Ajker Patrika

ডলার নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
ডলার নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড

ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরওয়ার্ড রেট) নির্ধারণ করার মতো নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের বাজারে বিদ্যমান অস্থিরতার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত ডলার-সংকট আরও উসকে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গের চেয়ে বেশি কর্মী বিদেশ যাওয়ার পরও সে অনুপাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি। আমদানিতে লাগাম টেনেও বাড়ানো যাচ্ছে না ডলারের মজুত। এ অবস্থায় ডলার সাশ্রয়ে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে প্রথমবারের মতো আগাম দর ঠিক করে দেওয়ার বিষয়টি একেবারেই অভিনব।

গত রোববার রাতে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের ভবিষ্যৎ দাম নির্ধারণে নতুন এই নিয়ম চালু করে। এ জন্য মাসিক স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহারের ভিত্তিতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ দর। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, স্মার্ট হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ যোগ করে যে সুদহার হবে, তা ডলারের বিদ্যমান বাজারদরের সঙ্গে যোগ করা যাবে।

বিদ্যমান সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কোন বিবেচনায় এমন বুমেরাং সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে  চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডলারের রেট বাজারভিত্তিক করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু প্রথমবারের মতো ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরওয়ার্ড রেট) নির্ধারণ করাটা এই নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি ডলারের জোগান ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান আরও প্রকট করবে। এ ধরনের নীতি বিশ্ববাজারে রয়েছে বলে আমার জানা নেই।’

স্মার্ট রেটের ভিত্তিতে ডলারের ভবিষ্যৎ দাম নির্ধারণ বর্তমানে মাসের শুরুতে সুদের স্মার্ট হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি সেপ্টেম্বরে স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। আগের মাসেও তা-ই ছিল। এর সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করলে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই মাসে এক বছরের জন্য ডলারের বুকিং চুক্তি হলে বিদ্যমান দরের সঙ্গে বার্ষিক সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ সুদ যোগ হবে।

গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার দর ছিল ১১০ টাকা। সে হিসাবে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ সুদ যোগ করে প্রতি ডলারের জন্য ১২৩ টাকা ৩৫ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। দুই বছরের জন্য বুকিং হলে তার সঙ্গে আরও ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ সুদ যোগ হবে। আর ছয় মাস বা আর মাসভিত্তিক দাম হলে এই সুদহারকে সেভাবে ভাগ করে আরোপ করতে হবে।

ডলার ক্রয় ও বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ দাম নির্ধারণ করা যায়। কোনো আমদানিকারক এখনই ডলার কিনে এক বছরের মধ্যে পণ্য আমদানি করতে পারেন। এ জন্য তাঁকে বর্তমান ডলারের সঙ্গে ব্যাংককে বাড়তি কমিশন দিতে হয়। ওই সময়ে দাম কমে গেলেও আমদানিকারককে বর্তমান দাম দিতে হবে। আবার দাম বেড়ে গেলে তিনি সুবিধা পাবেন।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, আগাম দাম ঠিক করে দেওয়ায় ভবিষ্যতে ডলারের দর বাড়ছে—এ ধরনের একটি নিশ্চিত বার্তা পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। এতে করে  হাতে ডলার ধরে রেখে বেশি দরে বিক্রির মানসিকতা তৈরি হতে পারে মানুষের মধ্যে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও ডলার থাকলেও সংকট দেখিয়ে এখন থেকেই দর বাড়ানোর সুযোগ খুঁজতে পারে। প্রবাসী কর্মীরা সামনে ডলারের দর বাড়ছে, এটা ধরে নিয়ে এখন রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতে পাঠানোর মনস্থির করতে পারেন।

পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত নীতিমালা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ কোনোভাবেই কাজ করছে না। ডলার-সংকট নিয়ন্ত্রণে মূল বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। তবে নির্বাচনের ৩-৪ মাস আগে শক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্ভব না। নির্বাচনের পরে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ডলার বেসামাল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের সিইও সেলিম আর এফ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডলারের সংকট দূরীকরণে এবিবি ও বাফেদা বাজারভিত্তিক দর নির্ধারণে কাজ করছে। যাতে কেউ বেশি দামে ডলার লেনদেন না করে। ফলে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

ভবিষ্যতের ডলার বুকিং দেওয়াটা বাজারের জন্য ভালো হবে দাবি করলেও তার সপক্ষে কিছু বলতে আগ্রহ দেখাননি তিনি। আবার বাড়ল দাম বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং এবিবি ডলারের দর বাজারমুখী করতে আনুষ্ঠানিক দফায় দফায় দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু সেই দামে ডলার মিলছে না ব্যাংকে। গতকাল সোমবার ব্যাংকগুলো সব ক্ষেত্রেই ৫০ পয়সা করে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। এখন থেকে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা আর আমদানিতে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর আগে গত ৩১ আগস্ট ডলারের নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা, আমদানির জন্য নির্ধারণ করা হয় ১১০ টাকা।

এদিকে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি ডলার ১১৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। অতিরিক্ত দামে ডলার বিক্রির দায়ে এরইমধ্যে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে শাস্তির জন্য চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ৭টি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল করা হয়ছে।

অপর দিকে গত রোববার রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, মালিবাগ ও কাকরাইল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খোলাবাজারে ডলারের ঘোষিত কেনা-বেচা দর ছিল যথাক্রমে ১১১ টাকা ৪০ পয়সা এবং ১১২ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু দোকানের আড়ালে প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা। মতিঝিলে ডলার কিনতে আসা আরফিনা জানান, ‘২৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে যাওয়ার ফ্লাইট। হাতখরচের জন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারিনি। বাধ্য হয়ে মানি চেঞ্জার থেকে গোপনীয়তার সঙ্গে ১১৯ টাকা দরে ৩০০ ডলার কিনেছি।’

মানি চেঞ্জারর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব সেখ হেলাল সিকদার বলেন, ‘বাজারে লেনদেন নেই বললেই চলে। ডলার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অবৈধ ডলার ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। তারপরও অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে ডলার লেনদেন করছেন।

অবৈধভাবে ডলার মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স। তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বেশি দামে ডলারর বিক্রির দায়ে মতিঝিলের পাইওনিয়র মানি চেঞ্জার্সসহ অন্তত তিনটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর আগে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়।

সম্প্রতি দেশের পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে গভর্নর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে ডলার বাজার বা বিদেশি মুদ্রার বাজার সম্পর্কে নীতিগত কোনো পরিবর্তন আনবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন যেভাবে ডলার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে, সেভাবেই চলতে থাকবে।

তবে সময়ে সময়ে ডলারের দামে যেভাবে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সেই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। ডলারের মজুত বাড়াতে গত রোববার রপ্তানিকারকদের হাতে ডলার রাখার সুযোগ সীমিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ডলারের জন্য মরিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন স্থিতিশীল কোনো অবস্থা তৈরি করতে পারছে না, ঠিক একই দিনে ডলারের আগাম দর ঘোষণা করল; যাকে বিশ্লেষকেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের অস্থিরতাকেই ইঙ্গিত করছেন।

র‍েমিট্যান্সে টান 
ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম ২২ দিনে ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে বেশি আগ্রহী হওয়ায় আনুষ্ঠানিক বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সেপ্টেম্বর শেষে রেমিট্যান্সের অঙ্ক দাঁড়াবে ১৪৪ কোটি ডলার, যা আগের মাসের চেয়ে ১৬ কোটি ডলার কম। আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার, যা ছিল আগের ছয় মাসে সর্বনিম্ন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত