Ajker Patrika

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঝালাইয়ে নজর দিল্লির

সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা
Thumbnail image

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে দুই দেশের শীর্ষ ব্যক্তিরাই সোনালি অধ্যায় বলেছেন। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া নয়াদিল্লির প্রায় সব ইচ্ছাই পূরণ করেছে ঢাকা। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণ নয়াদিল্লির জন্য বড় ধাক্কা। একই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাবও নজর এড়ায়নি দেশটির। ভারত প্রসঙ্গ এলেই ‘স্বার্থের সম্পর্কে’ ছাড় না দেওয়ার কথা বলছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ঢাকায় নতুন এই রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চান নয়াদিল্লির কর্তাব্যক্তিরা।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘আমাদের এটা মানতে হবে যে, সেখানে (ঢাকা) রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এমন পরিবর্তনে বাধা-বিপত্তিও থাকে। আর এটা পরিষ্কার, আমাদের এর মধ্যেই পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।’ তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, বাংলাদেশে সরকারে যেই থাকুক, তার সঙ্গে কাজ করবে ভারত সরকার।

নয়াদিল্লিতে সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজীব সিক্রির ‘স্ট্র্যাটেজিক কোনানড্রামস: রিশেপিং ইন্ডিয়াজ ফরেন পলিসি’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে জয়শঙ্কর এ কথা বলেন। 
পেশাদার কূটনীতিক রাজীব বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রির স্বামী।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০১০ সাল থেকে গত ১৪ বছরে চারবার ভারত সফরে যান। সর্বশেষ সফর করেন চলতি বছরের ২১-২২ জুন। এ সময়ে ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে এসেছেন তিনবার। এসব সফরে দুই দেশের সীমান্ত, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে দেশটির মূল ভূখণ্ডের সড়ক, রেল, নৌ ও সাগরপথে যোগাযোগ সহজ করা, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক চুক্তি হয়েছে।

ঢাকার স্থানীয় কূটনীতিকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে নয়াদিল্লির সরকার সব সময়ই ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় ‘ভারতের নিরাপত্তার’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে। আর বাংলাদেশ ভারতকে দেখে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে। তবে দুই দেশের মধ্যে অনেক বিষয়েই পারস্পরিক নির্ভরতা রয়েছে।

জয়শঙ্করের গতকালের মন্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পারস্পরিক স্বার্থ। এ কারণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন বাস্তবতা মেনে নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন।

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তন বুঝতেও সময় লাগে। দুই পক্ষকেই বুঝতে হবে, কোথায় দুই দিকের স্বার্থ মেলে। তাহলে এগোনো সহজ হবে। তবে তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এখন বৈদেশিক সম্পর্ক মূল বিষয় নয়, দেশের ভেতরের বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভেতরের অবস্থান গুছিয়ে নেওয়া গেলে বাইরের দিকগুলো সামাল দেওয়া যাবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যাঁরা আছেন, বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে তাঁদের একটু বুঝেশুনে কথা বলার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

শেখ হাসিনা তাঁর পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকার ইঙ্গিত দিলেও ভারত সরকারের কুশীলবেরা ওই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে চীনের হাত আছে কি না, তা খুঁজতে শুরু করেন। ভারতের বিশ্লেষকদের একটি অংশ অবশ্য সবকিছুতে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ খোঁজার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে থাকে।

বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে স্বীকৃত বিশ্লেষক সি রাজা মোহন। তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রদায়ক সম্পাদক। ১৪ আগস্ট ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় এক প্রবন্ধে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পতনে ভারত সরকার কষ্ট পেলেও এটা নিয়ে হা-হুতাশ করার কিছু নেই। কারণ, তিনি নিজের দেশের জনগণ থেকে এতই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ মিলেও তাঁর পতন ঠেকাতে পারত না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দিল্লির দরকার ঢাকার নতুন সরকারকে সহযোগিতা করা। বাংলাদেশে তরুণেরা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছেন, তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। হাসিনা ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বের যে ভিত তৈরি করে দিয়েছেন, তার ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া। 

শেখ হাসিনাকে নিয়ে কী ভাবছে দিল্লি 
দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি এখনো সেখানেই আছেন। ভারতের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে করা এক প্রতিবেদনে বিবিসি বলেছে, শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের জন্য তিনটি পথ খোলা আছে। এর একটি হলো, আপাতত তৃতীয় কোনো দেশে তাঁর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা চলছে মোদি সরকারের। দ্বিতীয় পথ হলো, তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ভারতেই থাকতে দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে ইতিমধ্যে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। নয়াদিল্লির কেউ কেউ মনে করছেন, এ অবস্থায় তিনি ভারতে থেকে গেলে ও বাংলাদেশ তাঁকে বিচার অথবা সাজা কার্যকরের জন্য ফেরত চাইলে তা নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

নয়াদিল্লির আইডিএসএর জ্যেষ্ঠ ফেলো স্মৃতি পট্টনায়ক বলেন, যে আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, তাতে একটা স্পষ্ট ভারতবিরোধী চেহারাও ছিল। এখন ভারত তাঁকে আশ্রয় দিলে তা ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দেবে।

ভারতের জন্য তৃতীয় পথটি হলো শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে সহযোগিতা করা। তবে দিল্লির বিশ্লেষকেরা বিষয়টিকে জটিল ও সময়সাপেক্ষ মনে করছেন।

ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করা সম্ভব। কিন্তু শেখ হাসিনার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়া খুব কঠিন হবে। এ কারণে দলের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত