Ajker Patrika

অপকর্ম দেখে নীরব ছিলেন কর্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮: ০৩
অপকর্ম দেখে নীরব ছিলেন কর্তারা

‘স্যারের হাই জ্যাক। বড় বড় লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা। মন চাইলে অফিসে আসতেন, না হলে নয়। গত সাত মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে মাত্র তিনবার। সাত দিন ধরে তিনি থানায়ই আসেননি। বড় সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা তো...।

রাজধানীর বনানী থানার একজন পুলিশ সদস্য এটুকু বলেই থেমে যান। তাঁর অভিমত, পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা ছিলেন নিয়ন্ত্রণহীন। কোনো কিছুই তিনি তোয়াক্কা করতেন না। পুলিশ কর্মকর্তারা এসব জেনেও নীরব থাকতেন।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শেষ যখন তিনি থানায় আসেন, নিজের দামি গাড়িতে আসেন। তাঁর গাড়ি থানার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল। সবাই জানতেন, তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক।

দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গত শুক্রবার ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা। এরপরই তাঁর বিপুল সম্পদের হদিস আর অবৈধ ব্যবসার বিষয়টি আলোচনায় আসতে শুরু করে। কিন্তু তার আগে প্রশ্ন ওঠে, দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা কি নিজেদের কর্মকর্তার এসব অপকর্মের কথা জানতেন না?

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) আনিসুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন ডিসি মিডিয়া। ডিসি মিডিয়া ফারুক হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে। মঙ্গলবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে বেরিয়ে আসবে তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা যিনি ছিলেন তিনি কমিশনারকে কিছু জানিয়েছিলেন কি না। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা ছিলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি)। তদন্তে কার কতটুকু গাফিলতি আছে, সেটা বেরিয়ে আসবে। তদন্তে যদি গাফিলতি পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বনানী থানায় ঢুকেই হাতের বাঁয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম মিয়ার কক্ষ। তারপর সোজাসুজি ডিউটি অফিসারের কক্ষ। ডিউটি অফিসারের কক্ষের পাশে বসতেন পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা। কয়েক দিন ধরেই তাঁর কক্ষ বন্ধ। সোমবার পর্যন্ত নতুন পরিদর্শক আসেননি।

সেখানকার একাধিক পুলিশ সদস্য বলেন, সোহেল রানা দিনের বেলায় থানায় আসতেন না, মাঝে মাঝে আসতেন রাতে। থানার কোনো গাড়িও তিনি ব্যবহার করতেন না। সহকারী উপপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, আড়াই বছর তিনি এ থানায় আছেন। সোহেল রানার সঙ্গে দেখা হয়েছে তিন-চারবার। কিন্তু কোনো কথা হয়নি। তিনি সব সময় খুব ব্যস্ত থাকতেন।

জানতে চাইলে বনানী থানার ওসি নুরে আজম মিয়া বলেন, সোহেল রানার কাজ তদন্তের বিষয়টি দেখভাল করা। তিনি সেটাই করতেন। গত বৃহস্পতিবার সোহেল রানা অফিস করেছেন বলেও তিনি দাবি করেন।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পরিদর্শক সোহেল রানা ঘুরেফিরে গুলশান এলাকাতেই প্রায় ১০ বছর চাকরি করছেন। বেশির ভাগ সময়েই ছিলেন গুলশান ও বনানী থানায়। মাঝখানে একবার ডিবিতে বদলি হলেও আবার গুলশানে ফিরে আসেন। কূটনৈতিক পাড়ায় দায়িত্ব থাকার সুবাদে ভিসা সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েন। গুলশান এলাকার অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও অভিযোগ আছে।

সোহেল রানা গ্রেপ্তারের পর তাঁর শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের বিষয়টি উঠে আসছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও এসব উল্লেখ রয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশানের শাহজাদপুরের সুবাস্তু নজরভ্যালির একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। এ ছাড়াও তাঁর আরও তিনটি ফ্ল্যাট আছে। নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে সাগর নামে তাঁর এক আত্মীয় থাকেন। একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আছে তাঁর। খাগড়াছড়িতে রিসোর্টের জন্য জায়গা কেনা আছে তাঁর নামে। থাইল্যান্ডের পাতায়াতে জমি ও ফ্ল্যাটের পাশাপাশি হিলটন হোটেলের পাশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে প্রায় ৫০০ বিঘা জমির মালিক তিনি।

আজকের পত্রিকার টুঙ্গিপাড়া প্রতিনিধি জানান, সাড়ে তিন বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর সোহেল রানা গ্রামে আসেন। গ্রামে তিনি খুব বেশি আসতেন না। তাঁর গ্রামের বাড়িতে সৎমা থাকেন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গোপালপুর ইউনিয়নের জোয়ালিয়া স্কুলের পেছনে ১২ বিঘা জমির ওপর তাঁর একটি মাছের ঘের রয়েছে। আছে বেনামে আরও কিছু জমিজমা।
একজন পুলিশ সদস্যের বেপরোয়া চলাফেরা ও অবৈধ সম্পদের হদিস কি পুলিশ জানত না? এ প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ চলছে। তাঁকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই সব জানা যাবে।

 দুদকের সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ই-অরেঞ্জের অভিযুক্তদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করা হবে বলে জানান। গতকাল সোমবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথ্য দিলে অনুসন্ধান করবে দুদক।

এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানাসহ ছয়জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গত রোববার ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী এই নিষেধাজ্ঞা দেন। সোহেল রানা ছাড়া অন্যরা হলেন নাজনিন নাহার বিথী, কামরুল হাসান, আব্দুল কাদের, নূরজাহান ইসলাম সোনিয়া ও রুবেল খান। গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের কথিত পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গত ৩১ আগস্ট আদালতে মামলা করা হয়। রোববার মামলাটি গুলশান থানায় নিবন্ধন করা হয়।

প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পরিচালক পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানা। প্রতারণার ঘটনায় গুলশান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় পৃথক দুটি মামলায় সোহেল রানার বোন মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।

সোহেল রানার নানা কর্মকাণ্ড ও প্রকাশ্য ব্যবসা করা নিয়ে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে কথা বলা হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পুলিশের একজন কর্মকর্তা এভাবে ব্যবসা করতে পারেন না। তাঁর আয়-ব্যয় সরকারকে জানাতে হয়। তিনি অফিসে কতটুকু কীভাবে কাজ করেন, তার তত্ত্বাবধান করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করেননি। সোহেল রানা অপরাধ করেছেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তাদেরও গাফিলতি কম নেই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত