Ajker Patrika

বোরো জমিতে সেই ‘গায়েবি’ মাদ্রাসার নাম এমপিও তালিকায়

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ০৪
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নতুন পাড়া এলাকায় রাতারাতি ফসলি জমিতে তৈরি করা হয় ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নতুন পাড়া এলাকায় রাতারাতি ফসলি জমিতে তৈরি করা হয় ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বেগুনবাড়ী ইউনিয়নের নতুনপাড়া। বোরো জমির মাঝে হঠাৎ করেই যেন গজিয়ে উঠেছে এক ‘অদৃশ্য’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—নতুনপাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। অবাক করার বিষয় হলো, বাস্তবে যে প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিছুই নেই, সেই মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) চূড়ান্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছে! এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় এলাকায় তীব্র ক্ষোভ ও বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার স্বার্থে এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দেড় হাজারের বেশি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে। সেই তালিকার ১ হাজার ৩৫৩ নম্বর সিরিয়ালে রয়েছে এই ‘ভূতুড়ে’ মাদ্রাসার নাম। অথচ স্থানীয়দের তথ্যানুসারে এবং জেলা শিক্ষা অফিসের তদন্তে স্পষ্ট উঠে এসেছে, নতুনপাড়া এলাকায় বাস্তবে এমন কোনো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কোনো অবকাঠামোই নেই। সেখানে কোনো শিক্ষা কার্যক্রমও চলে না।

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গত ৬ এপ্রিল জেলা শিক্ষা অফিসার শাহীন আকতার সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধান করেন। পরদিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেন, ‘নতুনপাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা’ নামে কোনো বাস্তব কাঠামোর অস্তিত্ব নেই এবং সেখানে কোনো শিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালিত হয় না। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে দাবি করা শাহিনুর আলম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র, শিক্ষক নিয়োগের রেজল্যুশন অথবা মাদ্রাসার দৈনন্দিন কার্যক্রমের কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারেননি। তদন্তকালে বর্তমান মাদ্রাসার স্থানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না বলেও তিনি নিশ্চিত করেন।

এমন প্রতিষ্ঠান কীভাবে এমপিও তালিকায় স্থান পেল, তা নিয়ে হতবাক জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে। তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠান বাস্তবে নেই, তাকে এমপিওভুক্ত করা হলে তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি ভয়াবহ সংকেত। এর মাধ্যমে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে এবং প্রকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হবে।’

আরেক প্রবীণ শিক্ষাবিদ আলতাফুর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির কোনো শিক্ষার্থী নেই, কোনো শিক্ষক নেই—এমন একটি মাদ্রাসা কীভাবে এমপিও তালিকায় এল? এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।’

ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মনসুর আলী বলেন, বোরো জমির মাঝে গজিয়ে ওঠা এই ‘গায়েবি’ মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বাঁধা দুর্নীতির এক নগ্ন চিত্র যেন তুলে ধরছে। এখন দেখার বিষয়, স্থানীয়দের প্রতিবাদ ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নেয়।

গ্রামবাসীর অভিযোগের তীর পূর্ব বেগুনবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার সুপার আব্দুল মতিনের দিকে। তাদের দাবি, এই নতুন ভুঁইফোড় মাদ্রাসার শিক্ষকের তালিকায় রয়েছেন আব্দুল মতিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। তালিকায় রয়েছেন আব্দুল মতিনের ভাতিজা জাহিদ হাসান, শ্যালিকা মোমেনা খাতুন, খালাতো শ্যালক আবদুল আজিজ এবং প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে আছেন আব্দুল মতিনের বড় ভাই ও বেগুনবাড়ী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমিনুল হক সরদার। এই আত্মীয়করণের বিষয়টি মাদ্রাসার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষা কর্মকর্তা আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তিনি বলেন, ‘এই গায়েবি মাদ্রাসাকে জাতীয়করণের জন্য জোরেশোরে তদবির করছেন আমিনুল হক সরদার। বিভিন্ন মহলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোরও চেষ্টা করছেন তিনি।’

এই অবিশ্বাস্য ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে নতুন পাড়ার সাধারণ মানুষ। তাঁরা অবিলম্বে এই ‘ভূতুড়ে’ মাদ্রাসার জাতীয়করণ বা এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন এবং একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। তাঁদের একটাই দাবি, শিক্ষাব্যবস্থায় এমন দুর্নীতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। দ্রুতই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বিস্তারিত জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত