Ajker Patrika

জুলফিকার আলী ভুট্টো ন্যায়বিচার পাননি: পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট

আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪, ১৮: ৩৩
জুলফিকার আলী ভুট্টো ন্যায়বিচার পাননি: পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট

সেনাশাসক জিয়াউল হকের শাসনামলের একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড মামলায় পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট আজ বুধবার এক রায়ে বলেছেন, ৪৪ বছর আগের ওই বিচারিক প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ভুট্টো ন্যায়বিচার পাননি।

জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মেয়ে পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো এখন দলটির প্রধান। বেনজির ভুট্টোকে ২০০৭ সালে হত্যা করা হয়। তাঁর হত্যার জন্য কে দায়ী এ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।

জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক শাসনামলে একটি বিতর্কিত বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭৯ সালে ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসা রায়ের সরাসরি সম্প্রচারে বলেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন নয় সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে এ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু বিচার এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে এর কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।’

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি যে, একটি আদালতের করা ভুল আদালতের মাধ্যমেই সংশোধন করা হলো।’

২০১১ সালে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির বাবা আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন একটি বিচারিক রেফারেন্স (পূর্বের দৃষ্টান্ত) আদালতে দাখিল করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই আজ সুপ্রিম কোর্ট এ রায় দিলেন। আসিফ আলী জারদারি আবেদনে পিপিপি প্রতিষ্ঠাতাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পুনর্বিবেচনার বিষয়ে শীর্ষ আদালতের মতামত চেয়েছিলেন।

রায় ঘোষণার পর বিলাওয়াল ভুট্টো এক্স হ্যান্ডলে এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘আমাদের পরিবার এই শব্দগুলো শোনার জন্য তিন প্রজন্ম ধরে অপেক্ষা করে ছিল।’

আদালত বর্তমানে সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছেন। পরে বিস্তারিত আদেশ দেবেন।

লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউসুফ নজর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এটি জিয়ার সামরিক শাসনের অধীনে ন্যায়বিচারের বড় বিচ্যুতির একটি স্বীকারোক্তি।’

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলে, জিয়াউল হকের ১১ বছরের একনায়কতন্ত্রের কালটি ছিল গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ, পিপিপির কর্মীদের ওপর নির্বিচার নিপীড়ন এবং বিরোধী ও সমালোচকদের প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করার মতো গর্হিত ঘটনাবহুল।

নজর বলেন, ‘আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রক্সি যুদ্ধে লড়ার জন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে সরকার রক্ষণশীল মুসলিম জাতিকে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের এই অবস্থান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মীয় চরমপন্থীদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার একটি অভূতপূর্ব স্তরের দিকে পরিচালিত করেছে।’

পাকিস্তানে ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তিনি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তাঁকে এক মাসের জন্য জেলে আটকে রাখেন। জিয়াউল হক ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বারবার নির্বাচন স্থগিত করেন।

পিপিপি সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে কারামুক্তির পর ভুট্টো সারা দেশ সফর করেন। এই সমাবেশগুলো ঠেকাতে ট্রেন ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মুলতানে ভুট্টোর শেষ সফরটি ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সমাবেশে বাধা দিতে প্রশাসনের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিপুল মানুষ জড়ো হয়। ভিড়ের কারণে বিশৃঙ্খলা হয়। আর এই অজুহাতেই ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার বলে, তাঁর নিরাপত্তার জন্যই তাঁকে হেফাজতে নেওয়া দরকার ছিল।

১৯৭৪ সালের মার্চে একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার হুকুমের আসামি হিসেবে ভুট্টোকে ৩ সেপ্টেম্বর আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ভুট্টোর স্ত্রী নুসরাত ভুট্টো তাঁর আইনজীবীদের দিয়ে আইনি লড়াই শুরু করেন। সেনা সরকারের উপস্থাপিত পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য-প্রমাণের কারণে ১০ দিন পরই মুক্তি পান ভুট্টো। তবে সামরিক আইনের অধীনে ভুট্টো আবার গ্রেপ্তার হন। এর ফলে আসন্ন নির্বাচনও বাতিল ঘোষণা করা হয়।

লাহোর হাইকোর্টে হাজির করার আগে নিম্ন আদালতে ভুট্টোর পক্ষে সব আবেদন নাকচ করা হয়। ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্সের মহাপরিচালক মাসুদ মাহমুদের প্রধান সাক্ষী ছিলেন। তাঁর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ১৯৭৭ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে বিচার প্রক্রিয়া চলে। অনিয়ম, নির্যাতন এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্বীকারোক্তি বিচার প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে।

১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি ভুট্টো সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করলে, প্রধান বিচারপতি মৌলভি মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ কোনো পর্যবেক্ষককে এজলাসে প্রবেশ করতে দেননি। ভুট্টো পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে পুনর্বিচারের দাবি করলে আদালত তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ ভুট্টোকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত