Ajker Patrika

হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে দুই ভিকটিমকে দেওয়া হয় চিকিৎসা সনদ

আশরাফ-উল-আলম, ঢাকা
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২১, ২২: ৪০
হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে দুই ভিকটিমকে দেওয়া হয় চিকিৎসা সনদ

বনানীর একটি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলায় ভিকটিমদের চিকিৎসা সনদ দেওয়া হয় বেআইনিভাবে। হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে এই সনদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশও এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে বলে একটি মেডিকেল সনদে দেখা গেছে।

ধর্ষণ সংক্রান্ত মেডিকেল রিপোর্টে কোনো ভিকটিমের ‘অতীত শারীরিক সম্পর্ক অভিজ্ঞতা’ না লিখতে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। অথচ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ ওই নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে বনানী রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার হওয়া দুই ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরীক্ষার প্রতিবেদনে শারীরিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন।

ডা. সোহেল মাহমুদ ২০১৭ সালের ১ জুন এই প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভিকটিমদের জোরপূর্বক ধর্ষণের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে তাদের শারীরিক সম্পর্কের অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিবেদনটিতে হাইকোর্ট ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে বলে দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগের এই প্রতিবেদন উচ্চ আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-সহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল এ সংক্রান্ত আট দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, চিকিৎসক/ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ধর্ষণ সংক্রান্ত চিকিৎসা সনদ ইস্যু করবেন, তবে সেখানে পূর্বে শারীরিক সম্পর্কের বিষয় উল্লেখ করতে পারবেন না এবং এ সম্পর্কে ভিকটিমকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।

হাইকোর্ট আদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে। যেখানে হাইকোর্টের আদেশ যথাযথভাবে পালন করতে চিকিৎসক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে বহুল আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় দুই ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন এই ধরনের অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

এ ছাড়াও দুই আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করা হয় ওই দুই ভিকটিমকে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের একই আদেশে নির্দেশনা রয়েছে। দুই আঙুল দিয়ে ভিকটিমের পরীক্ষা করা যাবে না। এমনকি এই মামলার পাঁচ আসামির সকলকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণার সময় বিচারক পর্যবেক্ষণে সেই মেডিকেল রিপোর্টের অসম্মানজনক শব্দ তুলে ধরেন।

ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোসাম্মাত কামরুন্নাহার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘এই মামলার চিকিৎসা সনদ থেকে দেখা যায়, জোরপূর্বক ধর্ষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি চিকিৎসা সনদে উল্লেখ করা হয়েছে অতীত শারীরিক সম্পর্কে তাঁরা অভ্যস্ত। তারপরও এই মামলায় অভিযোগপত্র কীভাবে দেওয়া হলো তা বোধগম্য নয়।’

আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে মেডিকেল রিপোর্টে ভিকটিমের অতীত সেক্সুয়াল অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ রকম অসম্মানজনক শব্দের ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমনকি আদালতের এ রকম পর্যবেক্ষণও বেআইনি।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের এ রায় ও নির্দেশনা সকলের জন্য আবশ্যকভাবে পালনীয়। যদি না পালন করে, সেটি সংবিধান ও আদালত অবমাননা। বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে সংশ্লিষ্ট ফরেনসিক ডাক্তারের বিরুদ্ধে আদালত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনালের ওই বিচারক কীভাবে খালাস প্রদানের বিষয়টি যুক্তিযুক্ত করতে নিজেই এই অসম্মানজনক শব্দটি পর্যবেক্ষণে তুলে ধরলেন, তা বোধগম্য নয়।

সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু এ প্রসঙ্গে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ মানতে সবাই বাধ্য। চিকিৎসক বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দুই ভিকটিমের চিকিৎসা সনদে বা প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করেছেন তা অপরাধ।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের গত ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তাঁর বান্ধবী ও বন্ধুকে আটকে রাখে। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। পরবর্তীতে বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে জোর করে ধর্ষণ করেছে দুই আসামি, বাকিরা করেছে সহায়তা।

মামলা হওয়ার পর ধর্ষণের অভিযোগের ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড ওই বছরের ১ জুন একটি প্রতিবেদন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত