Ajker Patrika

প্রতি ৭ মিনিটে মৃত্যু এক প্রসূতির, নারীরা জীবন দিয়ে মা হন যে দেশে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ১৮: ০৫
সন্তান কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। ছবি: এএফপি
সন্তান কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। ছবি: এএফপি

সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন নাফি সালাহু। তখন তাঁর বয়স ২৪ বছর। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম। শরীরে এক ফোঁটা শক্তি ছিল না!’

তিনি যখন প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, ঠিক তখনই নাইজেরিয়ায় চলছিল চিকিৎসকদের ধর্মঘট। ফলে সন্তান প্রসবে মেডিকেল সহায়তা পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। নাফিসা জানান, প্রায় তিন দিন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তিনি সয়েছেন। প্রসবপথে আটকে গিয়েছিল সন্তানের মাথা। সেভাবেই কোনো ধরনের অস্ত্রোপচার কিংবা ওষুধ ছাড়া পড়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। তিন দিন পর এক চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায়, যিনি সি সেকশন করতে রাজি হন। নাফিসা সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও সন্তানটি বাঁচেনি!

নাফিসা বলেন, ‘এ ঘটনার ১২ বছর পর আমি মা হয়েছি। কয়েকবার সন্তান হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই নিজেকে নিয়তির হাতে সঁপে দিয়ে হাসপাতালে গিয়েছি। জানতাম, আমি জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু তখন আর ভয় লাগত না। প্রথম ডেলিভারির সময় যা সয়েছি, এরপর আর কত কষ্টই হতে পারে আমার!’

জরিপ বলছে, নাইজেরিয়ায় প্রতি সাত মিনিটে গড়ে একজন নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। সন্তান জন্মদানের জন্য নাইজেরিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জাতিসংঘের সর্বশেষ (২০২৩ সালের) তথ্য অনুযায়ী, নাইজেরিয়ায় প্রতি ১০০ জন প্রসূতির মধ্যে একজন মারা যান প্রসবকালে বা এর পরপরই। ২০২৩ সালে বিশ্বের মোট মাতৃমৃত্যুর প্রায় ২৯ শতাংশই ঘটেছে নাইজেরিয়ায়। সংখ্যায় তা প্রায় ৭৫ হাজার।

পাঁচ বছর আগে হাসপাতালেই সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান চিনেনে এনওয়েজি। অনেকের জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণার বিষয় হলো—এই ধরনের বহু মৃত্যু—বিশেষ করে প্রসবপরবর্তী রক্তপাতের মতো কারণে হওয়া মৃত্যুগুলো প্রতিরোধযোগ্য। ৩৬ বছর বয়সী এনওয়েজি দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ওনিৎশা শহরের একটি হাসপাতালে মারা যান। তাঁর ভাই হেনরি আদেহ বলেন, ‘চিকিৎসকেরা রক্ত চাচ্ছিলেন, কিন্তু যতটুকু জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল তা যথেষ্ট ছিল না। রক্ত জোগাড় করতে আমরা সবাই ছোটাছুটি করছিলাম। বোনকে হারিয়ে আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়েছি। আমার শত্রুরও যেন এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না হয়। এটা সহ্য করার মতো নয়, মেনে নেওয়ার মতো নয়!’

মাতৃমৃত্যুর আরও কিছু সাধারণ কারণ হলো প্রসবকালে জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ ও অনিরাপদ গর্ভপাত। ইউনিসেফ নাইজেরিয়া অফিসের কর্মকর্তা মার্টিন ডলস্টেন বলেন, এই ‘অত্যন্ত উচ্চ’ মাতৃমৃত্যু হার একাধিক জটিল কারণের ফল। এর মধ্যে রয়েছে—দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো, চিকিৎসকের অভাব, ব্যয়বহুল চিকিৎসা, কুসংস্কার ও নিরাপত্তাহীনতা।

উইমেন অব পারপাস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের জাতীয় সমন্বয়কারী মাবেল অনউয়েমেনা বলেন, ‘সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু—কোনো নারীরই ভাগ্য হতে পারে না। কিন্তু নাইজেরিয়ার গ্রামাঞ্চলের নারীরা এখনো অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন। তাঁদের ধারণা, হাসপাতালে যাওয়ার অর্থ সময়ের অপচয়। তাঁরা গাছগাছড়া ও ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন পদ্ধতির ওপর ভরসা করেন। যে কারণে জরুরি চিকিৎসা বিলম্বিত হয়ে পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়।’

আবার দুর্গম পথের নানা কারণে অনেকের জন্য সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছানোও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে তাঁরা যদি কোনোভাবে পৌঁছাতেও পারেন, তারপরেও বিপত্তির শেষ নেই। অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওষুধ বা প্রশিক্ষিত কর্মী—ফলে মানসম্পন্ন চিকিৎসা তাঁরা পান না।

নাইজেরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার মোট বাজেটের মাত্র ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে—যেটি ২০০১ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নের সঙ্গে করা চুক্তিতে প্রতিশ্রুত ১৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক কম। ২০২১ সালে নাইজেরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ২১ কোটি ৮০ লাখ, কিন্তু সে সময় দেশে মাত্র ১ লাখ ২১ হাজার ধাত্রী (মিডওয়াইফ) ছিলেন। সে বছর গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের অর্ধেকেরও কম একজন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ করা মান অর্জনের জন্য নাইজেরিয়ায় আরও প্রায় ৭ লাখ নার্স ও ধাত্রী প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশটির চিকিৎসক সংকটও ভয়াবহ। এই ভয়াবহ জনবল ও অবকাঠামো ঘাটতির ফলে অনেকেই হাসপাতাল বা ক্লিনিকমুখী হতে চান না।

জামিলা ইসহাক নামের এক নারী বলেন, ‘আমি আসলে হাসপাতালের ওপর তেমন ভরসা করি না, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে গাফিলতি এত বেশি শুনেছি যে ভয় লাগে। আমার চতুর্থ সন্তানের সময় প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিয়েছিল। স্থানীয় ধাত্রী আমাদের হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি, সেখানে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী নেই। তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাড়িতেই সন্তান জন্ম হয়।’

নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কানো রাজ্যের এই বাসিন্দা এখন পঞ্চম সন্তানে জন্ম দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার কথা ভাবছি, কিন্তু খরচ এত বেশি যে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।’

নাইজেরিয়ার ন্যাশনাল প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির কমিউনিটি হেলথ সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক ড. নান্না সান্দাহ-আবুবাকার স্বীকার করেছেন যে দেশের মাতৃমৃত্যু পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তবে তিনি জানান, এই সংকট মোকাবিলায় সরকার নতুন একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নাইজেরিয়া সরকার ম্যাটারনাল মোরালিটি রিডাকশন ইনোভেশন ইনিশিয়েটিভ—মামি নামে একটি প্রকল্পের পাইলট পর্যায় চালু করে। এই কর্মসূচিটি ধাপে ধাপে দেশের ৩৩টি রাজ্যের ১৭২টি স্থানীয় সরকার অঞ্চলে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে দেশের অর্ধেকের বেশি প্রসবসংক্রান্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

ড. সান্দাহ-আবুবাকার বলেন, ‘আমরা প্রতিটি গর্ভবতী নারীকে শনাক্ত করি, জানি তাঁরা কোথায় থাকেন এবং তাঁদের গর্ভের সময়, প্রসব এবং পরবর্তী সময়টিতে সহায়তা করি।’ এখন পর্যন্ত ছয়টি রাজ্যে জরিপ চালিয়ে ৪ লাখ গর্ভবতী নারীর খোঁজ পাওয়া গেছে এবং তাঁদের সম্পর্কে জানা গেছে তাঁরা অ্যান্টিনেটাল ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন কি না। তাঁর মতে, পরবর্তী ধাপে এই নারীদের প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে তাঁরা নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পারেন।

মামি প্রকল্প স্থানীয় পরিবহন নেটওয়ার্কের সঙ্গেও কাজ করবে, যাতে আরও বেশি নারী ক্লিনিকে পৌঁছাতে পারেন এবং স্বল্পমূল্যের সরকারি স্বাস্থ্যবিমায় অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত হন। যদিও এই কর্মসূচির বাস্তব ফলাফল এখনো স্পষ্ট নয়, তবুও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করছে, নাইজেরিয়াও একসময় বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।

স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্বজুড়ে মাতৃমৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। নাইজেরিয়ায়ও এই সময়ের মধ্যে কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে মাত্র ১৩ শতাংশ।

মামি বা অন্যান্য উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার—বিশেষ করে বাজেট বরাদ্দ ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। ইউনিসেফের প্রতিনিধি মার্টিন ডলস্টেন বলেন, ‘এই উদ্যোগগুলো সফল হবে কি না, তা নির্ভর করবে পর্যাপ্ত অর্থায়ন, কার্যকর বাস্তবায়ন ও নিয়মিত নজরদারির ওপর।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দী ছিলেন শেখ মুজিব—পোস্ট ডিলিট করলেন সারজিস

রিল বানাতে গিয়ে যমুনায় তলিয়ে গেল ৬ কিশোরী

হামজা-সোহেলের গোলে বাংলাদেশের জয়

ইশরাককে মেয়রের শপথ পড়ানো স্থানীয় সরকারের হাতে, ইসির করণীয় শেষ: সানাউল্লাহ

নওফেলের বিদেশি স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত