Ajker Patrika

স্কুলযাত্রায় শিক্ষার্থীদের ভরসা মাঝিবিহীন ডিঙি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
মাঝিবিহীন ডিঙিতে করে নদী পার হয়ে স্কুলে যাচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
মাঝিবিহীন ডিঙিতে করে নদী পার হয়ে স্কুলে যাচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

ডিঙি নৌকাটির কোনো মাঝি নেই। দুপাশে বাঁধা শেকলের সঙ্গে ঝুলছে লম্বা দড়ি। এই দড়ি টেনেই প্রতিদিন শিব নদ পার হতে হয় গ্রামবাসীকে। প্রায় ১০০ গজ প্রশস্ত এই নদই আবার গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার প্রধান পথ। দিনভর কয়েক শ মানুষ ছাড়াও শতাধিক শিক্ষার্থী এভাবেই পারাপার হয়। এ সময় পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয় বলে জানান অভিভাবকেরা। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার নওগাঁ গ্রামের খুদে শিক্ষার্থীরা রয়েছে এমন ভোগান্তির মধ্যে।

অভিভাবকেরা বলছেন, নৌকায় ওঠানামা কিংবা দড়ি টেনে নৌকা চালাতে গিয়ে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা পানিতে পড়ে যায়। সবশেষ গত বুধবার তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্র পানিতে পড়ে যায়। সহপাঠীরা দ্রুত তাকে ধরে ফেলায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। পরে স্থানীয়রা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।

গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, নদ পারাপারের জন্য শিক্ষার্থীরা উঠেছে ডিঙি নৌকাতেই। তখন নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ফারুক হোসেন বলে, ‘একা নৌকায় উঠতে ভয় লাগে। মাঝনদে গেলে নৌকা স্রোতে সরে যায়। তখন দড়ি টেনে পাড়ে আনতে কষ্ট হয়। প্রাইভেট পড়তে গেলে বাবা পার করে দেন। বিকেলে আবার অনেক সময় মা অথবা এলাকার বড় ভাইয়েরা পার করান। গতকাল আমাদের ক্লাসের এক ছাত্র পড়ে গিয়েছিল।’

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সম্পা খাতুন বলে, ‘বর্ষায় পানি বাড়লে নৌকায় উঠতে সমস্যা হয়। অনেক সময় নৌকা থেকে পড়ে যাই। বই-খাতা ভিজে যায়, পড়াশোনায় কষ্ট হয়।’ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকা সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার জানান, ‘এখন স্রোত কম থাকলেও কিছুদিন আগে প্রচণ্ড স্রোত ছিল। তখন ছোট নৌকায় পারাপার করা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বড়রা ভয় পায়, শিশুদের জন্য ঝুঁকি আরও বেশি। আগে এখানে বাঁশের সাঁকো ছিল, সেটি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে মানুষ এভাবেই পার হয়। একটি সেতু হলে বহু মানুষের ভোগান্তি কমবে।’

স্থানীয়রা জানান, শিব নদের ওপর একসময় বাঁশের সাঁকো ছিল। সেটি ভেঙে যাওয়ার পর একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে এই ডিঙি নৌকা। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ ও শিক্ষার্থী নৌকায় পার হয়। নদের উত্তরে মালিদহ ও গোপইল গ্রাম, দক্ষিণে নওগাঁ গ্রাম। তিন গ্রামের শতাধিক শিশু প্রতিদিন নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। ১২০ বছরের পুরোনো এই বিদ্যালয়ে একসময় শিক্ষার্থী ছিল দুই শতাধিক। এখন সংখ্যা নেমে এসেছে ১১৮তে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাষ্য, সাঁকো ভাঙার পর থেকেই অভিভাবকেরা নিরাপত্তার কারণে সন্তানদের অন্য স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। অভিভাবক নুরেসা বেগম বলেন, ‘গতকালই এক ছাত্র নদে পড়ে যায়। সহপাঠীরা ধরেছিল বলেই বেঁচেছে। প্রতিদিনই দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকতে হয়, ছেলে-মেয়ে কখন বাড়ি ফিরবে।’

অভিভাবক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও বিকেলে কাজ ফেলে নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সন্তানদের পার করানোর জন্য। ঝুঁকির কারণে অনেককে দূরের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। অথচ আমাদের দাবি একটাই—এখানে একটা ব্রিজ হলে চার-পাঁচ গ্রামের মানুষ উপকৃত হবে।’ নদে মাছ ধরতে থাকা স্থানীয় মুঞ্জিলা সরদারও একই কথা বলেন। তাঁর মতে, ‘সাঁকো ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এই নৌকায় মানুষ পার হচ্ছে। দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। একটি ব্রিজ হলে চার-পাঁচ গ্রামের মানুষের জীবন সহজ হয়ে যাবে।’

জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তফা আহমেদ জানান, প্রতিদিন প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী নৌকায় চড়ে আসে। তারা সবাই ছোট মানুষ। দুর্ঘটনার ভয় সব সময়ই থাকে। এ কারণে অভিভাবকেরা সন্তানদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আগে শিক্ষার্থী ছিল দুই শতাধিক, এখন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। অভিভাবকেরা সরাসরি বলছেন, ব্রিজ হলে তাঁরা আবার সন্তানদের এখানে পাঠাবেন।’

এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) লিয়াকত সালমানের ফোনও রিসিভ হয়নি। কেশরহাট পৌরসভায় মেয়র না থাকায় সেখান থেকেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত