Ajker Patrika

ভ্যানের ওপর রক্তাক্ত নিথর দেহের স্তূপ গড়ছে পুলিশ, ভাইরাল ভিডিওটি আশুলিয়ার

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি
আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২: ৪৭
Thumbnail image

একটি ভ্যানে নিথর দেহ তুলছেন কয়েকজন; গায়ে পুলিশের ভেস্ট ও মাথায় পুলিশের হেলমেট। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত না হলেও হাত দেখে অন্তত ৩ ব্যক্তি বুঝা যায়। চাদর ও ব্যানার জাতীয় কিছু দিয়ে দেহগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে— এমন দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে ঘটনাস্থল কোথায় তা জানতে চাইছেন। ভিডিওটি ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনের সড়কের বলে আজকের পত্রিকা’র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। 

ভিডিওতে দেখা যায়, নিথর দেহের স্তূপবোঝাই ভ্যানটির পাশে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এদের মধ্যে দুজনের মুখ দেখা গেছে। একজন পুলিশের ভেস্ট পরা, আরেকজন ছিলেন সাদা পোশাকে। পুলিশের ভেস্ট পরা ব্যক্তি হলেন ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। আর সাদা পোশাকের ব্যক্তির পরিচয় মেলেনি। বাকিরাও ডিবি পুলিশের সদস্য হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওটির ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে দেয়াল দেখা যায়, যেখানে সাঁটানো ছিল একটি পোস্টার। সেটি আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেন ভুঁইয়ার বলে শনাক্ত হয়েছে। 

আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) আশুলিয়া থানা এলাকায় গিয়ে ভিডিওতে থাকা সেই দেয়াল ও পোস্টার খুঁজে পাওয়া গেছে। এতেই ভিডিওটির ঘটনাস্থল নিশ্চিত হয়েছে। নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক থেকে যে সংযোগ সড়ক আশুলিয়া থানাকে সংযুক্ত করেছে এটি মূলত সেই সড়ক। মহাসড়ক থেকে থানার দিকে যাওয়ার সময় পোস্টারসম্বলিত সেই দেয়ালটি হাতের ডানেই পরে।

ভিডিওতে দেখা যায়, নিথর দেহের স্তূপবোঝাই ভ্যানটির পাশে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। ছবি: সংগৃহীতপ্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভিডিওটি আশুলিয়া থানা ভবনের সামনের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে ধারণ করা হয়েছে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্ট সকাল থেকে আশুলিয়া থানা এলাকায় অবস্থান করছিল ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি পুলিশের একটি টিম। ওইদিন সকাল থেকেই আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল মোড় এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। সেদিনই বাইপাইল এলাকায় প্রায় সারাদিন মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা যায়। 

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা উত্তর ডিবির পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

ভিডিওতে দেখা যায়, নিথর দেহের স্তূপবোঝাই ভ্যানটির পাশে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। ছবি: সংগৃহীতএ ব্যাপারে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, ‘আরাফাতের ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর আরাফাত ভেঙে পড়েছেন। আমরা সেদিন ছাত্র-জনতার দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়িনি।’

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈন বলেন, ‘ভিডিওটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আমাদের টিম কাজ করছে এটি নিয়ে৷ পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ভিডিওতে দেখা যাওয়া সেই দেয়াল ও পোস্টার। ছবি: আজকের পত্রিকাথানা সংলগ্ন একাধিক দোকানদার ভিডিওতে দেখতে পাওয়া স্থানটি যে থানা সংলগ্ন তা নিশ্চিত করেছেন। ভিডিওতে বস্তা দিয়ে বানানো যে বাংকার দেখা যায় তার অপর পাশে থাকা সাদিয়া কনফেকশনারির মালিক ফাহিমা বেগম বলেন, ভিডিওর যে জায়গাটি এটি আমার দোকানের সামনের।

আশুলিয়া থানার গেটের বিপরীত পাশের চা দোকানদার জসিম বলেন, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে আন্দোলনকারীরা থানার চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। এ সময় পুলিশ মসজিদের মাইক ও হ্যান্ডমাইক দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পরেও আন্দোলনকারীরা থানার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় পুলিশ গুলি চালাতে থাকে। তখন তাঁরা ভয়ে দোকান বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে সরে যান।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, বিকেল ৪টার দিকে থানায় হামলার চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিছিলকারীদের আসার খবরে মসজিদের মাইক ও হ্যান্ড মাইক দিয়ে থানার পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। এরপরও আন্দোলনকারীরা থানার দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। ওই মরদেহগুলোই হয়তো ভ্যানে তোলা হয়ে থাকতে পারে।

গত ৬ আগস্ট থানার সামনে একটি পিকআপে পুড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি লাশের মধ্যে নিজের ছেলে আস–সাবুরের লাশ চিহ্নিত করেন মা রাহেন জান্নাত ফেরদৌস। তিনি বলেন, ৬ আগস্ট সকালে আশুলিয়া থানার সামনে একটি পিকআপে পুড়ে যাওয়া কয়েকজনের মৃতদেহের খোঁজ মেলে। আমার ছেলের পুড়ে যাওয়া মরদেহটি ওই পিকআপেই পেয়েছি। আমার ছেলের পকেটে থাকা মোবাইলের সিম কার্ডের সূত্র ধরে তার মরদেহ শনাক্ত করি। এখন মনে হচ্ছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওর লাশগুলো ওই পিকআপে ভরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লাশ গুম করার জন্য তারা পিকআপে ভরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

আশুলিয়া থানার সামনে পুড়ে যাওয়া লাশভর্তি পিকআপ। ছবি: আজকের পত্রিকাসেদিন পুড়ে যাওয়া লাশের পাশে আইডি কার্ড দেখে সাজ্জাদ হোসেন সজলের লাশও শনাক্ত করেন মা শাহিনা বেগম। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট বিকেল ৩টা থেকে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়। পরদিন সকালে থানার সামনে পুড়ে যাওয়া লাশের সঙ্গে থাকা আইডি কার্ড দেখে সাজ্জাদের পুড়ে কয়লা হওয়া মৃতদেহ শনাক্ত করি। সেখানে ছয়টি পোড়া লাশ ছিল। 

নবীনগর–চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে আশুলিয়া থানায় ঢোকার সড়কের মাথায় বাইপাইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের অবস্থান। সেই মসজিদের ইমাম মাওলানা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, সেদিন (৫ আগস্ট) দুপুরের পর থেকে মসজিদে আসতে পারিনি। রাতে শুধু এশার নামাজ হয়েছিল। পরদিন (৬ আগস্ট) সকালে পুড়ে যাওয়া ৬টি মরদেহের জানাজা আমি পড়িয়েছি।

উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে অন্তত ৩১ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়া গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়। ওই দিনের ঘটনায় অন্তত ৪৫ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ আরও অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ওই দিন তিন পুলিশ সদস্যও নিহত হন। এর মধ্যে দুইজনকে হত্যার পর নবীনগর–চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইলের একটি ওভারব্রিজের ওপর উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এক পুলিশ সদস্যের পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া থানা সংলগ্ন এলাকায় একটি পুলিশ ভ্যানে কয়েকটি পোড়া মরদেহ পাওয়া যায়।

আরও খবর পড়ুন: 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত