Ajker Patrika

লক্ষ্য ও বাস্তবতার বড় ব্যবধান রাজস্বে

আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা 
লক্ষ্য ও বাস্তবতার বড় ব্যবধান রাজস্বে

রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরে সংস্কার হচ্ছে, আইএমএফের শর্তও এগোচ্ছে—সব মিলিয়ে সংস্কারের পরিকল্পনার তালিকাও এখন লম্বা। কাঠামো গড়ছে, নথিতে অগ্রগতি বাড়ছে, বিভিন্ন প্রকল্প চলছে। কিন্তু রাজস্ব আয়ের গতিতে তার কোনো স্পষ্ট ছাপ নেই। কাজ হচ্ছে, ফল আসছে না। ঘাটতি আগের মতোই স্থির। এত উদ্যোগের পরও মাসওয়ারি কিংবা বছরওয়ারি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জনের সে পুরোনো ধাঁচই রাজস্ব খাতকে ঠেলে দিচ্ছে।

সংস্কারের ধারাবাহিকতার ভেতর ই-রিটার্ন, ই-টিআইএন, ই-অডিট, আইভিএএস, ই-ইনভয়েস—এসব প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ ভবিষ্যৎ রাজস্ব প্রশাসনের বড় ভিত্তি হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। করদাতাদের সুবিধা নিশ্চিত করতে কলসেন্টার-অনলাইন ট্রেনিংও যুক্ত হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের বেশির ভাগই এখনো মধ্যপথে; মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব সীমিত। তাই প্রযুক্তি বাড়ছে, প্রক্রিয়া বদলাচ্ছে; কিন্তু রাজস্ব আহরণের মূল স্রোতে সেই পরিবর্তনের ধাক্কা পৌঁছায়নি। রাজস্বপ্রবাহ এখনো সেই আগের ধীর ছন্দেই আটকে রয়েছে।

বরাবরের মতো এবারও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা ধরতে পারেনি এনবিআর। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ কোটি। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। যদিও আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সে তুলনায় এ বছর প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, তবু লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ব্যবধান রয়ে গেছে বাড়তি চাপ হয়ে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং ব্যবসার গতি না বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে না। এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, অর্থনীতি অস্থিতিশীল, ব্যবসার গতি মন্থর, আমদানি-রপ্তানি প্রত্যাশামতো বাড়ছে না। ফলে কাস্টমসে শুল্ক আদায় কমছে, ভ্যাটে লিকেজ বাড়ছে, বিক্রি গোপনের প্রবণতা থামছে না। এর ওপর করব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা, সংকীর্ণ করজাল, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর পৌঁছাতে না পারা, কর প্রশাসনের দক্ষতার ঘাটতি—সব মিলিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা বারবার আটকে যাচ্ছে।

এ বাস্তবতার পাশাপাশি আরও কিছু প্রত্যক্ষ কারণও রয়েছে। সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, এনবিআরের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, বদলি, সাজামূলক ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে কর্মকর্তাদের মনঃসংযোগে প্রভাব ফেলেছে। মাঠে রাজস্ব সংগ্রহে এর প্রতিক্রিয়া পড়েছে বলেই তিনি মনে করছেন।

এনবিআরের প্রকাশিত হালনাগাদ রাজস্ব তথ্যও এ সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট—সব খাতেই ঘাটতি। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। তারপরও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চার মাসে আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ৪৮ হাজার ১৪৬ কোটি। ঘাটতি ১ হাজার ২৬৮ কোটি বা ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ভ্যাট আদায় ছিল ৩৭ হাজার ৫৬৭ কোটি। ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

আয়কর খাতে রাজস্ব এসেছে ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি। লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ৪৩ কোটি। ঘাটতি ৯ হাজার ১৯৪ কোটি বা ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে আদায় ছিল ৩২ হাজার ৫৯৭ কোটি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ।

কাস্টমস বা শুল্কে আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৫১ কোটি। লক্ষ্য ছিল ৪১ হাজার ৫০৭ কোটি। ঘাটতি ৬ হাজার ৭৫৬ কোটি বা ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে আদায় ছিল ৩৩ হাজার ২৪৩ কোটি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের শেষ দিকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়বে, যেমনটি আগেও হয়েছে। করজাল বাড়ানো, কর ফাঁকি রোধ, বকেয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারে তৎপরতা—এসবে তাঁরা জোর দিচ্ছেন।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। পরে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার কোটি। লক্ষ্য পূরণে বাকি আট মাসে আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫২২ কোটি টাকা, যা বাস্তবতার সঙ্গে তুললে কঠিন লক্ষ্যই দাঁড়ায়।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ মনে করেন, রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল। তাঁর ভাষায়, ‘এনবিআরের সক্ষমতার বাইরে লক্ষ্য দেওয়া হয়, এখানেই সমস্যার শুরু।’ অর্থাৎ সংস্কার, কাঠামো, নীতির পরিবর্তন—সবই প্রয়োজনীয়; কিন্তু লক্ষ্য ও বাস্তবতার ব্যবধান না কমালে রাজস্বপ্রবাহের গতি বাড়ানো কঠিনই থেকে যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ