Ajker Patrika

ফেরির খাবার

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২২, ১০: ২১
ফেরির খাবার

পাটুরিয়া ফেরিঘাটের এক পান দোকানে দেখা খাদেম আলীর সঙ্গে। এটা-সেটা কথার ফাঁকে তিনি স্মৃতিচারণা করলেন ফেরির খাবারের। তাঁর চোখে তখন উন্মত্ত পদ্মার ছবি। সে পদ্মা আজকের মতো শীর্ণকায়া নয়, বিপুলা। তার স্রোতের ওপর ‘ঘাসে’র মতো দুলতে দুলতে চলত ফেরি, আরিচা টু গোয়ালন্দ এবং আরিচা টু নগরবাড়ি। দ্বিতীয় রুটটি ছিল দীর্ঘ। ফলে তাতে খাওয়াদাওয়ার চল ছিল বেশি। এককালে কলকাতা থেকে দীর্ঘ রেল ভ্রমণের পর যাত্রীরা নামত গোয়ালন্দ ঘাটে। সেখান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যেত স্টিমারে। এই স্টিমার ঘাটের খাবার নিয়ে উৎকৃষ্ট সব গল্প বলে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলীসহ অনেক প্রাতঃস্মরণীয় লেখক। সেসব গল্প আর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের ফেরির খাবারের গল্প মোটামুটি একই রকম, অন্তত খাবারের আইটেমের ক্ষেত্রে।

সাধারণ যাত্রীদের খাবার
ভাত, ডাল আর ইলিশ মাছ সাধারণ যাত্রীদের জন্য খাবারের আইটেম এই তিনটি। এর মধ্যে ভাত ও ডাল ‘পেট চুক্তি’ অর্থাৎ যত ইচ্ছা খাওয়া যাবে। তবে দাম দিতে হবে ইলিশ মাছের। সে দামও যে আহামরি ছিল, তা নয়। আকাশ ছোঁয়া দামের এই যুগে শুনলে হাসিই পাবে হয়তো। একসময় এক টাকায় খাওয়া যেত এ খাবার। তারপর ক্রমে পাঁচ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৬০ টাকা। দামে বদল এলেও খাবারের স্বাদ ও পরিমাণে তেমন কোনো বদল এখনো আসেনি। তবে এখন সাধারণ যাত্রীদের জন্য মুরগির মাংস রান্না হয়। কিন্তু পেট চুক্তি খাবারের সে ধারা এখনো বজায় আছে।ইলিশ মাছের ঝোল। ছবি: লেখক

বৃহস্পতিবারের সকাল। ফরিদপুর যাব বলে পাটুরিয়া ঘাটে চেপে বসেছি শাপলা শালুক নামের ফেরিটিতে। লোকজন কম। ঘাটে ভিড়ও কম। ফেরিতে ওঠা একটি বাস থেকে নেমে একপাল কিশোর- তরুণ হই হই করতে করতে উঠে গেল ফেরির দোতলায়। কয়েকজন বসে পড়ল টেবিলে। ভাত খাবে তারা। এল ভাত, ইলিশ মাছ ও মুরগির মাংস। এই দলেরই একজন মো. ফরহাদ। জিজ্ঞেস করলাম, খেতে কেমন? জানাল, ভালোই তো। মাছগুলো আর একটু ভাজা ভাজা হলে আরও ভালো হতো। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন ফেরির পাচক মোহাম্মদ আবু তালেব। তিনি জানালেন, ফেরিতে ভাত, ডাল আর এক পিস মাছে মিলে একটি প্যাকেজ। এর দাম ১৬০ টাকা। তবে ভাত, ডাল যত খুশি খাওয়া যাবে। কিন্তু মাছ এক পিস।

মেলা দিন আগের কথা। পদ্মা তখন আরও বড় আছিল। আর কী ঢেউ! সেই ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চলত ফেরি। স্রোত কাটতে কাটতে যাইত তো। টাইম লাগত মেলা। পার হওয়ার সময় বেলা খাড়া দুপুরে কখনো কখনো খাইতাম আমরা। ট্যালট্যালা ডাইল, মোটা চাউলের ভাত আর ইলিশ মাছ।… ভাজাও আছিল, আবার রান্নাও আছিল। মাছের ঝোলও আছিল ট্যালট্যালা। খাদেম আলী, পাটুরিয়া ঘাট 

যাঁরা ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিম অংশে অথবা উল্টো পথে কিংবা যমুনা সেতু হওয়ার আগে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন, তাঁরা বিষয়টি জানেন। তাঁদের অনেকেই এ খাবারের সঙ্গে অভ্যস্তও বটে।

মুরগির মাংসের ঝোল। ফার্স্টক্লাসের খাবার
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে চলাচলকারী ফেরিগুলোতে এখনো ফার্স্টক্লাস কেবিন আছে। তার ব্যবস্থা খানিক আলাদা। তবে এখন আর সেখানে খুব বেশি খাওয়াদাওয়ার চল নেই। চা বা কফি আর হালকা নাশতার ব্যবস্থা আছে।

কিন্তু সাংবাদিক রমেন বিশ্বাস জানালেন ভিন্ন কথা। বললেন, সত্তরের দশক বা তার আগে ফেরির ফার্স্টক্লাস কেবিনের খাবারদাবার ছিল ব্রিটিশ ঘরানার। পাওয়া যেত বাটার টোস্ট, অমলেট। স্মৃতি ঘেঁটে রমেন বিশ্বাস যা বললেন তার সরল অর্থ হলো, সত্তরের দশকে তাঁর ছোটবেলায় তিনি এই বাটার টোস্ট খেতে ইচ্ছে করে ফেরিতে উঠে এপার-ওপার করতেন। পাউরুটির ওপর মাখন লাগিয়ে দেওয়া হতো ছুরি দিয়ে। তার ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হতো চিনি। সেটিই বাটার টোস্ট।

এ ছাড়া পাওয়া যেত অমলেট। ডিমের সঙ্গে মরিচ-পেঁয়াজ মিশিয়ে যে মামলেট আমরা খেতে অভ্যস্ত, অমলেট তার চেয়ে খানিক আলাদা। তাতে মরিচ-পেঁয়াজ ছিল অস্পৃশ্য। এখন যে পোচ খাওয়া হয়, অমলেট ছিল তার চেয়ে খানিক কড়া করে ভাজা আর বেশ ফোলা ফোলা। কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া হতো অমলেট।

চানাচুর, বিস্কুট, চিপসসহ সবই মেলে ফেরিতেডেকের খাবার
খুব সম্ভবত এখন ফেরির সবচেয়ে মজাদার খাবার পাওয়া যায় আসলে ডেকে। ডিম সেদ্ধ, বারো ভাজা, কুলফি মালাই, আইসক্রিম, ডাবের পানি, মৌসুমি ফল, বাদাম কিংবা বুট ভাজা, বিস্কুট, চিপস, চানাচুর—কী নেই সেখানে? দশ থেকে বিশ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় সেসব। পছন্দমতো কিছু একটা কিনে ডেকের চেয়ারে বসে পদ্মা দেখতে দেখতে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া বা দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া পাড়ি দেওয়া যায়।

ফেরির বারোভাজা, স্বাদে চমৎকারহারিয়ে যাচ্ছে ফেরির খাবার
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পদ্মা নদীর মাওয়া ঘাটের ফেরি বন্ধ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বন্ধ হয়ে গেছে সে ঘাটের কোলাহল। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে এখন ১৬টি ফেরি চলাচল করে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের অপারেশন অফিসার। কিন্তু ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পদ্মার গতিপথ। তার ওপর স্থানীয় লোকজনের আছে সেতু করার দাবি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে ইতিমধ্যে কমে গেছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের যাত্রী ও যানবাহনের সংখ্যা।

এ অবস্থায় আশঙ্কা হওয়া খুব স্বাভাবিক যে শাপলা শালুক, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ মো. রুহুল আমিন, এনায়েতপুরী, শাহ আলী, খানজাহান আলী, শাহ পরান, ফেরি ঢাকা ইত্যাদি নামের ফেরিগুলো আর কত দিন চলাচল করবে পদ্মার বুকে। ধীরে ধীরে হয়তো ফেরির সংখ্যা কমতে থাকবে। সেই সঙ্গে কমতে থাকবে ফেরির খাওয়াদাওয়া। তারপর হয়তো একসময় ইতিহাসের অংশ হয়ে বইপত্রে লেখা থাকবে ফেরি আর তাতে খাওয়াদাওয়ার গল্প।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

তানভীর ইমামের বাড়ি ভেবে গুলশানের একটি বাসায় মধ্যরাতে শতাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, তছনছ

৬ জ্যান্ত হাতি নিয়ে রাশিয়ায় মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান, উচ্ছ্বসিত পুতিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত