Ajker Patrika

দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান কি আবশ্যক

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১৮: ১৬
Thumbnail image

স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য পানি আবশ্যক। কিন্তু দিনে মানুষের কতটুকু পানি প্রয়োজন? দিনে ৮ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন বলে একটা কথা চালু আছে। এর কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? আসলেই কি একজন মানুষের এই পরিমাণ পানি পান করতে হয়, নাকি ব্যক্তিভেদে তা ভিন্ন হয়? 

প্ৰথমেই জেনে নেওয়া যাক, ৮ গ্লাস পানি পান করার ধারণার সূত্রপাত কীভাবে হলো। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট প্রচারিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই তথ্যের সম্ভাব্য উৎপত্তি ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ডের একটি পরামর্শ থেকে। সেখানে বলা হয়, একজন মানুষের দৈনিক আড়াই লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। তবে পাঠকেরা এ পরামর্শ থেকে যে বার্তা নিতে ভুল করেছিলেন, তা হলো ‘পানির এই পরিমাণের বেশির ভাগই প্রস্তুত খাবারে থাকে’।

তবে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদন বলছে, শুধু প্রস্তুত খাবারেই নয়, সকল খাবারে; বিশেষ করে সবজি ও ফলেও পানির জোগান থাকে। এ ছাড়া জুস, চা ও কফি; এমনকি বিয়ার থেকেও একজন মানুষের দৈনন্দিনের পানির চাহিদা পূরণ হয়।

এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ লাইনে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দিনে ৮ গ্লাস পানি পানের ধারণার সমর্থনে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই; বরং পানির চাহিদা ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষের জন্য সরাসরি এত বেশি পানি পানের প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে পর্যাপ্ত পানি না পানের ফলে কেউ কেউ স্বল্পমাত্রায় পানিশূন্যতায় ভুগতে পারেন এবং এ কারণে দেহের ওজন ১-২ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ পর্যায়ে যে কেউ মাথাব্যথা, অবসাদের মতো বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে পারেন। তবে এ জন্য কাউকে মেপে মেপে ৮ গ্লাস পানিই পান করতে হবে, ব্যাপারটি এমন নয়।

বিখ্যাত গবেষণা জার্নাল সায়েন্সে ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত গবেষণামতে, বেশির ভাগ সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে দিনে আট গ্লাস পানি পান করা অপ্রয়োজনীয়; বরং পরামর্শটি আংশিকভাবে বিভ্রান্তিকর। কারণ, এটি আমাদের খাবার, কফি এবং চা-এর মতো অন্যান্য পানীয় থেকে পাওয়া পানির পরিমাণকে বিবেচনা করে না। 

গবেষণা অনুযায়ী, মানুষের দেহে পানির চাহিদা ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয় এবং বয়স, লিঙ্গ, আকার, শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা এবং পরিবেশের মতো বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, দিনে আট গ্লাস পানি পানের তত্ত্বের পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ৮৮৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর চালানো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের একটি সমীক্ষার উল্লেখ করা হয় এই প্রতিবেদনে। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, নিয়মিতভাবে প্রতিদিন ছয় গ্লাসের কম পানি পান করেন এমন ২২৭ জনের মধ্যে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ানি স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক তামারা হিউ-বাটলার সিএনএনকে বলেন, শরীর থেকে কতটুকু পানি বের হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের পানির চাহিদা। পানির প্রয়োজনীয়তা মূলত তিন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে— 

  • শারীরিক ওজন: বেশি ওজনের মানুষের বেশি পানি প্রয়োজন।
  • তাপমাত্রার রকমফের: যখন তাপমাত্রা বেশি থাকে, মানুষ তখন বেশি ঘামে ও শরীর থেকে তরল হারায়।
  • শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা: অতিরিক্ত পরিশ্রম শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি নিঃসৃত করে।
  • তাই প্রতিদিন আট গ্লাস পানি পান করার ধারণা সকল বয়সী মানুষের জন্য উপযুক্ত নয়।

অন্যদিকে অতিরিক্ত পানি পান কখনো কখনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কেউ অতিরিক্ত পানি পান করলে তার কিডনি অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে পারে না। ফলে শরীরের সোডিয়াম উপাদান দ্রবীভূত হয়ে যেতে পারে, যেটাকে হাইপোনেট্রেমিয়া বলা হয় এবং এটি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

একজন মানুষের দৈনিক পানির চাহিদা কতটুকু? 
মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাস, ঘাম, মূত্রত্যাগসহ প্রতিনিয়ত নানাভাবে দেহ থেকে পানি নিষ্কাশন করে। আর তাই শরীরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে আমাদের পানিসমৃদ্ধ খাদ্য ও পানীয় পানের মাধ্যমে শরীরে পানির জোগান স্বাভাবিক রাখতে হয়। 

মানুষের পানি গ্রহণের একটি পরিমাপ ঠিক করে দিয়েছে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন। প্রতিষ্ঠানটির মতে, একজন পুরুষের দিনে সাড়ে ১৫ কাপ বা ৩ দশমিক ৭ লিটার ও একজন নারীর সাড়ে ১১ কাপ বা ২ দশমিক ৭ লিটার তরল প্রয়োজন। যা পানি, অন্যান্য পানীয় ও খাদ্য থেকে মানুষ পেয়ে থাকে। একজন মানুষের প্রতিদিনের পানির চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তরল সাধারণত খাবার থেকে আসে এবং বাকিটা আসে বিভিন্ন পানীয় থেকে।

খাবার যেভাবে পানির চাহিদা পূরণ করে 
আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাবার গ্রহণ করি, সেসব খাবারেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি  থাকে। তবে আমরা খাবার থেকে কতটুকু পানি পাব, তা নির্ভর করে আমরা কত পানিসমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছি তার ওপর। ফল ও শাকসবজি বিশেষ পানিসমৃদ্ধ। মাংস, মাছ ও ডিমের মতো খাবারেও তুলনামূলকভাবে ভালো পরিমাণে পানির সংস্থান থাকে। যেমন, ডিমে পানির পরিমাণ ৭৬ শতাংশ, তরমুজে ৯২ শতাংশ, কমলায় ৮৮ শতাংশ, শসায় ৯৫ শতাংশ, টমেটোতে ৯৪ শতাংশ, একটি মাঝারি টমেটোতে প্রায় অর্ধেক কাপ বা ১১৮ মিলিলিটার পানি পাওয়া যায়, শীতকালীন সবজি ফুলকপিতে পানির পরিমাণ ৯২ শতাংশ, এক কাপ বা ১০০ গ্রাম ফুলকপি ৫৯ মিলিলিটারের বেশি পানি সরবরাহ করে থাকে, বাঁধাকপিতে পরিমাণ ৯২ শতাংশ। এ ছাড়া শরীরে পুষ্টি বিপাকের সময়ও অল্প পরিমাণে ‘মেটাবলিক ওয়াটার’ নামে একধরনের পানি উৎপন্ন হয়।

সিদ্ধান্ত
উক্ত তথ্যসমূহ থেকে প্রমাণিত হয়, একজন মানুষকে সরাসরি দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান করতে হবে, এই ধারণার পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ভূল ধারণা। কারণ, মানুষের পানির যে চাহিদা, তা সরাসরি পানি পান ছাড়াও মানুষের অন্যান্য খাবার, পানীয় থেকেও পূরণ হয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত