Ajker Patrika

বাড্ডায় বিএনপি নেতা খুন: পুলিশের নজরে রাজনীতি, চাঁদাবাজি ও ইন্টারনেট ব্যবসার দ্বন্দ্ব

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ২৭ মে ২০২৫, ১১: ৫৮
বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধন। ছবি: সংগৃহীত
বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধন। ছবি: সংগৃহীত

বাসা থেকে ফোন কল করে ডেকে বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধনকে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক কোন্দল, চাঁদাবাজি, পারিবারিক ও ইন্টারনেট ব্যবসার দ্বন্দ্ব—এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে দুজনকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাঁরা বাড্ডার স্থানীয় বাসিন্দা। তবে তাঁদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

গত মার্চে বাড্ডায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র সুমন মিয়া নামে একজন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী খুন হোন। ওই ঘটনার সঙ্গে এই হত্যার সম্পর্ক আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

গত রোববার রাত ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তর ও মধ্য বাড্ডার ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ও বিএনপির গুলশান থানার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। কামরুল আহসান উত্তর বাড্ডার ওই এলাকাতেই বড় হয়েছেন। তাঁর বাবা গুলশানে একসময় হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। স্ত্রী দিলরুবা আক্তারকে নিয়ে মধ্য বাড্ডার বালুর চরের ৫৬ / ৭ নং বাসার তৃতীয় তলায় দুই কক্ষের একটি বাসায় থাকতেন। তাঁদের কোনো সন্তান নেই। এই বাসা কায়ুম কমিশনারের।

ফোন কল করে বাসা থেকে ডেকে নেওয়ার ১০ মিনিট পর খুন

গতকাল সোমবার কামরুল আহসানের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসায় প্রতিবেশী, স্বজন ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর ভিড়। স্বজনেরা কামরুল আহসানের স্ত্রী দিলরুবা আক্তারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দিলরুবা বলেন, গত রোববার সকালে তাঁর স্বামী বাসা থেকে বের হন। সারা দিন বাসায় ফেরেননি। গুলশানের একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ছিলেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে বাসায় আসেন। এমন সময় তাঁর মোবাইল ফোনে একটি কল আসে, তাঁকে কানা মিলনের দোকানের সমানে যেতে বলা হয়। এরপর তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। ১০ মিনিট পরই দিলরুবা প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারেন, তাঁর স্বামীকে গুলি করা হয়েছে। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর আর কিছু জানেন না।

বাড্ডায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান হত্যাকাণ্ডের স্থান। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাড্ডায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান হত্যাকাণ্ডের স্থান। ছবি: আজকের পত্রিকা

দিলরুবা বলেন, কামরুল আহসান খুব শান্ত স্বভাবের ছিলেন। প্রকাশ্যে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকলেও অনেকে তাঁকে হিংসা করত। নেতারা তাঁকে পছন্দ করতেন, তাঁকে প্রায়ই ডাকতেন। এটি অনেকে পছন্দ করত না। কেউ কেউ তাঁকে বলত, এবার গুলশান থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হবেন কামরুল। তবে তিনি বলতেন, এত বড় পদ তিনি নিতে চান না।

কামরুলের একাধিক অনুসারী গতকাল তাঁর বাসার সামনে বলেন, কামরুলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় আগামীতে ভালো পদ পেতেন। গুলশান থানার সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ ছিল না।

দলীয় কোন্দল অস্বীকার করেছেন গুলশান থানা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের আহ্বায়ক কমিটিতে ২৪ জন নেতা রয়েছে। সবাই একসঙ্গে থাকি। আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’

সিসি ফুটেজে যা দেখা গেছে

ঘটনার দিন রোববার রাত ১০টার দিকে কামরুল আহসান সাধন ও তাঁর তিন বন্ধু উত্তর বাড্ডার হাইস্কুল-সংলগ্ন ৪ নম্বর গলিতে চেয়ার পেতে বসে গল্প করছিলেন। কামরুল আহসান ছাড়াও সেখানে তাঁর অপর তিন বন্ধু জাকির হোসেন রূপক, আবুল হোসেন এবং কামরুল ইসলাম। এই গলির পশ্চিম দিকে হাতিরঝিল এবং পূর্বদিকে গুদারাঘাট ও উত্তর বাড্ডা হাইস্কুল সড়ক। কামরুল আহসান হাতিরঝিলের দিকে পিঠ ফিরে বেঞ্চে বসে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় দুই তরুণ হাতিরঝিলের দিক থেকে হেঁটে আসে। দুজনের মুখেই মাস্ক। একজন কামরুল আহসানকে কাছ থেকে মাথায় গুলি করে। তিনি চেয়ার থেকে পড়ে যান। পেছনে থাকা অপর তরুণও দুই রাউন্ড গুলি করে। কামরুলের বন্ধুরা ছোটাছুটি শুরু করেন। চার সেকেন্ডে দুই দুর্বৃত্ত গুলি করে উত্তর বাড্ডার হাইস্কুল সড়কের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় কেউ তাদের ধরতে এগিয়ে আসেনি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা

গতকাল সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ৪ নম্বর গলির নুরজাহান মঞ্জিলের সামনে রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ঘটনাস্থল বেঞ্চ দিয়ে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশেই মোহাম্মদ হানিফ নামে এক ব্যক্তির চায়ের দোকান। হানিফ ঘটনার বর্ণনায় বলেন, তিনি দোকানে দাঁড়িয়ে চা তৈরি করছিলেন। হঠাৎ তিন চারটি শব্দ পান। ককটেল ও গুলির মতো শব্দ। অনেককে দৌড়ে পালাতে দেখেন। তিনিও দোকান থেকে বেরিয়ে দৌড় দেন। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে মানুষ জড়ো হয়।

কামরুল আহসানের বন্ধু প্রত্যক্ষদর্শী কামরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা চার বন্ধু প্রায়ই ৪ নম্বর গলিতে আড্ডা দেন। তাঁরা প্রতিদিনই এখানে বসেন। রোববার রাতে দুজন গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি।

তিনি বলেন, গুলি করে তারা পালিয়ে যায়। এরপর দুই ছেলে ধরে কামরুল আহসানকে প্রথমে বক্ষব্যাধি, পরে হৃদ্‌রোগ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাঁদের কোনো শত্রু আছে বলে তিনি মনে করেন না। তাঁরা একসঙ্গে সম্প্রতি ডেভেলপার ব্যবসা শুরু করেছিলেন বলেও জানান কামরুল।

বাড্ডায় দুই মাসে দুজন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী খুন, দুই গ্রুপের চাঁদাবাজি

বাড্ডার ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সুমন মিয়াকে গত ২০ মার্চ গুলশান পুলিশ প্লাজার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সাঈদ ও মামুন নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে র‍্যাব জানায়, বাড্ডার পলাতক সন্ত্রাসী মেহেদী ও রবিন গ্রুপের চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বের কারণে সুমনকে হত্যা করা হয়। ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসায় সুমনের কাছে মেহেদী গ্রুপ চাঁদা চেয়েছিল। তবে চাঁদা দেননি সুমন। তিনি রবিন গ্রুপের হয়ে কাজ করতেন। এরপর মেহেদী গ্রুপ তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন।

কামরুল আহসান হত্যাকাণ্ডও চাঁদাবাজি কেন্দ্রিক হতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। রবিন গ্রুপের সঙ্গে সখ্য ছিল বিএনপি নেতা কামরুল আহসানের। মেহেদী গ্রুপ তাঁকে হত্যা করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। সন্ত্রাসী মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে এবং রবিন মালয়েশিয়ায় পালিয়ে আছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যে গুলি ছোড়া দুই সন্ত্রাসীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

কামরুল আহসানের স্ত্রীর বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন জানান, ২০১৮ সাল থেকে কামরুল আহসান ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা শুরু করেন। বাড্ডায় স্বদেশ নামে তাঁর ইন্টারনেট সংযোগের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬০০ থেকে ৭০০ সংযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের। আওয়ামী লীগের আমলে ২৫ লাখ টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছিলেন তিনি।

নিহত কামরুল আহসানের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার গতকাল সোমবার বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা করেছেন।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, চাঁদাবাজি ও পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত