Ajker Patrika

২ হাজার বছর আগের ড্রোন! চীনের নাকি ভারতের

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৬: ০৫
Thumbnail image

সোশ্যাল মিডিয়ায় ড্রোন সদৃশ একটি বস্তুর ছবি সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল ছবিটি সম্পর্কে দাবি করা হচ্ছে, এটি চীনের সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় পাওয়া যায় ২ হাজার বছরের পুরোনো ড্রোনের ছবি। ছবিটি নিয়ে ইংরেজি ভাষায় ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ ও অ্যাকাউন্ট থেকে বেশি পোস্ট হতে দেখা যায়। ক্রিস ঝাও ইনোভেশনস (Kris Zhao Innovations) নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ৬ মার্চ ছবিটি পোস্ট করা হয়। এতে আজ শনিবার (৯ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ৬৫ হাজার রিয়েকশন পড়েছে। ছবিটি সাড়ে ৮ হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে।

২ হাজার বছরের পুরোনো ড্রোনটি ভারতে পাওয়া গেছে দাবিতে এক্সে টুইট। ছবি: এক্সবাংলা ভাষাভাষী বিজ্ঞান ভিত্তিক বেশ কিছু গ্রুপেও ছবিটি পোস্ট করে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ড্রোন সদৃশ বস্তুটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। ‘সাইকোলজি ও বিজ্ঞানের অজানা তথ্য’ নামের ৭ লাখ ২২ হাজার সদস্যের একটি গ্রুপে গতকাল শুক্রবার (৮ মার্চ) রাত ৮টা ৫৬ মিনিটে কেএম মালেক রহমান নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ছবিটি পোস্ট করে লেখা হয়, ‘সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় (Sanxingdui archaeological site) প্রায় ২০০০ বছর পুরোনো ড্রোনের মতো দেখতে এই আর্টিফ্যাক্টটি পাওয়া গেছে। এটা কী হতে পারে? সে সময় কি প্রযুক্তি আসলেই এতটা উন্নত ছিল?’

আবার এক্সে (সাবেক টুইটার) কিছু ভারতীয় অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করে দাবি করা হচ্ছে, ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ) খননকালে ২ হাজার ১০০ বছরের পুরোনো ‘সনাতন’ ড্রোন পাওয়া গেছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম ও আদি সভ্যতা আর্য সভ্যতা।

ড্রোন সদৃশ বস্তুটি আসলে কী?
গুগলে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে ‘convomf’ নামের একটি ভেরিফায়েড এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ছবিটি সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। হ্যান্ডলটিতে ছবিটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, চীনের সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া ২ হাজার বছর আগের ড্রোন দাবিতে প্রচারিত ছবিটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি।

চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইশিগুয়ায় প্রকাশিত ৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।  ভিডিওটি গত বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) প্ল্যাটফর্মটিতে পোস্ট করা হয়। ছবিটি সম্পর্কে ভিডিওটির ক্যাপশনে বেশ কিছু হ্যাশট্যাগ দিয়ে বলা হয়েছে, ব্রোঞ্জের তৈরি সানসিংদুই এয়ারক্রাফট। এটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি পুরোপুরি কাল্পনিক একটি সৃষ্টি। কেউ এটিকে দয়া করে সিরিয়াসলি নেবেন না! (চীনা ভাষা থেকে অনূদিত)।

ছবিটি আসলেই এআই দিয়ে তৈরি কি না তা যাচাই করেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। এআই ইমেজ শনাক্তকারী সাইট হাগিং ফেইসের মাধ্যমে ছবিটি যাচাই করে দেখা হয়। ওয়েবসাইটটির ফলাফল অনুযায়ী, ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ৯২ শতাংশ। এআই ইমেজ শনাক্তকারী আরেকটি ওয়েবসাইট এআই অর নট থেকেও ছবিটি সম্পর্কে একই ফলাফল পাওয়া যায়। ছবিটি যাচাই করে ওয়েবসাইটটিতে ফলাফল হিসেবে বলা হয়েছে, ড্রোন সদৃশ বস্তুর ভাইরাল ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ভাইরাল ছবিটি এআই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। ছবি: এ আই অর নট সাইটগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হতে সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে এমন কোনো বস্তু পাওয়া গেছে কি না তা খুঁজে দেখে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। 

চীনের সংবাদমাধ্যম চায়না ডেইলি সূত্রে জানা যায়, সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি চীনের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সিচুয়ান প্রদেশের গুয়াংহান শহরে অবস্থিত। এটি দেশটির ইয়াংজি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত সবচেয়ে বড় প্রাগৈতিহাসিক শহরের ধ্বংসাবশেষ। ৩ হাজার ২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এই স্থান ১২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।

সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৯২৯ সালে এবং স্থানটিতে ১৯৩৪ সালে ডেভিড ক্রকেট গ্রাহাম নামে যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে প্রথম খনন করা হয়। তিনি সিচুয়ানের প্রাদেশিক রাজধানী চেংদুর একটি জাদুঘরের পরিচালকও ছিলেন। তবে পরবর্তীতে নানা কারণে স্থানটিতে খনন কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।

পরে ১৯৮০–এর দশকে আবার খনন কাজ শুরু হয়। ওই সময় স্থানটি থেকে ১ হাজারের বেশি বিভিন্ন প্রত্নবস্তু উদ্ধার করা হয়। এসবের মধ্যে ছিল অসংখ্য ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র, মূর্তি, মানুষের মুখোশ, প্রায় চার মিটার দৈর্ঘ্যের একটি গাছ। ধারণা করা হয়, এই গাছটিকে স্বর্গের সিঁড়ি হিসেবে উপাসনা করা হতো। স্থানটিতে ২০১৯–২০ সালেও খনন করা হয়। ওই সময় সিল্ক, সোনার মুখোশ, ব্রোঞ্জের তৈরি পাত্র, হাতির দাঁতসহ আরও ৫০০টির বেশি নিদর্শন পাওয়া যায়। 

চায়না ডেইলির এই প্রতিবেদন থেকে এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের অনেকগুলো নিদর্শনের ছবিও পাওয়া যায়। এসব ছবির মধ্যে ড্রোন সদৃশ ভাইরাল ছবিটির মতো কোনো বস্তু দেখা যায়নি। চায়না ডেইলির প্রতিবেদনটিতেও এমন কোনো নিদর্শনের ইঙ্গিত নেই।

সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি থেকে পাওয়া প্রাচীন নিদর্শনগুলো নিয়ে ১৯৯২ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠিত হয় সানসিংদুই জাদুঘর। জাদুঘরটি ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। জাদুঘরটির ওয়েবসাইটেও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি থেকে ড্রোন সদৃশ ভাইরাল ছবিটির মতো কোনো বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।

ওপেন সোর্স অনুসন্ধানেও জাদুঘরটির ভেতরের অনেকগুলো ছবি পাওয়া যায়। ওইসব ছবির মধ্যেও ড্রোন সদৃশ ভাইরাল ছবিটির মতো কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। যেমন, ওয়াং নিয়েনদং নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সানসিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির নিদর্শনের অনেকগুলো ছবি পাওয়া যায়।

অ্যাকাউন্টটির পরিচয় থেকে জানা যায়, এই অ্যাকাউন্টধারী সিচুয়ান ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটের একজন পেশাদার শিল্পী। ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সানসিংদুই জাদুঘরে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির নিদর্শনগুলোর ছবি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন তিনি। তাঁর পোস্টের ক্যাপশনে জাদুঘরে থাকা স্থানটির নিদর্শনের বর্ণনাতেও ড্রোনসদৃশ কোনো বস্তু সম্পর্কে তথ্য নেই। এ ছাড়া সংযুক্ত ছবিগুলোতেও এমন কোনো ছবি নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত