Ajker Patrika

সেই দুঃসহ রাত

শেখ ফজলুল করিম সেলিম
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২১, ১১: ৫৬
Thumbnail image

১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এ দিনটিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের। সেই কালরাত্রিতে আরও হত্যা করা হয়েছিল বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা অগ্রজ শেখ ফজলুল হক মণি ও আমার অন্তঃসত্ত্বা ভাবি শামসুন্নাহার আরজু মণিকে। মণি ভাই ও ভাবিকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমিও তাঁদের পাশে ছিলাম। ঘাতকদের ব্রাশফায়ারে বুলেটবিদ্ধ মণি ভাই ও ভাবির দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। আমি তাঁদের মাঝে লুটিয়ে পড়ি–দেহের জামা-কাপড় রক্তে ভিজে যায়। স্বজন হারানোর সেই হৃদয় বিদারক মর্মান্তিক মুহূর্তের নৃশংস ঘটনার সময় আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দুঃসহ স্মৃতি এত বছর পরও চোখের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে।

দুঃখজাগানিয়া আগস্টের সেই কালরাতে মণি ভাই ও ভাবিকে হত্যার একটি চাক্ষুস বিবরণ জাতির কাছে পেশ করার জন্য ঐতিহাসিক দায়েই আজ আমি কলম ধরেছি। এই বিবরণ চোখে যা দেখেছি, যা ঘটেছে, তাই লিপিবদ্ধ করলাম।

১৩ নম্বর সড়কস্থ ধানমন্ডির একটি বাড়ি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মণি ভাই এ বাড়িতে ছিলেন। দোতলা বাড়ির সামনে একচিলতে উঠোন। ১৫ আগস্টের আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই বাড়ি লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন জেলার নেতারা জড়ো হয়েছেন মণি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মণি ভাই তখন বাকশাল সেক্রেটারি। আমি এই দিন বিভিন্ন কাজকর্ম শেষ করে রাত ১১টার দিকে বাড়িতে ফিরি, তখন মণি ভাই ছিলেন না। তাঁর জন্য অপেক্ষমাণ দূরদূরান্ত থেকে আগত নেতারা ও কর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। মণি ভাই তখন অফিসেও ছিলেন না। রাত সাড়ে ১১টায় মণি ভাইয়ের গাড়ি এল। কিন্তু তিনি এলেন না। ড্রাইভার রহমান বলল, মণি ভাই ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নেমে গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার মা, বঙ্গবন্ধুর বুজি, তাঁকে সকালেই বঙ্গবন্ধু বাড়িতে নিয়ে গেছেন নিজ গাড়ি পাঠিয়ে। তিনি তখনো ফেরেননি।

রাত সাড়ে ১২টায় মাকে নিয়ে মণি ভাই এলেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাঁর বেড রুমে দুজনে অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন। তখন ওখানে অন্য কেউ ছিলেন না।

মণি ভাই মাকে সঙ্গে নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলেন, তখন আমি লনে। গাড়ি থেকে নেমে মা দোতলায় গেলেন। মণি ভাই ড্রইং রুমে গেলেন। সেখানে তিনি অপেক্ষমাণ নেতাদের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বললেন। মণি ভাই তখন সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ও অবসন্ন। কিন্তু চোখে আত্মপ্রত্যয়ের দৃষ্টি। সমবেত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে বললেন, `কাল কথা বলব। বঙ্গবন্ধু আগামীকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় যাবেন। ওখানে আমাকেও যেতে হবে।’এর পরই সবাই চলে গেলেন। পৌনে একটার দিকে মণি ভাই খেতে বসলেন মা ও ভাবিকে নিয়ে। খাওয়া-দাওয়ার পর আত্মজ পরশ-তাপসের ঘুমন্ত চোখে তাকিয়ে বেড রুমে ঢুকলেন। আমি তখন পাশের বেড রুমে ঘুমাতে গেলাম। মণি ভাই মিনিট তিনেক বাদে বেড রুম থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরি রুমে ঢুকে বইপত্র ঘাঁটলেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে বইপড়া আর সকালে উঠে জাতীয় দৈনিকগুলো পাঠ করা মণি ভাইয়ের নিত্যদিনের রুটিন। লাইব্রেরি রুম থেকে একটি বই বেছে নিয়ে বেড রুমে এলেন।

ভোর ৫টা। ঘুম থেকে উঠে পড়লেন মণি ভাই। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। নিচে নেমে এলেন দৈনিক কাগজগুলোর ওপর চোখ বুলানোর জন্য। হঠাৎ চোখ পড়ল বাইরের গেট, ২০-২৫ গজ দূরে একটি আর্মির গাড়ি। কাকডাকা ভোরের আলো-আঁধারিতে কালো ইউনিফর্ম পরা আর্মির ল্যান্সার ফোর্সের এই দলটিকে দেখামাত্রই মণি ভাই আবার ত্বরিত গতিতে ওপরে উঠে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় চিন্তিত তাঁর মুখাবয়ব। কিন্তু একেবারেই বিচলিত হলেন না। ওই সময় আমার স্ত্রী ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য ঘুম থেকে উঠেছে। মণি ভাইয়ের চিন্তিত অবয়ব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মণি ভাই, কী হয়েছে?’ মণি ভাই কোনো কথা বলেন না। তার চোয়াল শক্ত হলো। বেডরুমে ঢুকে ফোন করলেন। আকাঙ্ক্ষিত নম্বরে ডায়াল করে এনগেইজড টোন পেলেন। খুব সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকেই ফোন করেছিলেন। এরপর ফের টেলিফোন রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তর নেই। এই সময় ফোন বেজে উঠল। মণি ভাই ধরলেন। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘সেরনিয়াবাত সাহেবের বাড়ি আক্রান্ত। ফোন রাখো আমি দেখছি।’ মণি ভাই ফোন ছেড়ে দিলেন। ঠিক এ সময়ে সেনাবাহিনীর ছয়-সাতজন লোক ভারী বুটের শব্দে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে চিৎকার শুরু করল; মণি সাহেব কোথায়, উনি আছেন? মণি ভাই দ্রুত বেড রুম থেকে বেরিয়ে এসে আগন্তুকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, ‘এই আমি, কী হয়েছে? তেজি ও ভারী কণ্ঠের আওয়াজে আগন্তুকেরা ইতস্তত। মণি ভাই আবার বললেন, ‘কী হয়েছে বলুন।’ ওদের ভেতর থেকে একজন বলল, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ তখন উদ্বেগ ক্ষোভে জ্বলে উঠলেন মণি ভাই। বললেন, ‘হোয়াই, কী অন্যায় করেছি আমি? মণি ভাইয়ের এই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ক্ষিপ্ত হয়ে একজন সঙিন উঁচিয়ে মণি ভাইয়ের মাথায় আঘাত করল, চুলের মুঠি জাপটে ধরল। ওদের একজন বলল, ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে, অ্যাগেইন রিপিট ইট, ইউ আর নাউ আন্ডার অ্যারেস্ট।’
মণি ভাই বললেন, ঠিক আছে, আসছি। এ কথা বলে একটু ঘুরে ঠিক যে মুহূর্তে তিনি জামা-কাপড় পাল্টানোর জন্য তাঁর রুমের দিকে যেতে উদ্যত হয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ২-৩ গজ দূর থেকে শুরু হলো ব্রাশফায়ার, আমরা সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি।

মণি ভাই ও ভাবির গায়ে বুলেট বিদ্ধ হয়। আমার গায়ে গুলি লাগেনি। রক্ত ধারায় মেঝে লাল হয়ে যায়। আমার স্ত্রীর গায়েও গুলি লাগেনি। মণি ভাই ও ভাবির রক্তে আমার জামা-কাপড় রঞ্জিত হলো; ওরা দ্রুত নিচে নামতে থাকে, আমার মা এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করেন। তখন ওপরে উঠে ওরা আবার আমাদের লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করল। এবারও আমার গায়ে গুলি লাগল না। আমার স্ত্রী দরজার আড়ালে ছিল। এরপর তাড়াহুড়ো করে আগন্তুক খুনিরা নিচে নেমে যায়। গুলির শব্দে পরশ-তাপস চিৎকার করে ওঠে। আমার স্ত্রী দৌড়ে ওদের কাছে ছুটে যায়। ওদের জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাবা, চিৎকার করে না, লক্ষ্মীটি চিৎকার করে না।’ ওরাও তখন কিছু বুঝল না। চাচির বুকের পর পড়ে ডুকরে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। একই সঙ্গে মাও চিৎকার করে তাঁর রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর মা অজ্ঞান হয়ে ওই রক্তের ওপর লুটিয়ে পড়েন। ঘাতকরা চলে যাওয়ার সময় বাড়ির চারপাশে ঘিরে ফেলে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছিল। আমরা তখন মৃত্যুর মুখোমুখি। ওদের গুলির ঝাঁকে সারা বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। খুনিরা অতঃপর চলে গেল। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার বৃদ্ধ পিতা শেখ নুরুল হক ঘর থেকে বের হয়ে এসে এই করুণ অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কিছুক্ষণ তিনি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে থাকেন। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মণিকে কারা মারল?’ আমি বললাম আর্মি। এ কথা শুনে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’ আমি বললাম, জানি না। তখন তিনি নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টিতে মণি ভাইয়ের লুটিয়ে পড়া দেহের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেখ মণিরক্তাক্ত দেহ নিয়ে মেঝে থেকে উঠে মণি ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মণি ভাই নিথর, নিস্পন্দ। ভাবির দিকে চোখ ফেরালাম। তাঁর ঠোঁট নড়ছে। যন্ত্রণার আর্তিতে বলে উঠলেন, ‘আমার পেট ছিঁড়ে ফুঁড়ে গেছে। পেটিকোটের বাঁধন একটু হালকা করে দিন।’ আমার স্ত্রী কোমরের বাঁধন আলগা করে দেয়। তিনি বললেন, ‘সেলিম ভাই আমাকে বাঁচান, আমার দুটো বাচ্চা আছে।’ পরশ-তাপস তখন চাচির বুক থেকে নেমে মা-বাবার দেহের কাছে ছুটে যায়। ওরা মা-বাবার মুখের কাছে মুখ রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল, ‘মা, কথা বলো, বাবা কথা বলো।’ তখন ভাবি বলেন, সেলিম ভাই আমার পরশ-তাপসকে দেখেন। নিচ থেকে ছোট ভাই মারুফ ওপরে উঠে এল। তার চোখ পাথরের মতো অনড়। আমি তাড়াতাড়ি ৩২ নম্বরে ফোন করলাম। কিন্তু লাইন পেলাম না। মারুফ চেষ্টা করে ফোনে শেখ জামালকে পেল। ওরা দুজন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। মারুফ জামালকে জানাল, মণি ভাইকে মেরে ফেলেছে, ভাবি আহত। তখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ভেসে আসে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার মণিকেও মেরে ফেলেছে। জামালের উদ্ভ্রান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল; ‘দোস্ত রাখ। আমাদের বাড়িতেও গুলি হচ্ছে।’ মারুফ ফোন রেখে দেয়। তখনো বুঝতে পারিনি কী ঘটছে? আমি মারুফ ও শাহাবুদ্দিন মণি ভাই ও ভাবিকে নিয়ে পিজিতে ছুটলাম। আমার গাড়িতে ছিলেন ভাবি। মারুফের গাড়িতে মণি ভাই। পথে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর দেখা পেয়ে মারুফ তাঁকে গাড়িতে তুলে নেয়। পিজির সামনেই দেখলাম আর্মি পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশ বেতারের সামনেও আর্মি। ওদিকে যাওয়া মুশকিল। গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে হর্নের শব্দ শুনলাম। ওই গাড়িতে ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের লাশ। ওই গাড়িতেই ছিলেন রমনা থানার ওসি মি. আনোয়ার। তিনিও জানতেন না কী ঘটছে। মণি ভাইকে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দেওয়া হলো। ভাবিকে নিয়ে যাওয়া হলো অন্য ওয়ার্ডে, ইমারজেন্সির বারান্দায় সেরনিয়াবাত সাহেবের ১১ বছরের গুলিবিদ্ধ কন্যা বেবী একটু একটু করে নড়ছে। ডাক্তারকে বললাম, একটু দেখুন। কিছু সময় পর সে আর বাঁচেনি। এই কিশোরীটিরও আমার চোখের সামনেই মৃত্যু হলো। আমি মণি ভাইয়ের কাছে ছুটে গেলাম। ডাক্তার বললেন, ‘উনি অপনার কে হন?’ আমার ভাই।

‘দুঃখিত, অনেক চেষ্টা করেছি। বাঁচাতে পারলাম না। মণি ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে মুহূর্তে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আবার ছুটে গেলাম ভাবির কী অবস্থা দেখতে। ধারণা ছিল ভাবি হয়তো বেঁচে যাবেন। কিন্তু তিনিও এই সুন্দর পৃথীবিতে অসুন্দরের হাতে মৃত্যুবরণ করে পরপারে চলে গেলেন। মণি ভাইয়ের বুকে, গলায় ও থুতনিতে তিনটি গুলির চিহ্ন ছিল। আর ভাবির পেট ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। তখনই বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে মেডিকেল কলেজে বুলেটবিদ্ধ কয়েকজন আহত লোক এল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের লোক আলতাফ ছিল। সে মারুফকে বলল, ভাই সাহেবকে, কামাল ভাইকে–সবাইকে মেরে ফেলেছে। এ খবর মারুফ আমাকে বলার পর তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারি। এর কিছুক্ষণ পরেই হাসপাতাল আর্মি ঘেরাও করল। আমি বাসায় ফোন করে স্ত্রীকে বললাম, তোমরা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়। পাশের বাসায় চলে যাও। ফোন করেই আমি, মারুফ ও শাহাবুদ্দিন হাসপাতালের তৃতীয় তলায় চলে গেলাম। তখন বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কোনো চেনা মুখ দেখা গেল না। কিছু সাধারণ মানুষ চিৎকার করে বলছেন, ‘লাশ দিন, আমরা মিছিল করব।’ পরে অবশ্য খুনিদের অস্ত্রের দাপটে মুহূর্তের মধ্যে এলাকাটি জনশূন্য হয়ে যায়। তখন হাসপাতালে থাকা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আমাদের গায়ের জামা-কাপড়ে মণি ভাই ও ভাবির দেহের রক্তের চিহ্ন। এভাবে বের হওয়া মুশকিল বিধায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম মনিরুল হক, নিউরোসার্জন ডা. কনক ও আরও কয়েকজন ডাক্তার খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের বের করে দেন। রক্তাক্ত জামা-কাপড়গুলো খুলে ফেলে তাঁদের জামা-কাপড় পরেই বের হয়েছিলাম।

বাড়িতে ফিরে দেখি বাড়ির লোকজন কেউই সরে যায়নি। আমরা তখন আরও উদ্বিগ্ন। আমাদের দেখেই পরশ ও তাপস কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওরা বলল, ‘চাচা, আমাদের মা-বাবা কোথায়? মা-বাবার কাছে আমাদের নিয়ে যাও, মা-বাবাকে আমাদের কাছে এনে দাও।’ পরশের বয়স তখন পাঁচ। তাপসের বয়স সাড়ে তিন। এই অবোধ শিশু দুটির কথার জবাব সেদিন দিতে পারিনি। বুক থেকে একটি ভারী বাতাস কণ্ঠ অবধি এসে আটকা পড়েছিল।

কাছের মানুষদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানআবার শুনলাম সেই একই চিৎকার, ‘মণি সাহেব আছে?’ সামরিক উর্দিপরা জিপ গাড়িতে একদল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপ আমাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি জবাব দিলাম, তিনি হাসপাতালে। তাঁদের একজন বললেন, ‘ছোটাছুটি করবেন না। আমরা দেখছি।’ তাঁরা চলে গেলেন।

তখন আমরা পাশের একটি বাড়িতে চলে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম আরেকটি সামরিক গাড়ি। কিছু আর্মি আমাদের বাসায় ঢুকে সোনার গয়নাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করতেও বাকি রাখল না। সেই কালরাত্রির রক্তবন্যার নীরব সাক্ষী হয়ে আজকের স্মৃতি রোমন্থন বড়ই কষ্টকর। সেই ভয়াল নৃশংস মুহূর্তের বিবরণ দিতে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের বেদনা শুরু হয়।

তবু লিখলাম ভাবী বংশধরদের জন্য। ১৫ আগস্টের কালরাতে হারিয়েছি অনেক আত্মার আত্মীয় ও রক্তের সম্পর্কে গড়া মানুষকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার মামি বেগম মুজিব, ছোট মামা শেখ আবু নাসের, মামাতো ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ও কামাল-জামালের নবপরিণীতা বধূদ্বয় সুলতানা ও রোজী, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা এবং আমার ভাবি শামসুন্নাহার আরজু মণি, সেরনিয়াবাত সাহেবের ১১ বছরের কন্যা বেবী, ১০ বছরের পুত্র আরিফ, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত সাহেবের নাতনি বাবু ও আত্মীয় রেন্টু এবং আমার বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মণিকে। আরও হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাপ্রহরী কর্নেল জামিলকে। তিনি ৩২ নম্বর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে বাধা দিতে গিয়ে শহীদ হন। এতগুলো মৃত্যু, এতগুলো স্বজন হননের রক্তের বন্যায় আজ আপন সত্তা ও বিবেক ঘৃণার অনলে জ্বলে ওঠে। অশ্রু সে তো কবেই শুকিয়ে গিয়ে মরু হয়ে গেছে। তবু প্রশ্ন থাকে। বিবেক ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল যেকোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা সরকার কী করে এত বড় একটা অন্যায় মেনে নিতে পারেন!

মণি ভাইয়ের সেই মৃত্যুকালীন জিজ্ঞাসা–‘কী অন্যায় করেছি আমি’ এখনো আমার কানে বাজে। কানে বাজে ভাবির সেই শেষ আর্তনাদ–‘আমাকে বাঁচান, আমার দুটো বাচ্চা আছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত