Ajker Patrika

বাস রুট রেশনালাইজেশন: রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যর্থ উদ্যোগ এবার সফল করার চেষ্টা

  • বাসমালিকদের রাজনৈতিক প্রভাবে এত দিন সফলতা আসেনি।
  • অবৈধ বাসের দৌরাত্ম্যও উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কারণ।
  • বাস কোম্পানিগুলো বাস দেয়নি, বিআরটিসিও দেয়নি।
  • রাজনৈতিক প্রভাবসহ সব বাধা কাটিয়ে সফল হওয়ার চেষ্টায় কর্তৃপক্ষ।
সৌগত বসু, ঢাকা 
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১: ০৯
Thumbnail image
আবার চালু হতে যাচ্ছে ঢাকা নগর পরিবহন। ছবি: সংগৃহীত

চার বছর ধরে প্রকল্প নেওয়া হলেও পরিবহনমালিকদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অবৈধ বাসের দৌরাত্ম্যে আজ পর্যন্ত সফলতা আসেনি বাস রুট রেশনালাইজেশনের। ২০১৬ সালে প্রথম চিন্তা করা হয় ঢাকার বাসগুলোকে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির আওতায় আনার। ২০১৮ সালে কমিটি করা হয়, আর ২০২১ সালে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এই প্রকল্প সফল করতে চায় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।

২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন। তবে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর উদ্যোগটি থেমে যায়।

ডিটিসিএ বলেছে, বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি ক্লাস্টার (৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের), ২২টি কোম্পানি ও ৪২টি রুটের প্রস্তাব দিয়েছিল ডিটিসিএ। এর মাঝে আরবান ক্লাস্টার (নগর পরিবহন) ছয়টি (রুট ৩৪টি) ও সাব-আরবান (শহরতলি পরিবহন) ক্লাস্টার তিনটি (রুট ৮টি)। এ প্রস্তাব ২০২০ সালের ১২ আগস্ট কমিটির ১৪তম সভায় অনুমোদিত হয়। ২৩তম সভার সিদ্ধান্তে ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি রুটে বাস চালু করলেও তা এখন বন্ধ।

ডিটিসিএ সূত্র বলছে, পরিবহনমালিকদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অবৈধ বাস চলাচলের কারণে ডিটিসিএর রুটগুলোয় কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। বাস কোম্পানিগুলো বাস দেয়নি। বিআরটিসি থেকেও বাস পাওয়া যায়নি। নগর পরিবহনে চলতে হলে বাসের ফিটনেসসহ ভালো বাস দরকার ছিল। চালু হওয়া রুটে বাস ও মালিকের সংখ্যা প্রায় সমান ছিল। ফলে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে গিয়ে মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, বিগত সরকারের আমলে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, ওসমান আলীদের মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কারণে বাস রুটে শুধু একটি কোম্পানির বাস চালানো যায়নি। পরবর্তী সময়ে আবার রাজনৈতিক সরকার এলে তাদের মতো কেউ এসে একই কাজ করবেন।

এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই কমিটি গঠনে পদ্ধতিগত ভুল রয়েছে। এটিও আমলানির্ভর কমিটি। কমিটিতে পেশাদার লোকজনের থাকা উচিত। আবার একই করিডরে নগর

পরিবহনের বাসও চলবে, আবার লেগুনাও চলবে, তাহলে তো হবে না। রুট পুনর্বিন্যাস করতে গেলে আগে কোন করিডরে কোন গতির যানবাহন চলবে, সেটি নির্দিষ্ট করতে হবে।

ডিটিসিএ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে গঠিত ১০ সদস্যের কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রকে এবং যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় ঢাকা উত্তর সিটির মেয়রকে। সেই কমিটি প্রায় পাঁচ বছর কাজ করলেও কোনো ফল আসেনি। তবে বাস রুটের সংখ্যা বেড়েছে। এদিকে বিগত সরকারের টানা ১৫ বছরে বাসমালিকেরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ঢাকার বেশির ভাগ বাসের মালিকের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। এতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়ে। ২৭টি সভা হলেও সেখানে মালিকপক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি।

রাজধানীর বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যাঁরা মালিক সমিতিতে ছিলেন বা এই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের সবার সদিচ্ছা ছিল না। কোনো না কোনো অজুহাত থাকত মালিকদের। তিনি বলেন, তবে এই সরকারের সময়ে তাঁরা এটিকে সফল করতে চান। আগামী মার্চ থেকে নগর পরিবহনের বাস চালুর আশা রয়েছে। ঢাকার ৩৮৮টি রুটকে সমন্বয় করে প্রাথমিকভাবে ৪২টি বাস রুটে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এখন এই রুটগুলোয় গণপরিবহনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। রুটের সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫টিই থাকবে, কারণ ঢাকায় বাস চলাচলের মতো রাস্তা মাত্র ৩০০ কিলোমিটারের মতো।

কেমন হবে বাস

বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোম্পানির নামে বাস রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। ব্যক্তির নামে বাসের রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট দেওয়া হবে না। দুটি কোম্পানি এক রুটে বাস চালাতে চাইলে যৌথ উদ্যোগে আসতে হবে। রাজধানীর ভেতরে কাউন্টার ও টিকিট ছাড়া কোনো বাস চলবে না। পরবর্তী সময়ে র‍্যাপিড পাসের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। বাসে অটো ডোর লাগানো হবে ধাপে ধাপে। বাসে আসনবিন্যাসও পরিবর্তন করা হবে। বাসে থাকবে ড্যাশক্যাম, স্টপেজেও থাকবে ক্যামেরা। চালক ও চালকের সহকারীর নিয়োগ হবে কোম্পানি থেকে, তাঁরা কোনো ভাড়া আদায় করবেন না।

১০টি বাসস্টেশন করা হবে

ডিটিসিএ বলছে, বাস রুট রেশনালাইজেশন সম্পন্ন হলে আন্তজেলা বাসগুলো আর ঢাকায় ঢুকবে না। সে জন্য ট্রান্সফার স্টেশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। এ ছাড়া, ডিটিসিএ আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ও ডিপো নির্মাণের জন্য স্টাডি করে ১০টি স্থান নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো ঝিলমিল, বাঘাইর (ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের দক্ষিণে), কাঁচপুর-১ (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তরে), কাঁচপুর-২ (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণে), ভুলতা (ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সন্নিকটে), হেমায়েতপুর (ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে), বাইপাইল (নবীনগর-চন্দ্রা সড়কের পাশে), গাজীপুর (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে), গ্রাম ভাটুলিয়া (এমআরটি-৬-এর ডিপোর সঙ্গে), আঁটিবাজার (ইনার রিং রোডের পশ্চিম পাশে), কাঞ্চন (ঢাকা বাইপাসের দক্ষিণে)।

ডিটিসিএ বলছে, নভেম্বরজুড়ে বাস চালাতে আগ্রহী বাসমালিকদের আবেদন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। ১ ডিসেম্বর থেকে আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে। এখন পর্যন্ত ৮০টি বেসরকারি কোম্পানি থেকে ২ হাজার বাসের আবেদন জমা পড়েছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি এম এ বাতেন বলেন, এখন বাসমালিকেরা একটি কোম্পানির আওতায় বাস চালাতে বেশি আগ্রহী। কারণ, এতে করে সড়কে ট্রিপ বাড়বে, বেশি যাত্রী পাওয়া যাবে। অযথা প্রতিযোগিতাও থাকবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত