Ajker Patrika

ট্রাম্পের শুল্কে ভারতের হীরা ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, চাকরি হারাতে পারে ২ লাখ কর্মী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ২৩
আহমেদাবাদের একটি হীরার দোকান। ছবি: সংগৃহীত
আহমেদাবাদের একটি হীরার দোকান। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহরের বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী কল্পেশ প্যাটেল। এ বছরের দীপাবলি তাঁর জন্য যেন ‘দীপ নিভে যাওয়ার দিন’ নিয়ে আসছে। পুরোনো হীরা কাটাই ও পলিশের ছোট্ট একটি কারখানা আছে তাঁর। কল্পেশের এই কারখানায় নেমে আসছে অন্ধকার। আর এই অন্ধকারের কারণ ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ।

৮ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা কল্পেশের এই কারখানায় এখন ৪০ জন কর্মী রয়েছে। অপরিশোধিত হীরা কেটে ও ঘষেমেজে ঝকঝকে করে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করেন তাঁরা। কল্পেশ ভাবছেন, বছরের পর বছর বহু বাধা অতিক্রম করে আসা তার এই কারখানায় ট্রাম্পের এই শুল্ক যেন ‘কফিনের শেষ পেরেকটি’ ঠুকে দেবে।

আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কল্পেশ বলতে থাকেন, ‘দীপাবলির কিছু অর্ডার বাকি আছে, সেগুলো শেষ করার চেষ্টা করব।’

আলোর উৎসব দীপাবলি ভারতের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি। প্রতিবছর অক্টোবরের শেষ দিকে আয়োজিত হয় এই উৎসবটি। এ উৎসবকে ঘিরে দেশটির বাজারে পণ্যের বিক্রি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কল্পেশ বলছিলেন, ‘এ বছর হয়তো উৎসবের আগেই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের কারণে রপ্তানিকারকেরা অর্ডার বাতিল করতে পারেন। এমনিতেই অর্ডার কমে আসায় কর্মীদের বেতন দেওয়া এবং অন্যান্য খরচ মেটানো ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।’

‘ভারতের হীরার শহর’ নামে পরিচিত সুরাটে কল্পেশসহ প্রায় ২০ হাজার ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী হীরা কাটাই ও পলিশের কাজ করেন। এখানের কারখানাগুলোতে বিশ্বের প্রতি ১৫টি প্রাকৃতিক হীরার মধ্যে ১৪টি কাটাই ও পলিশের কাজ হয়।

ভারতের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের রত্ন ও গয়না রপ্তানি উন্নয়ন কাউন্সিলের (জিজেপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (যা মার্চে শেষ হয়েছে) দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০ কোটি ডলারের কাটা ও পলিশ করা হীরা রপ্তানি করেছে। এই অঙ্ক ভারতের মোট কাটা ও পলিশ করা হীরা রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি, যা একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার।

এরই মধ্যে অর্ডার বাতিল হতে শুরু করেছে বলে জানান কলকাতার হীরা রপ্তানিকারক ডিম্পল শাহ। আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘উচ্চ শুল্কের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা পাঠানো পণ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। আমার দুই দশকের হীরা ব্যবসায় এটাই সবচেয়ে খারাপ সময়।’

যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের কারণে হিরা রপ্তানিকারকেরা অর্ডার বাতিল করতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের কারণে হিরা রপ্তানিকারকেরা অর্ডার বাতিল করতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত

গত ৭ আগস্ট থেকে ভারতের সব ধরনের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়, যা ২ এপ্রিল ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন। এরই মধ্যে ৬ আগস্ট ট্রাম্প আরও ২৫ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা দেন, ফলে মোট শুল্কহার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। তিনি জানান, এই অতিরিক্ত শুল্ক ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। ভারত রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে তাই এটি ভারতের ওপর একধরনের শাস্তি।

আর রত্নশিল্পের ওপর আগে থেকেই ২ দশমিক ১ শতাংশ শুল্ক ছিল, এখন কার্যকর শুল্কহার দাঁড়াল ৫২ দশমিক ১ শতাংশে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপকে বাণিজ্য গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল রিসার্চ ট্রেড ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)-এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব ‘দ্বিচারিতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখনো রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করছে এবং রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা চীন কোনো ধরনের শাস্তিমূলক শুল্কের মুখে পড়েনি।

অজয় বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো এবং কৃষি ও দুগ্ধ খাত উন্মুক্ত করতে অস্বীকার করায় ট্রাম্প হতাশা থেকে ভারতকে টার্গেট করছেন।’

এর মাধ্যমে তিনি চলমান বৃহত্তর বাণিজ্য আলোচনার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় অর্থনৈতিক খাতগুলোতে আরও প্রবেশাধিকার চাইছে।

তবে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন, তা ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত হীরা শিল্পকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

গুজরাটের সুরাট, আহমেদাবাদ ও রাজকোট শহরের হীরা কাটাই ও পলিশ শিল্পে ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের অনেকেরই বেতন কমে গেছে। প্রথমে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এবং পরে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের কারণে।

গুজরাট ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি রমেশ জিলরিয়া আল জাজিরাকে বলেন, ‘মহামারি আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষত হংকং ও চীনে, অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি করেছিল। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর হীরা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং জি৭–এর রাশিয়াবিরোধী নিষেধাজ্ঞাও আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’

ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ছিল অপরিশোধিত হীরার বড় উৎস।

আর্থিক সংকটে গত দুই বছরে অন্তত ৮০ জন হীরা শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি শ্রমিকদের মজুরি অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য করেছে, যা এখন গড়ে মাসপ্রতি ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার রুপি (প্রায় ১৯৪ ডলার)। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে এ আয় দিয়ে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন।’

ট্রাম্পের শুল্ক সম্পূর্ণ কার্যকর হলে গুজরাটে প্রায় দুই লাখ মানুষ জীবিকা হারাতে পারেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন রমেশ।

ইতিমধ্যেই হীরাশিল্পের সাবেক ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি কর্মী সরকারি ভাতা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। চলতি বছরের মে মাসে গুজরাট রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়, শিল্পের অস্থিরতায় চাকরি হারানোদের পরিবারকে সহায়তা দিতে প্রতি সন্তানকে ১৩ হাজার ৫০০ রুপি (প্রায় ১৫৪ ডলার) ভাতা দেওয়া হবে।

তবে সংকটের জন্য শুধু ট্রাম্পের শুল্ক, মহামারি বা যুদ্ধ দায়ী নয়, এর পাশাপাশি কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত (ল্যাব–গ্রোন) হীরা ও প্রাকৃতিক হীরার বাজারকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।

সুরাটে প্রায় ২০ হাজার ব্যবসায়ী হিরা কাটাই ও পলিশের কাজ করেন। ছবি: সংগৃহীত
সুরাটে প্রায় ২০ হাজার ব্যবসায়ী হিরা কাটাই ও পলিশের কাজ করেন। ছবি: সংগৃহীত

সুরাট জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সলিম দাগিনাওয়ালা বলেন, ‘প্রাকৃতিক হীরার মতো ল্যাব–গ্রোন হীরা খনি থেকে উত্তোলন করা হয় না, বরং বিশেষ ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়, আর এর দাম প্রাকৃতিক হীরার মাত্র ১০ শতাংশ। খালি চোখে এমনকি অভিজ্ঞ জুয়েলারদের পক্ষেও প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম হীরার পার্থক্য ধরা কঠিন। ক্রেতাদের রুচি এখন কৃত্রিম হীরার দিকে ঝুঁকছে, কারণ এগুলো সস্তা।’

জিজেপিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ১০.৮ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত হীরা আমদানি করেছে, যা ২০২৩-২৪ সালের ১৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি থেকে ২৪.২৭ শতাংশ কম।

একইভাবে কাটা ও পলিশ করা প্রাকৃতিক হীরার রপ্তানিও ১৬.৭৫ শতাংশ কমে ২০২৪-২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩.২ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের ১৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হ্রাস।

জিজেপিসির চেয়ারম্যান কীরিত বানসালি বলেন, ‘এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ভারতের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে, যা গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ চেইনকে ব্যাহত করতে পারে, রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে এবং হাজার হাজার মানুষের জীবিকা বিপন্ন করতে পারে। আমরা আশা করি শুল্কে স্বাভাবিককরণের ব্যবস্থা হবে, না হলে টিকে থাকা কঠিন হবে।’

শুল্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গয়না বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বলে সতর্ক করেন অল ইন্ডিয়া জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি ডোমেস্টিক কাউন্সিলের (জিজিসি) চেয়ারম্যান রাজেশ রোকডে। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭০ হাজার গয়না ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা গয়নার দাম বাড়লে সংকটে পড়বেন।’

এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ হীরা চাহিদা বাড়ানো এবং নতুন বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

উত্তর প্রদেশের বারাণসীর নারায়ণ দাস সরাফ জুয়েলার্সের পরিচালক রাধা কৃষ্ণ আগারওয়াল বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী হলে শুধু স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে না, পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে।’

নারায়ণ দাস আরও জানান, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ যদি ভারতের রত্নশিল্পের ‘বহির্বিশ্বনির্ভরতা’ কমিয়ে আনে, তাহলে তা ‘অপ্রত্যাশিত এক আশীর্বাদ’ হতে পারে।

জিজেপিসির চেয়ারম্যান কীরিত বানসালি বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ গয়না বাজার দ্রুত বাড়ছে এবং আগামী দুই বছরে তা বর্তমানে থাকা ৮৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, শিল্প নতুন বাজারের খোঁজে রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য।

সুরাট জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অমিত কোরাত বলেন, স্বর্ণ ইতিমধ্যে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা রপ্তানির ওপর আসা আঘাত সামলাতে সাহায্য করেছে।

তবে আপাতত ভারতের হীরা শিল্পের কোনো এমন অবস্থা নেই। এই শিল্পকে জরুরি ভিত্তিতে রক্ষা করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন সুরাটের হীরা কাটাই ও পলিশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে থাকা ব্যবসায়ী রমেশ প্যাটেল। তিনি বলেন, ‘সহায়তা না পেলে, এই ব্যবসা চিরতরে তার ঝলক হারিয়ে ফেলবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যেভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছিল, স্বীকারোক্তিতে জানালেন মেজর সাদিকের স্ত্রী জাফরিন

পুলিশের এডিসিকে ছুরি মেরে পালিয়ে গেল ছিনতাইকারী

উত্তরায় বকশীগঞ্জের সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম গ্রেপ্তার

রিটার্ন না দিলে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন

ফজলুর রহমান ও হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে: বিএনপিকে সারজিস

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত