Ajker Patrika

বেহাল বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রম, সংশোধনের সুযোগ চাইলেন এনজিও পরিচালক

আনোয়ার হোসেন, মনিরামপুর (যশোর) 
আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২২, ২০: ৫২
বেহাল বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রম, সংশোধনের সুযোগ চাইলেন এনজিও পরিচালক

যশোরের মনিরামপুরে মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) নামে ছয় মাস মেয়াদের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। দীপ শিখা নামে একটি স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে চলছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প।

অভিযোগ রয়েছে, এনজিওটির পরিচালক প্রকাশ চন্দ্রের দুর্নীতি আর উপজেলা প্রোগ্রাম কর্মকর্তার তদারকির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ শিক্ষা কার্যক্রম। বরাদ্দের টাকা লোপাট হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রকল্পের ৬৪০ জন শিক্ষকের অধিকাংশই ভাতা না পেয়ে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেন। যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন না। ভাতার আশায় যাঁরা এখনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছেন তাঁরাও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে অতটা আন্তরিক নন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও নিয়োগপত্র দিয়ে ২০২০ সালের ২৮ মার্চ দীপ শিখার প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে মনিরামপুরে শুরু হয় মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের (৬৪ জেলা) বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রম। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহযোগিতায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় এ কার্যক্রম চালু হয়। তখন ৩২০ জন পুরুষ ও ৩২০ জন নারী শিক্ষককে চার-পাঁচ দিন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে উপজেলাজুড়ে ৩২০টি স্কুল চালু করা হয়। প্রতি শিক্ষকের আওতায় ৩০ জন শিক্ষার্থীর তালিকা করা হয়। 

করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর শিক্ষা কার্যক্রম আবার শুরু হয়। শুরুতে ৩২০টি জোনে নিকটবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কক্ষে কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা রাজি না হওয়ায় বিভিন্ন বাড়িতে শুরু হয় শিক্ষাদানের কাজ।

প্রতি শিক্ষকের মাসিক ভাতা ধরা হয় ২ হাজার ৪০০ টাকা। ছয় মাসের এ প্রকল্পের কেন্দ্রগুলো দেখভালের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা সম্মানীতে ১৬ জন সুপারভাইজার নিয়োগ দেওয়া হয়। আর উপজেলাজুড়ে এ শিক্ষা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়োগ পান একজন উপজেলা প্রোগ্রাম কর্মকর্তা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অনেক এলাকাতেই কার্যক্রম নেই। ভাতা না পেয়ে অনেক শিক্ষক কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। কাগজে কলমে চার মাস স্কুল চলমান থাকলেও কোনো কোনো শিক্ষক ভাতা পেয়েছেন এক বা দুই মাসের। ভাতার আশায় স্কুল চালু রাখলেও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী নেই। সুপারভাইজারেরা ঠিকমতো সম্মানী না পাওয়ায় নিয়মিত তদারকি করছেন না। স্কুল চলছে কি না তার খোঁজ রাখেন না উপজেলা প্রোগ্রাম কর্মকর্তা আজহারুলও। 

এদিকে দীপ শিখা এনজিওর প্রধান কার্যালয় উপজেলার মশিয়াহাঁটি বাজারে। এনজিওর পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র শিক্ষকদের ভাতার শিটে স্বাক্ষর নিয়ে বেতন দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো কেন্দ্রে শিক্ষক কাজ করতে অনাগ্রহ দেখালে বিকল্প শিক্ষক নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা করেন না তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, বন্ধ কেন্দ্রগুলোর শিক্ষকদের নামে ভুয়া বিল তৈরি করে আত্মসাৎ করেছেন প্রকাশ চন্দ্র। 

মাবিয়া রহমান নামে এ প্রকল্পের এক শিক্ষক বলেন, ‘ফেদায়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের কেন্দ্রের শিক্ষক আমি। দুই-তিন মাস পড়ানোর পর বেতন পাইনি। তাই বন্ধ করে দিছি। আমার বেতন শিটে স্বাক্ষর নেছেন সুপারভাইজার। কিন্তু বেতন দেননি।’ 

গোপালপুর কেন্দ্রের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শুরু থেকে দীপ শিখা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে। ঠিকমতো শিক্ষা উপকরণ দেয় না। সুপারভাইজার খোঁজ নেয় না। ডিসেম্বরে আমাদের বেতন দেওয়ার কথা ছিল। দেয়নি। জানুয়ারি পর্যন্ত পড়াইছি। তাও বেতন পাইনি। চাপাচাপি করলে একদিন বেতন শিটে আমার স্বাক্ষর নেছেন। কিন্তু টাকা দেয়নি। তারপর আমি স্কুল বন্ধ করে দিছি।’

তবে হুমকি দিয়ে ভাতা তুলতে পেরেছেন গোপালপুর কেন্দ্রের শিক্ষক রোজিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বেতন দিচ্ছিল না। ইউএনওকে জানানোর কথা বলেছিলাম। পরে আমারে দুই মাসের বেতন দিয়েছে।’ 

নিয়োগের পর করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় স্কুল চালু হয়নি। এর মধ্যে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন হাজরাকাটির আলমগীর হোসেন। তিনি এখন অন্য একটি চাকরি করেন। 

 দীপ শিখার নথিপত্রে অনেক শিক্ষকের নাম আছে যাঁরা স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেনরঘুনাথপুর কেন্দ্রের শিক্ষক মিনু মণ্ডল বলেন, ‘চার মাস হয়ে গেছে। মাত্র এক মাসের বেতন দেছে। এক মাসের মধ্যে সুপারভাইজার আসেননি। স্কুল হয়েছে ধরে উপজেলা থেকেও কেউ আসেননি। রোজার মাসে সবাই পড়তে আসতে চান না। এখন সাত-আট জন করে আসেন।’ মিনু মণ্ডলের অভিযোগ, ‘এক মাসের বেতন দিয়ে তাঁর কাছ থেকে করের (ভ্যাট) কথা বলে ৪৮০ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে।’

তবে শিক্ষক দুই মাসের বেতন পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন উপজেলা প্রোগ্রাম কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কদিন আগে আবার বেতন শিট জমা দিয়েছি। আর বেতন থেকে কোনো টাকা কর্তনের সুযোগ নেই।’ প্রোগ্রাম কর্মকর্তার দাবি, কোনো শিক্ষক বেতন পাননি বা কোনো স্কুল বন্ধ আছে এমন তথ্য তাঁর কাছে নেই। তিনি নিয়মিত মনিটরিং করেন। 

আজ সোমবার দীপ শিখার অফিসে গিয়ে দেখা যায়, বেতন না পেয়ে স্কুল বন্ধ করে দিলেও নথিপত্রে সাইফুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেনের নাম শিক্ষকের তালিকায় রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খানপুর ইউনিয়নের সুপারভাইজার আসলাম হোসেন বলেন, ‘তাঁদের পরিবর্তে ওই কেন্দ্রে কে শিক্ষক হয়েছেন বলতে পারব না। আমি যশোরে একটা কাজে এসেছি।’

ঠিকঠাক ভাতা না দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে দীপ শিখার পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র বলেন, ‘আগামী ৭ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। সাড়ে চার মাসে এ পর্যন্ত দুই মাসের বেতন দিতে পেরেছি। সুপারভাইজারেরা বেতন শিট জমা দিলে উপজেলা প্রোগ্রাম কর্মকর্তার মাধ্যমে ইউএনওর হাত হয়ে বিলের কাগজ ঢাকায় জমা দিতে হয়।’

মাঠ পর্যায়ে নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকাশ চন্দ্র বলেন, ‘সব ত্রুটি স্বীকার করে নিচ্ছি। কোনো কথা অস্বীকার করব না। আমাকে সংশোধনের সুযোগ দেন।’

উপজেলার বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের নানা সমস্যা কথা জানালে ইউএনও সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, ‘আমি নিয়মিত শিক্ষকদের বেতন শিটে স্বাক্ষর দিচ্ছি।  গত সপ্তাহে ঝাঁপা ইউনিয়নে আমি এ সংক্রান্ত গণজমায়েত করেছি। আগামী সপ্তাহে বাকি ইউনিয়ন গুলোতে একযোগে গণজমায়েত করব।’ ইউএনও বলেন, ‘স্কুল বন্ধ বা শিক্ষকদের বেতন না পাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি আমি শক্তভাবে দেখছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লুটপাটে শেষ ৫ কোটির প্রকল্প: ইউএনও-উপজেলা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে শুনানি কাল

নির্বাচনের আগে এসআই-এএসআইদের ব্যক্তিগত তথ্য তালাশে পুলিশ

চীন–রাশিয়া থেকে ভারতকে দূরে রাখতে কয়েক দশকের মার্কিন প্রচেষ্টা ভেস্তে দিচ্ছেন ট্রাম্প: জন বোল্টন

‘হানি ট্র্যাপের’ ঘটনা ভিডিও করায় খুন হন সাংবাদিক তুহিন: পুলিশ

আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন’ দুর্নীতির প্রমাণ আছে: সাবেক সচিব

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত