অনলাইন ডেস্ক
আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল কমিউনিস্ট বাহিনীর হাতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগনের পতনের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হয়েছিল। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ আজও সেই যুদ্ধের রাসায়নিক উত্তরাধিকার, এজেন্ট অরেঞ্জের ভয়াবহ পরিণতির সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করছেন।
৩৪ বছর বয়সী নগুয়েন থান হাই তাঁদেরই একজন, যাঁর শারীরিক অক্ষমতার পেছনে এজেন্ট অরেঞ্জকে দায়ী করা হয়। গুরুতর মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মানো হাইয়ের জন্য দৈনন্দিন অনেক সাধারণ কাজই দুঃসাধ্য—দা নাং শহরের একটি বিশেষ স্কুলে যাওয়ার জন্য তাঁর নীল জামার বোতাম লাগানো, বর্ণমালা শেখা, আঁকা বা সহজ বাক্য গঠন করাও তাঁর জন্য কষ্টসাধ্য।
হাইয়ের বেড়ে ওঠা দা নাংয়ে—যেখানে মার্কিন বাহিনীর একটি বিমানঘাঁটি ছিল। ওই ঘাঁটি থেকেই যুদ্ধ শেষে মার্কিন সেনারা প্রচুর এজেন্ট অরেঞ্জ ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেই রাসায়নিক মাটি ও পানিতে মিশে আশপাশের গ্রাম ও জনপদের বাসিন্দাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আক্রান্ত করে চলেছে।
ভিয়েতনামজুড়ে মার্কিন বাহিনী ৭ কোটি ২০ লাখ লিটার (১ কোটি ৯০ লাখ গ্যালন) ডিফোলিয়েন্ট (গাছপালা ধ্বংসকারী রাসায়নিক) ছিটিয়েছিল, যার মধ্যে অর্ধেক ছিল এজেন্ট অরেঞ্জ। এতে ছিল ডায়অক্সিন নামের একটি মারাত্মক বিষাক্ত উপাদান, যা ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি এবং পরিবেশগত দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির জন্য দায়ী। আজও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এই রাসায়নিকের প্রভাবে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
ভিয়েতনাম সরকার যুদ্ধ-উত্তর এই বিষাক্ত রাসায়নিক দূর করতে কয়েক দশক ধরে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র দেরিতে হলেও কিছু সাহায্য দিয়েছে। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। এমন প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনামে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশি সাহায্য কাটছাঁটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই কার্যক্রম থেকে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিতে পারে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের দিকে ফিরে তাকাতে চায়নি। ইতিহাসের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় ভুলে যেতে চেয়েছিল দেশটি। কিন্তু তারা ভিয়েতনামে রেখে গিয়েছিল ডাইঅক্সিনে দূষিত অসংখ্য ‘হটস্পট’; যার বিস্তার দেশটির ৬৩টি প্রদেশের মধ্যে ৫৮টিতে।
ভিয়েতনামের দাবি, এজেন্ট অরেঞ্জের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রজন্মের পর প্রজন্মে রয়ে যায়। যারা একবার আক্রান্ত হন, তাঁদের সন্তানেরা এমনকি নাতি-নাতনিরাও মেরুদণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও অন্যান্য জন্মগত জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
তবে মানবস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞান এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। কারণ, ২০০৬ সালে যখন ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ শুরু করল, তখন তারা মানবদেহ নয়, বরং পরিবেশ থেকে ডাইঅক্সিন দূর করতে গুরুত্ব দিয়েছিল। এজেন্ট অরেঞ্জ বিষয়ে বই (From Enemies to Partners) লিখেছেন চার্লস বেইলি। তিনি বলেন, ‘এজেন্ট অরেঞ্জের কারণে ঠিক কোন কোন রোগ হচ্ছে, তা নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা একমত নন।’
ভিয়েতনামে এই বিষে আক্রান্তদের শনাক্ত করা হয় পারিবারিক ইতিহাস, বসবাসের স্থান এবং কিছু নির্দিষ্ট রোগের তালিকা দেখে। বেইলি বলেন, ‘হাইয়ের সমস্যার সঙ্গে এজেন্ট অরেঞ্জ স্প্রের যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
৩৪ বছর বয়সী হাই স্বপ্ন দেখেন তাঁর দাদার মতো একজন সৈনিক হবেন। কিন্তু বছরের পর বছর তিনি ঘরে বন্দী ছিলেন। তাঁর পরিবার কাজ করতে চলে গেলে, তিনি একা বসে থাকতেন। মাত্র পাঁচ বছর হলো তিনি একটি বিশেষ স্কুলে যেতে শুরু করেছেন। হাই বলেন, ‘আমি এখানে খুশি; কারণ, এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে।’ অন্য শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ দরজি কিংবা ধূপকাঠি প্রস্তুতকারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
এজেন্ট অরেঞ্জ শুধু মানুষের শরীর নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশকেও ধ্বংস করেছে। দেশের প্রায় অর্ধেক ম্যানগ্রোভ বনভূমি, যেগুলো উপকূলকে ঝড় থেকে রক্ষা করে, তা ধ্বংস হয়েছে। বহু বন ধ্বংস হয়েছে, মাটি থেকে হারিয়ে গেছে পুষ্টি—বিশেষত যেসব অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ঘিরে দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দিতে শুরু করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনেক বছর এই স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রমাণকে অগ্রাহ্য করে—এমনকি তাদের নিজের ভেটারানদের ক্ষেত্রেও। ১৯৯১ সালে তারা প্রথম স্বীকার করে, কিছু রোগ এজেন্ট অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। এরপর থেকে ওই সব রোগে আক্রান্ত মার্কিন সেনাদের ভেটারান সুবিধা দেওয়া শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে তারা ভিয়েতনামে এজেন্ট অরেঞ্জ বা অবিস্ফোরিত বোমা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বসবাসকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে।
এ ছাড়া যুদ্ধকালীন নিহতদের খোঁজেও দুই দেশ যৌথভাবে কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের নিখোঁজ সেনাদের খোঁজার জন্যও সহায়তা দিয়েছে।
এজেন্ট অরেঞ্জ পরিষ্কার করা ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক। অতিমাত্রায় দূষিত মাটি বড় বড় চুলায় অত্যধিক উত্তপ্ত করতে হয়। এরপর সেগুলো অপেক্ষাকৃত কম দূষিত মাটি মাটির নিচে চাপা দেওয়া হয়।
তবে এত বছরের কাজের পরও অনেক জায়গা এখনো পরিষ্কার করা যায়নি। দা নাং বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র ১১ কোটি ডলারের একটি পরিচ্ছন্নতা প্রকল্প ২০১৮ সালে শেষ করেছে। কিন্তু এখনো ১০টি ফুটবল মাঠের সমান একটি এলাকা মারাত্মকভাবে দূষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
এই যুদ্ধ-উত্তর সহযোগিতাই পরে যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম সম্পর্কে ভিত্তি স্থাপন করে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক মর্যাদা ‘কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন ওই বছর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে।’
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশি সহায়তা হ্রাস ভিয়েতনামের অনেক প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছে। যদিও অনেক প্রকল্প আবার শুরু হয়েছে, তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ভিয়েতনাম এখন একটি কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করছে; কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন, তাঁরা আর অন্য দেশকে সাহায্য করার সামর্থ্য রাখেন না।
দা নাংয়ের এজেন্ট অরেঞ্জ ভুক্তভোগী সমিতির চেয়ারম্যান নগুয়েন ভ্যান আন বলেন, ‘এই বিষাক্ত রাসায়নিক যারা তৈরি করেছে, সেই কোম্পানি ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ বিষয়ে দায়িত্ব নেওয়া উচিত বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তিনি আরও বলেন, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে যেসব প্রকল্প বন্ধ হতে পারে, তা যেন অস্থায়ী হয়—এই আশাই তিনি করছেন।
যেহেতু পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তাই বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না—মানবদেহের জন্য এই বিষ কত দিন পর্যন্ত ক্ষতিকর থাকবে। তবে যত দিন পরিষ্কারকরণ অভিযান চলবে না, তত দিন দূষিত মাটি পানিতে মিশে আরও মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বিয়েন হোয়া বিমানঘাঁটির ৫ লাখ ঘনমিটার (৬ লাখ ৫০ হাজার ঘন গজ) ডাইঅক্সিন দূষিত মাটি পরিষ্কার করার ১০ বছরের প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। এটি মার্চে এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল, পরে আবার শুরু হয়। কিন্তু বেইলি বলেন, এই প্রকল্পের জন্য ইউএসএআইডির ভবিষ্যৎ অর্থায়ন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ৩ কোটি ডলারের প্রকল্প—উভয়ই অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, মার্কিন বাজেট কাটছাঁটের কারণে ইউএসএআইডির অধিকাংশ কর্মী এ বছর শেষে ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যাবেন। ফলে প্রকল্পের জন্য যদি অর্থ বরাদ্দ থাকেও, পরিচালনা করার মতো লোক থাকবে না।
বেইলির আশঙ্কা, ‘এর ফলে বিশাল পরিমাণ দূষিত মাটি পড়ে থাকবে। যার মাত্র ৩০ শতাংশ পরিষ্কার হয়েছে—সেটিও অপেক্ষাকৃত কম দূষিত ছিল।’
তিনি আরও জানান, বিয়েন হোয়ার অর্ধেকের কম মাটি এখনো পরিশোধন করা হয়েছে, বাকি অংশ মারাত্মকভাবে দূষিত এবং তা পরিষ্কার করার জন্য এখনো ইনসিনারেটর (বর্জ্য পোড়ানোর চুল্লি) তৈরি হয়নি।
সাবেক মার্কিন সিনেটর প্যাট্রিক লিহির পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন টিম রিজার। তিনি এখন সিনেটর পিটার ওয়েলচের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম এই যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন উত্তরাধিকার এজেন্ট অরেঞ্জ দূর করতে একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু এখন ট্রাম্প প্রশাসন অন্ধভাবে সবকিছু বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশীদারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, বিয়েন হোয়া ও কেন্দ্রীয় ভিয়েতনামে মাইন অপসারণসহ যুদ্ধ-উত্তর প্রকল্পগুলো এখনো ‘সক্রিয় ও চলমান’ রয়েছে। ভবিষ্যতে এগুলো চালু রাখতে কতটুকু সম্পদ লাগবে, তা নির্ধারণে মূল্যায়ন চলছে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক সাবেক মার্কিন সৈনিক চাক সিয়ারসি ১৯৯৫ সাল থেকে দেশটিতে মানবিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ বছরের আস্থা খুব সহজে ভেঙে পড়তে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘যাঁরা এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী, তাঁরা নিরপরাধ ভুক্তভোগী। একবার যুদ্ধের দ্বারা, আর এখন প্রকল্প বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে আবার।’
তথ্যসূত্র: এপি
আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল কমিউনিস্ট বাহিনীর হাতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগনের পতনের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হয়েছিল। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ আজও সেই যুদ্ধের রাসায়নিক উত্তরাধিকার, এজেন্ট অরেঞ্জের ভয়াবহ পরিণতির সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করছেন।
৩৪ বছর বয়সী নগুয়েন থান হাই তাঁদেরই একজন, যাঁর শারীরিক অক্ষমতার পেছনে এজেন্ট অরেঞ্জকে দায়ী করা হয়। গুরুতর মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মানো হাইয়ের জন্য দৈনন্দিন অনেক সাধারণ কাজই দুঃসাধ্য—দা নাং শহরের একটি বিশেষ স্কুলে যাওয়ার জন্য তাঁর নীল জামার বোতাম লাগানো, বর্ণমালা শেখা, আঁকা বা সহজ বাক্য গঠন করাও তাঁর জন্য কষ্টসাধ্য।
হাইয়ের বেড়ে ওঠা দা নাংয়ে—যেখানে মার্কিন বাহিনীর একটি বিমানঘাঁটি ছিল। ওই ঘাঁটি থেকেই যুদ্ধ শেষে মার্কিন সেনারা প্রচুর এজেন্ট অরেঞ্জ ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেই রাসায়নিক মাটি ও পানিতে মিশে আশপাশের গ্রাম ও জনপদের বাসিন্দাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আক্রান্ত করে চলেছে।
ভিয়েতনামজুড়ে মার্কিন বাহিনী ৭ কোটি ২০ লাখ লিটার (১ কোটি ৯০ লাখ গ্যালন) ডিফোলিয়েন্ট (গাছপালা ধ্বংসকারী রাসায়নিক) ছিটিয়েছিল, যার মধ্যে অর্ধেক ছিল এজেন্ট অরেঞ্জ। এতে ছিল ডায়অক্সিন নামের একটি মারাত্মক বিষাক্ত উপাদান, যা ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি এবং পরিবেশগত দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির জন্য দায়ী। আজও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এই রাসায়নিকের প্রভাবে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
ভিয়েতনাম সরকার যুদ্ধ-উত্তর এই বিষাক্ত রাসায়নিক দূর করতে কয়েক দশক ধরে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র দেরিতে হলেও কিছু সাহায্য দিয়েছে। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। এমন প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনামে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশি সাহায্য কাটছাঁটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই কার্যক্রম থেকে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিতে পারে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের দিকে ফিরে তাকাতে চায়নি। ইতিহাসের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় ভুলে যেতে চেয়েছিল দেশটি। কিন্তু তারা ভিয়েতনামে রেখে গিয়েছিল ডাইঅক্সিনে দূষিত অসংখ্য ‘হটস্পট’; যার বিস্তার দেশটির ৬৩টি প্রদেশের মধ্যে ৫৮টিতে।
ভিয়েতনামের দাবি, এজেন্ট অরেঞ্জের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রজন্মের পর প্রজন্মে রয়ে যায়। যারা একবার আক্রান্ত হন, তাঁদের সন্তানেরা এমনকি নাতি-নাতনিরাও মেরুদণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও অন্যান্য জন্মগত জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
তবে মানবস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞান এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। কারণ, ২০০৬ সালে যখন ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ শুরু করল, তখন তারা মানবদেহ নয়, বরং পরিবেশ থেকে ডাইঅক্সিন দূর করতে গুরুত্ব দিয়েছিল। এজেন্ট অরেঞ্জ বিষয়ে বই (From Enemies to Partners) লিখেছেন চার্লস বেইলি। তিনি বলেন, ‘এজেন্ট অরেঞ্জের কারণে ঠিক কোন কোন রোগ হচ্ছে, তা নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা একমত নন।’
ভিয়েতনামে এই বিষে আক্রান্তদের শনাক্ত করা হয় পারিবারিক ইতিহাস, বসবাসের স্থান এবং কিছু নির্দিষ্ট রোগের তালিকা দেখে। বেইলি বলেন, ‘হাইয়ের সমস্যার সঙ্গে এজেন্ট অরেঞ্জ স্প্রের যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
৩৪ বছর বয়সী হাই স্বপ্ন দেখেন তাঁর দাদার মতো একজন সৈনিক হবেন। কিন্তু বছরের পর বছর তিনি ঘরে বন্দী ছিলেন। তাঁর পরিবার কাজ করতে চলে গেলে, তিনি একা বসে থাকতেন। মাত্র পাঁচ বছর হলো তিনি একটি বিশেষ স্কুলে যেতে শুরু করেছেন। হাই বলেন, ‘আমি এখানে খুশি; কারণ, এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে।’ অন্য শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ দরজি কিংবা ধূপকাঠি প্রস্তুতকারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
এজেন্ট অরেঞ্জ শুধু মানুষের শরীর নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশকেও ধ্বংস করেছে। দেশের প্রায় অর্ধেক ম্যানগ্রোভ বনভূমি, যেগুলো উপকূলকে ঝড় থেকে রক্ষা করে, তা ধ্বংস হয়েছে। বহু বন ধ্বংস হয়েছে, মাটি থেকে হারিয়ে গেছে পুষ্টি—বিশেষত যেসব অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ঘিরে দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দিতে শুরু করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনেক বছর এই স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রমাণকে অগ্রাহ্য করে—এমনকি তাদের নিজের ভেটারানদের ক্ষেত্রেও। ১৯৯১ সালে তারা প্রথম স্বীকার করে, কিছু রোগ এজেন্ট অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। এরপর থেকে ওই সব রোগে আক্রান্ত মার্কিন সেনাদের ভেটারান সুবিধা দেওয়া শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে তারা ভিয়েতনামে এজেন্ট অরেঞ্জ বা অবিস্ফোরিত বোমা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বসবাসকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে।
এ ছাড়া যুদ্ধকালীন নিহতদের খোঁজেও দুই দেশ যৌথভাবে কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের নিখোঁজ সেনাদের খোঁজার জন্যও সহায়তা দিয়েছে।
এজেন্ট অরেঞ্জ পরিষ্কার করা ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক। অতিমাত্রায় দূষিত মাটি বড় বড় চুলায় অত্যধিক উত্তপ্ত করতে হয়। এরপর সেগুলো অপেক্ষাকৃত কম দূষিত মাটি মাটির নিচে চাপা দেওয়া হয়।
তবে এত বছরের কাজের পরও অনেক জায়গা এখনো পরিষ্কার করা যায়নি। দা নাং বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র ১১ কোটি ডলারের একটি পরিচ্ছন্নতা প্রকল্প ২০১৮ সালে শেষ করেছে। কিন্তু এখনো ১০টি ফুটবল মাঠের সমান একটি এলাকা মারাত্মকভাবে দূষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
এই যুদ্ধ-উত্তর সহযোগিতাই পরে যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম সম্পর্কে ভিত্তি স্থাপন করে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক মর্যাদা ‘কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন ওই বছর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে।’
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশি সহায়তা হ্রাস ভিয়েতনামের অনেক প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছে। যদিও অনেক প্রকল্প আবার শুরু হয়েছে, তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ভিয়েতনাম এখন একটি কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করছে; কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন, তাঁরা আর অন্য দেশকে সাহায্য করার সামর্থ্য রাখেন না।
দা নাংয়ের এজেন্ট অরেঞ্জ ভুক্তভোগী সমিতির চেয়ারম্যান নগুয়েন ভ্যান আন বলেন, ‘এই বিষাক্ত রাসায়নিক যারা তৈরি করেছে, সেই কোম্পানি ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ বিষয়ে দায়িত্ব নেওয়া উচিত বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তিনি আরও বলেন, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে যেসব প্রকল্প বন্ধ হতে পারে, তা যেন অস্থায়ী হয়—এই আশাই তিনি করছেন।
যেহেতু পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তাই বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না—মানবদেহের জন্য এই বিষ কত দিন পর্যন্ত ক্ষতিকর থাকবে। তবে যত দিন পরিষ্কারকরণ অভিযান চলবে না, তত দিন দূষিত মাটি পানিতে মিশে আরও মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বিয়েন হোয়া বিমানঘাঁটির ৫ লাখ ঘনমিটার (৬ লাখ ৫০ হাজার ঘন গজ) ডাইঅক্সিন দূষিত মাটি পরিষ্কার করার ১০ বছরের প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। এটি মার্চে এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল, পরে আবার শুরু হয়। কিন্তু বেইলি বলেন, এই প্রকল্পের জন্য ইউএসএআইডির ভবিষ্যৎ অর্থায়ন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ৩ কোটি ডলারের প্রকল্প—উভয়ই অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, মার্কিন বাজেট কাটছাঁটের কারণে ইউএসএআইডির অধিকাংশ কর্মী এ বছর শেষে ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যাবেন। ফলে প্রকল্পের জন্য যদি অর্থ বরাদ্দ থাকেও, পরিচালনা করার মতো লোক থাকবে না।
বেইলির আশঙ্কা, ‘এর ফলে বিশাল পরিমাণ দূষিত মাটি পড়ে থাকবে। যার মাত্র ৩০ শতাংশ পরিষ্কার হয়েছে—সেটিও অপেক্ষাকৃত কম দূষিত ছিল।’
তিনি আরও জানান, বিয়েন হোয়ার অর্ধেকের কম মাটি এখনো পরিশোধন করা হয়েছে, বাকি অংশ মারাত্মকভাবে দূষিত এবং তা পরিষ্কার করার জন্য এখনো ইনসিনারেটর (বর্জ্য পোড়ানোর চুল্লি) তৈরি হয়নি।
সাবেক মার্কিন সিনেটর প্যাট্রিক লিহির পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন টিম রিজার। তিনি এখন সিনেটর পিটার ওয়েলচের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম এই যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন উত্তরাধিকার এজেন্ট অরেঞ্জ দূর করতে একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু এখন ট্রাম্প প্রশাসন অন্ধভাবে সবকিছু বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশীদারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, বিয়েন হোয়া ও কেন্দ্রীয় ভিয়েতনামে মাইন অপসারণসহ যুদ্ধ-উত্তর প্রকল্পগুলো এখনো ‘সক্রিয় ও চলমান’ রয়েছে। ভবিষ্যতে এগুলো চালু রাখতে কতটুকু সম্পদ লাগবে, তা নির্ধারণে মূল্যায়ন চলছে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক সাবেক মার্কিন সৈনিক চাক সিয়ারসি ১৯৯৫ সাল থেকে দেশটিতে মানবিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ বছরের আস্থা খুব সহজে ভেঙে পড়তে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘যাঁরা এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী, তাঁরা নিরপরাধ ভুক্তভোগী। একবার যুদ্ধের দ্বারা, আর এখন প্রকল্প বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে আবার।’
তথ্যসূত্র: এপি
ইসরায়েলে সবচেয়ে তীব্র ও বড় হামলার প্রস্তুতি শুরু করেছে ইরান। তারা বলেছে, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে যেসব হামলা চালানো হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় এটি হবে সবচেয়ে বড় ও তীব্র। সোমবার (১৬ জুন) দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টিভি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
৮ মিনিট আগেইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা নূর নিউজ দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের একটি এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাবরিজের কাছে। তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, তারা এমন কোনো ঘটনার খবর জানে না। আইডিএফ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে...
১৬ মিনিট আগেসিএনএনের ওল্ফ ব্লিটজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হারজোগ বলেন, ‘আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী, আমরা এখন পর্যন্ত যা দেখিয়েছি, তা আরও নাটকীয়ভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং এর ফলে ইরানেও পরিস্থিতির গতি পরিবর্তন হতে পারে।’
৩৭ মিনিট আগেইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, ‘দেখুন, আমরা যা প্রয়োজন, তা-ই করছি।’ নেতানিয়াহু আরও বলেন, ‘আমি বিস্তারিত বলতে চাই না, তবে আমরা...
১ ঘণ্টা আগে