Ajker Patrika

নগরীতে বাড়ছে রোগবালাই

নাজমুল হাসান সাগর ও শাকিলা ববি, সিলেট থেকে
Thumbnail image

সিলেট নগরীর অভিজাত এলাকা হিসেবেই পরিচিত উপশহর। তারই একটা অংশ পশ্চিম তেররতন। অন্য এলাকার পানি কোমর থেকে নেমে হাঁটুতে এলেও এই এলাকায় এখনো পানি হাঁটুর ওপরেই আছে। এক সপ্তাহ ধরে জমে থাকা এসব পানিতে ময়লা-আবর্জনা পচে তীব্র দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। এই গন্ধ এতটাই তীব্র যে নাকেমুখে কাপড় না দিয়ে কথা বলতে গেলেই যেন নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায়।

তীব্র গন্ধের মধ্যেই তেররতন সি-ব্লক এলাকায় কথা হয় রেখা বেগম নামের এক নারীর সঙ্গে। ডুবে যাওয়া ভাড়ার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো এই নারী। ঠিকঠাক ত্রাণ পাচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রেখা বললেন, ত্রাণ না পেলে খাওয়া বন্ধ। কিন্তু এখন সব থেকে বড় সমস্যা হলো শরীর আর পায়ের চুলকানি। সাত-আট দিন থেকে এমন পচা পানিতে হাঁটাচলা করে শরীরে চুলকানি হয়েছে। পায়ের নখের চিপায় চিপায় ঘা। এভাবে আর কয়েক দিন গেলে পচন ধরবে।

রেখার সঙ্গে কথা শেষ না হতেই এগিয়ে এলেন আলেয়া খাতুন। মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা এই নারী গত দুই দিন পেটের অসুখে ভুগছেন। গত শনিবার সারা দিন পেটের ব্যথা থাকলেও গতকাল রোববার সকাল থেকে কয়েকবার পাতলা পায়খানা হয়েছে তাঁর ৷ আলেয়া জানালেন, ওষুধ আর স্যালাইন কিনে খাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও তাঁর নেই। অনেক সময় ত্রাণের সঙ্গে স্যালাইন দেয়। আজ এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণও দিতে আসেনি তাই স্যালাইন বা ওষুধও পাওয়া হয়নি তাঁর।

তিন দিন থেকে সর্দিজ্বরে আক্রান্ত শিশু সুমাইয়া আক্তার। তার বাবা আনিস হোসেন বলেন, ‘মেয়েটা জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত ৷ ওষুধ খাওয়ালাম তারপরেও ভালো হচ্ছে না।’ আনিসের কথা শেষ না হতেই সুমাইয়ার মা বলে উঠলেন, ‘দুইটা নাপা আর একটা গ্যাসের ট্যাবলেটে জ্বর যাবে কীভাবে?’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে একই এলাকায় পাশাপাশি কয়েক পরিবারের অন্তত পাঁচজন শিশু সর্দিজ্বরে আক্রান্ত।

উপশহর এলাকার সব থেকে বড় ওষুধের দোকান হোসাইন ফার্মেসি। এই ফার্মেসির তত্ত্বাবধায়ক মো. আশরাফ হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, দিনে অন্তত তাঁর ফার্মেসি থেকে পাঁচজন ডায়রিয়া ও পাতলা পায়খানার ওষুধ নিচ্ছে গত দুই দিন।

আশরাফের ভাষ্যমতে, এলাকার ৬০ ভাগ মানুষ এখন আর এখানে থাকে না। বাকি যারা আছে তাদের মধ্যে যদি দিনে অন্তত পাঁচজন এ ধরনের রোগের ওষুধ নিয়ে থাকে, ‘তাহলে বুঝুন, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে যাচ্ছে।’

বন্যার কারণে সিলেটে রাস্তাঘাট, শস্য ও মৎস্যসম্পদের সঙ্গে রোগব্যাধিও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জেলায় ১১৬ জন ডায়রিয়ার রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বন্যা-পরবর্তী রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা না গেলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের।

বন্যা উপদ্রুত এলাকায় রোগীর সংখ্যা এখন কম মনে হলেও কিছুদিন পরই ভয়াবহ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শুরু থেকেই সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, প্যারা টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও ফুড পয়জনিংয়ের মতো অসুখগুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে সিলেটে। যদি বন্যা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা না করা যায়, এই রোগ প্রাদুর্ভাব ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকলে এটা মোকাবিলা করা মুশকিল হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

শুরু থেকেই বন্যার্তদের মাঝে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছেন মানবিক টিম সিলেটের প্রধান সমন্বয়ক নায়েক সফি আহমেদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বন্যার শুরু থেকেই আমরা শুকনো খাবার, পানি, সাবান, স্যালাইন বিতরণ করছি দুর্গত এলাকায়। প্লাবিত এলাকাগুলোতে ঘরে ঘরে মানুষকে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে দেখছি। ডায়রিয়া, চুলকানির পাশাপাশি অনেক মানুষ জ্বরসর্দিতে আক্রান্ত হয়েছে। অনেক ভয়াবহ অবস্থা বন্যাকবলিত এলাকার। গতকালও আমরা সদর উপজেলার খাসেরগাঁও, পুরান কালারুকা, দাবাদাগাঁওয়ের ১০০ পরিবারের মধ্যে ওষুধসামগ্রী বিতরণ করেছি।’ 
পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়েছেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এ ধরনের রোগী খুব কম এখনো। এটার আসল চিত্রটা পাওয়া যাবে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ৷ তবে আরও কিছুদিন পরে বন্যা-পরবর্তী পানিবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা বাড়বে। সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতিও রয়েছে।’ 
বন্যা-পরবর্তী পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. এস এম শাহারিয়ার বলেন, ‘সম্পূর্ণ সিলেট জেলায় ১৪০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। যার মধ্যে সিলেট শহরে আছে ৩টি। নদীর তীরবর্তী হওয়ায় কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তা, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ এলাকার অবস্থা খারাপ। পানিবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানিবিশুদ্ধকর ট্যাবলেট, স্যালাইনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ আমাদের মজুত আছে।’

পানি কমছে: সিলেটে ইতিমধ্যে প্লাবিত সব এলাকা থেকেই পানি নামতে শুরু করেছে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে পানি নামতে শুরু করলেও সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে কুশিয়ারার পানি বাড়ায় বাঁধ ভেঙে ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ নতুন করে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলছেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আর খুব একটা অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বেশির ভাগ এলাকা থেকেই পানি নেমে যাবে।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, কানাইঘাট ও সিলেট পয়েন্টে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। অমলসিদ ও শিউলা পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য পাঁচটি পয়েন্টে লুবা, সারি, ধলা আর সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি ছিল বিপৎসীমার নিচে।

কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়া পাহাড়ি ঢল থেকে সৃষ্ট এই বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দিঘি, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।

মৎস্য খাত ও যোগাযোগব্যবস্থায় চরম ক্ষতির আশঙ্কা: আগাম বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ১৫৩টি সড়কের ৬৫৭ কিলোমিটার ডুবে গেছে। দুই জেলার বেশ কিছু উপজেলার অভ্যন্তরীণ ও জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এতে ব্যাপক দুর্ভোগে রয়েছে দুই জেলার অন্তত ২০ লাখ মানুষ। এখন পর্যন্ত এসব সড়ক পানির নিচে ডুবে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির নির্দিষ্ট পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি বলে আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন সিলেট সড়ক বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী সুমন আহমেদ।

সিলেট জেলার সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আপডেট কোনো তথ্য আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় নাই। তাই সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাবটা নিরূপণ করা যায়নি ৷ আমি দ্রুত সভা ডেকে আপডেট ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটা জানার চেষ্টা করব।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত