Ajker Patrika

বন-চর বাগিয়ে ছাত্রলীগ নেতার মাছের ব্যবসা

রুদ্র রুহান, বরগুনা
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১: ৪১
Thumbnail image

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর-বিষখালীর তীরবর্তী বনাঞ্চল, সুন্দরবন পশ্চিমের একটি অংশ ও সাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ১২টি চর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করছেন উপজেলার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সদস্য এনামুল হোসাইন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবাধে সেখানে মাছ শিকার করেন তিনি। পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কর্মকাণ্ড ঘটলেও নেই কোনো বাধা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বড় ভাই পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলে না এলাকার কেউ।

বিষখালীর মোহনায় হরিণঘাটা বনাঞ্চল এবং বলেশ্বর নদের তীরবর্তী ধারের খাল, পদ্মা স্লুইস, সোনাতলা, রুহিতা, টেংরা, তাফালবাড়িয়া, জ্ঞানপাড়া, চরদুয়ানী—এসব বনাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেন এনামুল হোসাইন। বঙ্গোপসাগরের মোহনার লালদিয়া, বিহঙ্গদ্বীপসহ অন্তত ১২টি চর তাঁর নিয়ন্ত্রণে। গত মঙ্গলবার রুহিতা বনাঞ্চল থেকে শুরু করে বলেশ্বর নদের তীরবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। এ ছাড়া হরিণঘাটা থেকে শুরু করে চরদুয়ানী পর্যন্ত অন্তত ১০টি বনাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে খুঁটি পোতা। চরঘেরা জাল ফেলার জন্য এই খুঁটিগুলো পোতা হয়েছে। বন থেকে গাছ কেনে এসব খুঁটি বানানো হয়েছে। বিষখালী ও বলেশ্বরের মোহনায় বেহুন্দি ও ঘোপ জাল ফেলে অপেক্ষায় প্রায় ১০০ নৌকা। সব নৌকা তাঁর নিয়ন্ত্রণে।

এসব এলাকার একাধিক বাসিন্দা ও অন্তত ১০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় নিষিদ্ধ বেহুন্দি, ঘোপ ও চরঘেরায় কয়েক হাজার টন মাছের পোনা ধরা পড়ে। রাতের আঁধারে এসব মাছ বিক্রি করে দেওয়া হয় পাইকারদের কাছে।

৩০ বছর ধরে এই অঞ্চলে মাছ শিকার করেন এমন একজন জেলে জানান, এনামুলের নিয়ন্ত্রণে আছে অন্তত ২০০টি ছোট ট্রলার ও নৌকা। চরঘেরা, বেহুন্দি, চিংড়িজাল ব্যবহার করে এসব ট্রলার ও নৌকা দিয়ে মাছ ধরা হয়। এরপর সেই মাছ পাথরঘাটার রুহিতা, পদ্মা, জ্ঞানপাড়া, চরদুয়ানী, টেংরা এলাকায় রাতের আঁধারে বিক্রি হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক জেলে বলেন, এনামুল হোসাইন নিয়মিত ঘুষ দেন মৎস্য, বন বিভাগ ও নৌ পুলিশকে। সাধারণ জেলেরা কেউ এনামুলের ভয়ে মুখ খোলেন না।

এনামুলের বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘অনেক বছর ধরে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে সামুদ্রিক মাছের পোনা নিধনযজ্ঞ চললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রভাবশালী মহল জেলেদের ব্যবহার করে বনাঞ্চল ও চর দখল করে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। আমরা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার হয়নি।’

পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে বিশাল এই অঞ্চলের অবৈধ মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। বন থেকে গাছ কেটে খুঁটি পুঁতে মাছ শিকার করছে অসাধু জেলে চক্র। ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মৎস্য বিভাগের এই কর্মকর্তা।

কে এই এনামুল
এনামুল হোসাইনের বাড়ি পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের তাফালবাড়িয়া গ্রামে। রাজধানীর শ্যামলী জোনের পুলিশের এডিসি নাজমুল হোসেনের ছোট ভাই তিনি। এই প্রভাব খাটিয়েই এখন নিষিদ্ধ জাল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সরকারি জমি দখল করে মাছের ঘের তৈরি, অবৈধভাবে মাছ ধরার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, বিএফডিসির সাধারণ সম্পাদকের পদেও বসেছেন তিনি। জানা গেছে, মাছের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ শুরুর পরই ভারত থেকে কিনেছেন দুটি ট্রলিং ট্রলার। এ ছাড়া চারটি মাছের ট্রলার, দুটি বরফ মিলও রয়েছে তাঁর। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে পাথরঘাটা এলাকার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এনামুল হোসাইন বলেন, ‘জেলেরা নিজেদের মতো মাছ শিকারের পর বিক্রি করে। এতে আমার কোনো হাত নেই। আমি ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকাপয়সা রোজগার করি। এতে আমার বড় ভাই নাজমুল হোসাইনের কোনো হাত নেই।’

এনামুলের বিষয়ে জানতে তাঁর বড় ভাই এডিসি নাজমুল হোসাইনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।

পাথরঘাটার চরদুয়ানী নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ফরিদুল ইসলাম মোবাইল ফোনে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জাল জব্দ করলেই সাবেক এমপি হাচানুর রহমান রিমন ও স্থানীয় নেতা আমাদের নোটিশ করতেন, যাতে জাল জব্দ বা আটক না করি। এতে আমাদের কিছুটা চাপে থাকতে হয়েছে। এখানে বন বিভাগ ও আমরা সবাই অপারেশন করি। ওরা কজনকে ম্যানেজ করবে? ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত