Ajker Patrika

শিশু কিডনি রোগী ৫০ লাখ, ডায়ালাইসিস সুবিধা নামমাত্র

  • জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটেও নেই শিশুদের ডায়ালাইসিস সুবিধা।
  • ১০ শয্যার শিশু ডায়ালাইসিস ইউনিট খুলতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি।
  • শিশুদের ডায়ালাইসিস করা হয় হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১: ২৩
Thumbnail image
প্রতীকী ছবি

পিরোজপুরের আবদুর রহিমের (ছদ্মনাম) ১০ মাসের ছেলে জন্মগত হৃদ্‌রোগের জটিলতায় ভুগছে। চিকিৎসকের পরামর্শে সম্প্রতি ভর্তি করানো হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি)। হৃৎপিণ্ডের সংক্রমণ তীব্র হওয়ায় উচ্চ-মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করায় শিশুটির সিরাম ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে কিডনি প্রায় শতভাগ কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। শিশুটির স্নায়বিক সমস্যা থাকায় যা করাতে হবে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) রেখে।

আবদুর রহিম ছেলের কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য পাশের জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (এনআইকেডিইউ) যোগাযোগ করে জানতে পারেন, সেখানে শিশুদের ডায়ালাইসিস সুবিধা নেই। রাজধানীর আরও অন্তত ১০টি বিশেষায়িত হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে রহিমের উদ্বেগ আরও বাড়ে। কারণ, এসব হাসপাতালেও সেই সুবিধা নেই। সবশেষে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) পিআইসিইউসহ ডায়ালাইসিসের সুবিধার খোঁজ পান; কিন্তু শয্যা খালি নেই। দুদিন অপেক্ষার পর ছেলেকে ভর্তি করাতে পেরেছেন।

দেশে শিশুদের কিডনি রোগের চিকিৎসার বাস্তব চিত্র অনেকটাই ফুটে উঠেছে আবদুর রহিমের অভিজ্ঞতা থেকে। জাতীয় পর্যায়ে নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকায় দেশে শিশু কিডনি রোগীর সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। তবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেডিকেল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ জার্নাল বলছে, দেশে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের মধ্যে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ কিডনি রোগী। আর গত অক্টোবরে ঢাকায় ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতাল ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট আয়োজিত একটি সম্মেলনে বলা হয়, দেশের প্রায় ৫০ লাখ শিশু বিভিন্ন পর্যায়ের কিডনি রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে আড়াই লাখ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগী (সিকেডি)। জন্মগত, ডায়রিয়ার পরে অ্যাকিউট কিডনি ফেইলিওর এবং নেফ্রাইটিসের প্রদাহ শিশুদের কিডনি রোগের প্রধান কারণ।

শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ এবং শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগ (ইএসআরডি) দেখা যায় না। ছয়-সাত বছরের শিশুদের মধ্যে এই পর্যায়ের কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রোগের কারণে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ বা অন্য কোনো কারণে কিডনির কার্যকারিতা হঠাৎ কমে যেতে পারে; যাকে অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি (একেআই) বলা হয়। সে ক্ষেত্রে শিশুটিকে জরুরি ভিত্তিতে পিআইসিইউতে রেখে ডায়ালাইসিস করাতে হয়।

কিন্তু দেশে শিশু কিডনি রোগীর তুলনায় চিকিৎসার সুবিধা একেবারেই কম। শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র ডায়ালাইসিস মেশিন লাগে। দেশে কিডনি রোগের সরকারি সর্বোচ্চ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান এনআইকেডিইউর সূত্র জানায়, সেখানে শিশুদের ডায়ালাইসিস সুবিধা না থাকায় ১০ শয্যার শিশু ডায়ালাইসিস ইউনিট খুলতে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। দেশে কিডনি রোগের চিকিৎসা ও শিক্ষার সর্বোচ্চ সরকারি এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিশু কিডনি রোগের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও নিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অবশ্য শিশু ডায়ালাইসিস ইউনিট না থাকায় ডায়ালাইসিস শিখতে তাঁদের যেতে হয় বাংলাদেশে শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এনআইকেডিইউতে এখনো ১২ বছরের কম বয়সী কারও কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়নি। ৫ শয্যার পিআইসিইউতে রিভার্স অসমোসিস সুবিধা থাকায় শিশুদের জন্য ডায়ালাইসিস মেশিন এলেই সেবা চালু করা যাবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

শিশু হাসপাতাল ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শিশুদের ডায়ালাইসিসের সুবিধা আছে। কিছু বেসরকারি হাসপাতালে সীমিতভাবে এই সুবিধা আছে।

কিডনি মানবদেহে প্রবাহিত সব রক্ত ছেঁকে দূষিত বর্জ্য পানির সঙ্গে মিশিয়ে মূত্র হিসেবে বের করে দেয়। কিডনি বিকল হলে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিডনির পরিবর্তে কৃত্রিম ছাঁকনি ব্যবহার করে দেহ থেকে রক্ত ছেঁকে বর্জ্য বের করার প্রক্রিয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডায়ালাইসিস বলা হয়।

কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত বড় কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। অনেকের ক্ষেত্রে এমনও হয়, কিডনি পুরোপুরি বিকল হওয়ার পর উপসর্গ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসার জন্য আসেন একদম শেষ পর্যায়ে। যত দিন কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয় না, তত দিন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়।

এনআইকেডিইউর তথ্য বলছে, দেশে অন্তত ২ কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে বছরে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে কিডনি রোগের শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়। গ্লোমারুলোনেফ্রাইটিস (জিএন), ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রোপ্যাথি দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের প্রধান কারণ। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৩০টি প্রতিষ্ঠানে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের সুবিধা রয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে ১০টি প্রতিষ্ঠানে। ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে ৬৫০টি। ডায়ালাইসিস প্রয়োজন এমন রোগীদের মাত্র ২৫ শতাংশ এই সুবিধার আওতায় আসছে। এর কারণ, ডায়ালাইসিস সেবার অপর্যাপ্ততা ও উচ্চ খরচ।

বিএসএমএমইউর শিশু কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে ডায়ালাইসিস শুরু করি। এরপর শুরু হয় ঢাকা শিশু হাসপাতালে। এর বাইরে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। শিশু কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের চাহিদার তুলনায় বিদ্যমান সুবিধা খুব নগণ্য। এই সুবিধা চালুর বিষয়ে বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারের পদক্ষেপের তেমন অগ্রগতি হয়নি।’ তিনি জানান, দেশে বর্তমানে বিএসএমএমইউ, এনআইকেডিইউ ও শিশু হাসপাতালে শিশু কিডনি রোগের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (ডক্টর অব মেডিসিন) রয়েছে। প্রতিবছর নতুন করে ৬-৭ জন শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ বের হচ্ছেন।

জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, ‘শিশুদের কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া ইউরোলজির সব ধরনের অস্ত্রোপচার আমরা করতে পারি। এখানে শিশু কিডনি রোগ বিভাগ অনেক গোছানো। আমরা চেষ্টা করছি, শিগগির শিশুদের ডায়ালাইসিস চালু করতে পারব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত