মূল অবকাঠামো, যেমন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে এবং পশ্চিমা বিমান ও নৌবাহিনী তাদের সহায়তা করবে।

লাভরভ বলেন, লন্ডন ও প্যারিস থেকে আসা শান্তিরক্ষা প্রস্তাব আসলে ‘প্রতারণা’ এবং এটি ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র দিয়ে পূর্ণ করার কৌশল। তিনি দাবি করেন, এটি ইউক্রেনকে আরও বেশি ন্যাটোর দিকে ঠেলে দেবে এবং রুশভাষীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে।

অপরদিকে আজ বৃহস্পতিবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করবেন। এটি হবে দুই পক্ষের মধ্যে টানা দ্বিতীয় সপ্তাহের বৈঠক। এর আগে, গত সপ্তাহে সৌদি আরবের রিয়াদে দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এই আলোচনা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গত সপ্তাহে রিয়াদে বলেছিলেন, দুই দেশ ওয়াশিংটন ও মস্কোয় তাদের কূটনৈতিক মিশন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কাজ করবে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য আলোচনার অংশ। এরপর গত মঙ্গলবার সাংবাদিকেরা মস্কোর শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত, আমি নিশ্চিত, আমরা কিছু একটা করতে পারব।’

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘কিছু একটা হবে, যা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হবে...এটি এমন কিছু, যা আমি আলোচনা করেছি। এমন এক ধরনের শান্তিরক্ষা ব্যবস্থা, যা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য।’

মস্কোর ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রতি আপত্তি প্রমাণ করে যে, রাশিয়া এখনো যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার ট্রাম্পের পরিকল্পনায় পুরোপুরি রাজি হয়নি। এটি মস্কোকে ছাড় দিতে রাজি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। দুটি সূত্র জানিয়েছে, পুতিন এখনো তাঁর শর্তে অটল। তাঁর শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার সীমিত করা, বিদেশি অস্ত্র নিষিদ্ধ করা, ইউক্রেনের স্থায়ী নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখা।

লাভরভ পুনরায় জানিয়েছেন, রাশিয়া এখনো ইউক্রেনের চারটি সংযুক্ত অঞ্চল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। তাঁর ইঙ্গিত, রাশিয়া ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও হস্তক্ষেপ করতে চায়। তিনি ইঙ্গিত দেন, ইউক্রেনের অবশিষ্ট অংশ রাশিয়া ও রুশভাষীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের যা অবশিষ্ট থাকবে, সেই অঞ্চলটিকেও বর্ণবাদী আইন থেকে মুক্ত হতে হবে।’

ক্রেমলিন দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে, ইউক্রেন সরকার রুশভাষী নাগরিকদের দমন করছে। এই অভিযোগেই রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। তবে ইউক্রেন বারবার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত