Ajker Patrika

থাকছে না ৫৬৯০ কোটির বাজার

আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
থাকছে না ৫৬৯০ কোটির বাজার

বিশ্বজুড়ে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ নিরাপদ হলেও দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এ খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা দূরে থাক, মূলধন ফেরত পাওয়া নিয়েই দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নতুন মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা হচ্ছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে আর কোনো ক্লোজ এন্ড বা মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড বাজারে আসতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া বিদ্যমান মিউচুয়াল ফান্ডগুলো যদি বাজারদর ধরে রাখতে না পারে, তাদেরও অবসায়নের দিকে যেতে হবে। এর ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের বাজার আর থাকবে না।

সম্পদ ব্যবস্থাপকদের অনিয়ম, টাকার নয়-ছয় করা ও দুর্বল বিনিয়োগের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর প্রতি ইউনিটের দাম ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। বিনিয়োগকারীরা চাইলেও ন্যায্য দামে ইউনিট বিক্রি করতে পারেন না। এতে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, যা সার্বিকভাবে এ খাতে চরম আস্থার সংকট তৈরি করেছে। তবে অ-মেয়াদি ফান্ডে বিনিয়োগকারীরা চাইলে ফান্ড ম্যানেজারের কাছেই ইউনিট জমা বা সারেন্ডার করে টাকা তুলতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সুপারিশে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন ‘মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে। ইতিমধ্যে বিধিমালাটির খসড়া বিএসইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে মতামত আহ্বান করা হয়েছে। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত যে কেউ এর ওপর পরামর্শ, মতামত জানাতে পারবেন।

বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন বিধিমালার গেজেট হলে আগামীতে আর কোনো মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের অনুমোদন দেওয়া হবে না। উন্নত দেশগুলো ওই চর্চায় যাচ্ছে, আমরাও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেদিকে যাচ্ছি। তবে যেগুলো মেয়াদি আছে, সেগুলো মেয়াদ পর্যন্ত থাকবে।’

তবে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদ ফান্ড তুলে দিলে বাজারে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন প্রবাহ কমে যেতে পারে, যা বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। তাঁদের মতে, ফান্ড ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও স্বচ্ছতা না থাকা বড় সমস্যা। কাঠামো বাতিল নয়, বরং সুশাসন ও তদারকি জোরদার করাই হতে পারে টেকসই সমাধান।

রূপান্তর বা অবসায়নের বিধান

নতুন খসড়া বিধিমালায় বিদ্যমান মেয়াদি স্কিমগুলোর জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ বিধান। নতুন বিধিমালা গেজেট প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যে কোনো স্কিমের ইউনিটপ্রতি গড় লেনদেনমূল্য যদি ঘোষিত নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) বা ক্রয়মূল্যের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি কমে যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ফান্ডের ট্রাস্টি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আহ্বান করতে পারবে। সেখানে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে সিদ্ধান্ত হলে বিএসইসির অনুমোদন সাপেক্ষে ফান্ডটি বেমেয়াদিতে রূপান্তর বা অবসায়ন করা যাবে।

বিনিয়োগ নীতিমালা

প্রস্তাবিত বিধিমালায় ফান্ডগুলোর বিনিয়োগ ক্ষেত্রও সীমিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফান্ডের অর্থ কেবল স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ, আইপিও, রাইট শেয়ার ও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা যাবে। তালিকাচ্যুত, এসএমই বা এটিবি প্ল্যাটফর্মের শেয়ারে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ থাকবে। বিনিয়োগের পরে কোনো সিকিউরিটিজ মূল বোর্ড থেকে বাদ পড়লে ছয় মাসের মধ্যে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হবে।

কেন এমন সিদ্ধান্ত

গত এক দশকে মিউচুয়াল ফান্ড খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রায় হারিয়ে গেছে। ৫ হাজার ৬৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকার তালিকাভুক্ত ৩৭টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে মাত্র ৪টির ইউনিট দর অভিহিত মূল্য ১০ টাকার ওপরে, বাকি সব ফান্ড ৩ থেকে ৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। ২৭টি ফান্ডের রিজার্ভ ঘাটতি রয়েছে, সম্মিলিতভাবে যার পরিমাণ ৬৫৩ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ঘাটতির পরিমাণ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

ফান্ডগুলোর মধ্যে ছয়টি গত দুই বছর ধরে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে অনিয়মিত। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে নতুন করে অনিয়মিত হয়েছে আরও ১১টি। অর্থাৎ সর্বশেষ হিসাব বছরে ২০টি ফান্ডের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি সামান্য পরিমাণ মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ১৬টি সর্বশেষ হিসাব বছরে লোকসান করেছে। যে ২০টি ফান্ডের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র দুটির ইউনিটহোল্ডারদের জন্য সামান্য পরিমাণ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। বিপরীতে ১৮টির ইউনিটহোল্ডার লভ্যাংশ বঞ্চিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ফান্ডগুলোর ইউনিট দর এখন শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্যের অর্ধেকের নিচে। সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানগুলো অতীতে যেভাবে অর্থ পাচার করেছে, তা উদ্ধার না হলে এই খাতের প্রতি বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব নয়।’

নতুন কাঠামোয় স্বচ্ছতা বাড়বে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য আল-আমিন বলেন, ‘নতুন বিধিমালায় বিনিয়োগকে সীমিত করা হয়েছে কেবল “এ’’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে। সম্পদ ব্যবস্থাপক ও ট্রাস্টিদের অর্থ স্থানান্তরের সুযোগও বন্ধ হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে ভবিষ্যতে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে সহায়ক হবে।’

বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা এমন বিধান আনছি, যাতে ফান্ডগুলো নিট সম্পদমূল্যের কাছাকাছি দরে লেনদেন হয়। তবু যদি কোনো ফান্ড তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেটি বেমেয়াদি ফান্ডে রূপান্তরিত হবে অথবা অবসায়নে যাবে।’

বিএসইসির পরিচালক আরও জানান, নতুন আইনে ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান ও সম্পদ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব আলাদা করে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যাতে কেউ ফান্ডের অর্থ নিজেদের সম্পদ মনে করে অপব্যবহার করতে না পারে।

তবে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের অনুমোদন বন্ধ করে দেওয়াই সঠিক সমাধান বলে মনে করেন না বিআইসিএমের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ওয়াজিদ হাসান শাহ। তিনি বলেন, মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের একটা সুবিধা আছে। সিকিউরড ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু আমাদের এখানে এক-তৃতীয়াংশ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। কারণ, সম্পদ ব্যবস্থাপকেরা তহবিল তছরুপ করেছে, তাই আস্থা কমে গেছে। এ জন্য মেয়াদি ফান্ড একেবারে বন্ধ করে দেওয়াটা কি সমাধান? আমার সেটা মনে হয় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‎জবি ছাত্রদল নেতা জুবায়েদ হত্যার ঘটনায় তাঁর ছাত্রী সপরিবারে পুলিশ হেফাজতে

পুরান ঢাকায় বাসার সিঁড়িতে জবি ছাত্রদল নেতার রক্তাক্ত লাশ

৪৯তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১২১৯

ফরিদপুরে এ কে আজাদের গণসংযোগে হামলা, গাড়ি ভাঙচুর

ভিডিও কলে ‘বিয়ে’: দেশে ফিরে দেখেন আরেকজনের স্ত্রী, অতঃপর কারাগারে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত