Ajker Patrika

চাপের মুখে সংযমী বাজেট

শাহ আলম খান, ঢাকা 
আপডেট : ০১ জুন ২০২৫, ১৩: ০৯
চাপের মুখে সংযমী বাজেট

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আসছে এমন এক সময়, যখন অর্থনীতি আছে একযোগে চাপ, সংকট এবং শর্তের ঘূর্ণাবর্তে। রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না পৌঁছানো, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি যোগ হয়েছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে গৃহীত ঋণের শর্ত পূরণের চাপ। এ ছাড়া সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের চাপ তো রয়েছেই।

ফলে এবারের বাজেট শুধু বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, বরং তা সরকারের জন্য হয়ে উঠছে একটি কৌশলভিত্তিক আর্থিক দলিল—যার মূল দর্শন সংযম, কাঠামোগত সংস্কার ও স্থিতিশীলতা। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা, আইএমএফ-সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং অর্থনীতির টেকসই সংস্কারের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের জন্য একটি স্থিতিশীল ভিত্তি নির্মাণ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এটিই প্রথম এবং বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট। বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ের বাজেট ইতিহাসে এবারই প্রথম সামগ্রিক বাজেটের আকার কমতে যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার।

সংসদ বিলুপ্ত থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট কার্যকর হবে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামীকাল সোমবার এটি জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে রাজস্ব আহরণে জোর পাচ্ছে এনবিআরের সংস্কার ও কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি। অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক উৎস থেকে সহজ শর্তে অর্থায়ন সংগ্রহের চেষ্টা থাকছে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগে আস্থা ফেরানো, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে জ্বালানি খাতে দাম সমন্বয়ের প্রক্রিয়া ও ভর্তুকি পুনর্বিন্যাস থাকছে, সেই সঙ্গে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে নীতিগত কাঠামো শক্ত করা হবে। মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।

তা সত্ত্বেও নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অধীনে এই বাজেট হওয়ায় এর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকবে বলেও ধারণা বিশ্লেষকদের। যদিও ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষায়, ‘অন্তর্বর্তী সময়ে এ বাজেটটি হবে ভারসাম্য ও আস্থার রূপরেখা’—যা হবে বাস্তবভিত্তিক, বাস্তবায়নযোগ্য, সুশাসন ও বৈষম্য কমাতে সহায়ক।’

Screenshot 2025-06-01 015121

তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজেটে সম্ভাব্য ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থেকেই বোঝা যায়, বাজেট আত্মনির্ভর নয়; বরং ঋণনির্ভর এক বন্ধনীতে আবদ্ধ। যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের উৎস থেকে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য রয়েছে, যার মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন খাত থেকে কর-অব্যাহতি কমিয়ে। বাকি ৪৬ হাজার কোটি টাকা আয় করা হবে এনবিআরবহির্ভূত কর খাত থেকে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে চাইলেই অনেক কিছু পাল্টে দেওয়া যায় না। তাই আসন্ন বাজেট কাঠামোয় রাজস্ব আয়ে নতুন চাপ সৃষ্টির বিপরীতে কর বাড়াতে নতুন পদক্ষেপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোজন ছাড়া বাকি সব গতানুগতিক ধারাতেই থাকছে। কিছু খাতে করছাড় দেওয়া হলেও যেসব খাতে বাড়ানো হচ্ছে, তার সবই জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে বাড়ছে আয়কর হার, তুলে নেওয়া হচ্ছে স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট ও কর-অব্যাহতি—যা উৎপাদন খাতে চাপ বাড়াবে। বিপরীতে, শুল্কনীতির সংস্কারে ৬২৬টি পণ্যের শুল্ক হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপ মোকাবিলায় আরও ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে, যা বিদেশি পণ্যের প্রবাহ বাড়িয়ে দেশীয় শিল্পকে আরও চাপে ফেলবে। ফলে এখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে লক্ষ্যচুত করতে পারে।

অন্যদিকে সরকারি ব্যয়ে রয়েছে বিপুল দায় পরিশোধের বাধ্যবাধকতা। আগামী বাজেটে এর লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যেই সংস্কার ও শর্ত পূরণের বাস্তবতা মিলিয়ে সরকারকে শেষ পর্যন্ত ‘কঠিন বাস্তবতার কৌশলী বাজেট’ দেওয়ার পথেই হাঁটতে হচ্ছে। যেখানে অনেক কিছু থাকছে, বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে ঘষামাজার উদ্যোগ। আবার বহু কিছুই থেকে যাচ্ছে ভবিষ্যতের হাতে এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে। কেননা, দেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে এক বাজেটে সব সংস্কার বাস্তবায়ন; কিংবা অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফেরানোর বিষয়গুলো আপেক্ষিক থেকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

দেশের পরিবর্তিত বাস্তবতায় জনগণের প্রত্যাশা এখন একটি দূরদর্শী, বৈষম্যহ্রাসকারী এবং সাহসী বাজেট। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট সে প্রত্যাশার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বেসরকারি আর্থিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রস্তাবিত বাজেট কাঙ্ক্ষিত ধারা অনুসরণ করছে না। তাঁর ভাষায়, ‘বাজেট যেমন হওয়া দরকার ছিল, তা হচ্ছে না। দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ১০ শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, অথচ বাজেট আবারও পরোক্ষ করনির্ভরতার পরিচিত পথে হাঁটছে—যা একেবারেই গতানুগতিক।’

দেবপ্রিয়ের মতে, বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতি, ব্যাংক খাতের জালিয়াতি, বড় করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের মাধ্যমে বাজেটে একটি অভিনব রাজস্ব উৎস সৃষ্টি করা যেত। এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপ জনগণের আস্থা ফেরাত এবং বাজেট পেত বাস্তব পরিবর্তনের রূপরেখা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এবারের বাজেটে এমন কোনো নতুন চমক বা ভিন্নমাত্রার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে চলতি বছরের এপ্রিলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।

বাজেটে সংযমের বার্তা আরও স্পষ্ট হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণে, যা আগের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এই কাটছাঁটের মধ্যেও কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি সংকোচন করে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কম। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, অব্যবহৃত সক্ষমতা ও অকার্যকর প্রকল্প এ সংকোচনের মূল কারণ।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি আজকের পত্রিকা'কে বলেন, ‘বাজেটের আকার বড় না করে ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করাই জরুরি। রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক সহায়তার সম্ভাবনা সীমিত, ফলে বড় বাজেট মানে হবে বেশি ঋণের চাপ।’ বাস্তবতা বিবেচনায় এখন বড় বাজেটের সময় নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই করা হচ্ছে বাজেটের কল্যাণচিন্তা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা যেকোনো খাত বিবেচনায় সর্বোচ্চ। তবে এতে খাদ্যসহায়তা, নগদ ভাতা এবং বৃদ্ধ ভাতা কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করে প্রকৃত দাবিদারদের আওতায় আনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ভাতার পরিমাণ না বাড়লেও অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতা বাড়ানোই এবার মূল লক্ষ্য।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং কাঠামোগত রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় শুধু একটি দল—প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা দিল প্রেস উইং

মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন বলেই কি জামিন পেলেন না অধ্যাপক আনোয়ারা

হঠাৎ ব্যাংকের ভেতরে সবাই অচেতন

সৌদি আরবে পুরুষের ‘অবাধ্য’ হলে নারীর যে পরিণতি হয়

নাহিদের সাবেক পিএ আতিক মোর্শেদের স্ত্রী জুঁইকে দুদকে তলব

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত