Ajker Patrika

ভরা মৌসুমেও আমদানি, কৃষকের মাথায় হাত

� দেশীয় চার পণ্যের উৎপাদন খরচও উঠছে না।

� ন্যূনতম দাম ও আমদানি বন্ধের দাবিতে কৃষকদের বিক্ষোভ।

 নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৮: ২৮
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশীয় পেঁয়াজ, রসুন, আলু ও লবণের ভরা মৌসুম এখন। চলতি মৌসুমে এসব পণ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় এই সময়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটার কথা। কিন্তু লাভ তো দূরে থাক, পণ্যের উৎপাদন খরচও তুলতে না পেরে হতাশ কৃষকেরা।

ভরা মৌসুমে আমদানি অব্যাহত থাকা, পণ্যের ন্যায্যমূল্য বেঁধে না দেওয়া এবং সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। ন্যূনতম দাম ও আমদানি বন্ধের দাবিতে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন কৃষকেরা।

২৬ ফেব্রুয়ারি বুধবার সড়কে লবণ ঢেলে দিয়ে লবণের ন্যায্য দাম ও আমদানি বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার কৃষকেরা। আলুর ন্যায্যমূল্যের দাবিতে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলায় কয়েক দফায় বিক্ষোভ হয়েছে। পণ্যের যৌক্তিক দামের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন পেঁয়াজচাষিরাও।

ভোক্তা পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি লবণ ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও মিল পর্যায়ে (ক্র্যাশিং শেষে আয়োডিনযুক্ত) বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকার কম দামে (১০ টাকা ৪০ পয়সা)। অথচ মাঠপর্যায়ে কৃষক প্রতি কেজি লবণের দাম পাচ্ছেন মাত্র ৪ টাকা।

চকরিয়া উপজেলার লবণচাষি খোরশেদ আলম বলেন, এক কানি (৪০ শতক) জমিতে লবণ চাষ করতে ইজারা ৪০-৪৫ হাজার, মাঠ তৈরিতে ৭ হাজার, সেচ ৫ হাজার, মজুরি ২০ হাজার, পলিথিন বিছানোয় ৩ হাজারসহ মোট ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়।

একই জমিতে উৎপাদিত লবণের পরিমাণ ২০০ মণ। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রতিমণ লবণের দাম ২০০ টাকা। সেই হিসাবে এক কানি জমি থেকে উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে ৩৬-৪০ হাজার টাকা।

চট্টগ্রামের লাল মিয়া সল্ট নামের লবণ কারখানার মালিক আসাদ আহমেদ বলেন, মৌসুমেও আমদানি অব্যাহত থাকায় কৃষকেরা লবণের ন্যূনতম দাম পাচ্ছেন না। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট (শিল্পে ব্যবহারের লবণ) এবং দেশে সংকট হলে লবণ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্টের নামে আমদানি হওয়া বেশির ভাগ লবণ খাবার লবণ হিসেবে ভোক্তাদের কাছে চলে যাচ্ছে। দেশের লবণচাষিদের বাঁচাতে হলে মৌসুমে লবণ আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

মৌসুমেও লবণ আমদানির প্রমাণ মিলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যেও। অক্টোবর থেকে পুরোদমে মাঠে লবণ ওঠা শুরু হয়। এর মধ্যেই গত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি– এই চার মাসে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট নাম দিয়ে দেশে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩১৬ টন লবণ আমদানি হয়েছে।

এভাবে মৌসুমেও আমদানি অব্যাহত থাকায় আলু, পেঁয়াজ ও রসুনের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষকেরা।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদন মৌসুম শুরুর পরও নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসে দেশে ২৪ হাজার ১২২ টন আলু আমদানি হয়েছে। একইভাবে গত চার মাসে ৬৬ হাজার ৬৭ টন পেঁয়াজ এবং ২২ হাজার ৬০৮ টন রসুন আমদানি হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, দেশে বছরে রসুনের চাহিদা প্রায় ৬ লাখ টন। চাহিদার কাছাকাছি অর্থাৎ ৬ লাখ থেকে সাড়ে ৬ লাখ উৎপাদন হলেও পচে যাওয়া রসুনের হিসাব বাদ দিয়ে প্রকৃত উৎপাদন ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার টন। সেই অনুযায়ী, চাহিদার ১৩ থেকে ২০ শতাংশ রসুন আমদানি করতে হয় বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন।

আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হতে হলে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। মৌসুমের সময় পেঁয়াজ, রসুনসহ পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে।বলয় কুমার পোদ্দার ব্যবসায়ী, খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজারে পাইকারিতে বর্তমানে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকার মধ্যে। আর কৃষক পর্যায়ে তা বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়।

৩ মার্চ খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০-৩৫ টাকায়; যা মাঠে ১৫-২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ একই বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়।

পাইকারিতে বর্তমানে প্রতি কেজি চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ২১৫-২২০ টাকায়। অথচ দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়।

খাতুনগঞ্জের কাঁচা পণ্য (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিচ মিয়া বলেন, প্রতিবছর মৌসুমে লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হয় কৃষকদের। আমদানি বন্ধ থাকলে এই সময়ে দেশি পেঁয়াজ কমপক্ষে ৫০ টাকা এবং রসুন ১০০ টাকায় বিক্রি হতো। কিন্তু আমদানি পণ্যের চেয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে দেশি পেঁয়াজ ও রসুন। এভাবে লোকসানে পড়ে আগ্রহ হারিয়ে বছর বছর পেঁয়াজ, রসুন ও আদার উৎপাদন কমছে।

খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী বলয় কুমার পোদ্দার আজকের পত্রিকাকে বলেন, আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হতে হলে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। মৌসুমের সময় পেঁয়াজ, রসুনসহ পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বাঁচাতে এবং উৎপাদনে আগ্রহী করতে ভোক্তাদের উচিত দেশীয় পণ্য ব্যবহারে সচেতন হওয়া।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, সরবরাহ সংকটের কারণে তিন মাস আগেও প্রতি কেজি আলু কিনতে হয়েছে ৮০ টাকা দামে। অথচ মৌসুমে এসে ৮০ টাকায় ৮ কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কৃষককে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ৫ টাকায়। যে আলু উৎপাদনে তাঁর খরচ পড়েছে কমপক্ষে ৩০ টাকা। এভাবে কৃষকেরা চাষে আগ্রহ হারানোয় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে বাজার। কৃষককে বাঁচাতে হলে ‘পণ্যের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ, সংরক্ষণ এবং আমদানি-রপ্তানির কৌশল’ নির্ধারণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (২০২৪-২৫) দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের একটি ও কক্সবাজারের ৭ উপজেলায় ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১২৪ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। গত দুই বছরে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়; যা চাহিদার বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বার্ষিক আলুর চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ (৫ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর) জমিতে আলু চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৭ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে এবার।

দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। চাহিদার বাড়তি উৎপাদনের পরও একই বছর ভারত থেকে ৭ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।

দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সঠিক পরিচর্যা, সংরক্ষণের অভাবসহ নানা কারণে নষ্ট হয়। ফলে বাড়তি উৎপাদনের পরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত