Ajker Patrika

বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে ভারতীয় জেলেদের দাপট

তারিকুল ইসলাম কাজী রাকিব, পাথরঘাটা (বরগুনা) থেকে
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮: ২৬
Thumbnail image

গভীর সাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারতের জেলেরা। মৌসুমের শেষ মুহূর্তে রুপালি ইলিশের বিচরণের বড় ক্ষেত্রগুলো দখলে নিয়েছে তারা। গতকাল মধ্যরাতে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর গভীর সাগর থেকে ফেরা একাধিক জেলে এই অভিযোগ করেছেন। 

গতকাল শনিবার রাতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য ঘাটে আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। জেলেরা বলেন, সাগরে তাঁদের সঙ্গে দস্যুর মতো আচরণ করেছে ভারতীয় জেলেরা। হ্যান্ডমাইকে বাংলাদেশি জেলেদের সরে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। সরতে না চাইলে ইট-পাথর নিক্ষেপ করছে; জাল কেটে দিচ্ছে। ভারতীয় জেলেদের ট্রলারে ছয় সিলিন্ডারের শক্তিশালী ইঞ্জিন। সেগুলোর ধাক্কা দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশি ছোট ছোট ট্রলারকে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। 

এফবি রাসেল ফিশিং ট্রলারের জেলে আব্দুল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। ২০ বছর বয়সী এই তরুণ পাথরঘাটা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁর অভিযোগ, সাগরে ভারতীয় জেলেদের অত্যাচারের কাছে তাঁরা অসহায়। 

আব্দুল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভারতীয় জেলেরা আমাদের টলারের পাশে এসে জাল পাতে। তাদের জাল আমাদের জালের উপরে পড়লে আমাদের জাল কেটে দিয়ে তারা জাল টেনে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে বাধা দিলে আমাদের উপর চড়াও হয় এবং আমাদের ট্রলার বেঁধে ভারতের জলসীমায় নিয়ে গিয়ে সে দেশের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। গত দশ দিন আগে আমাদের দেড় লাখ টাকার জাল কেটে ভারতীয় জেলেরা নিয়ে গেছে।’ 

মোহাম্মদ নুহু নামে আরেক জেলে বলেন, ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় চালনার বয়া, মাইজদার বয়া, বড়ইয়ার চর, ফেয়ারওয়ের বয়া, বড় আমবাড়িয়া, ডিমের চর, সোনার চর, কবরখালীসহ ইলিশ বিচরণের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এসে মাছ শিকার করে। 

পাথরঘাটা পৌর শহরের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী নুহু। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কিছু বললে তারা ওয়্যারলেসে আশপাশের ট্রলার ডেকে এনে আমাদের ট্রলারের হামলা করে। এসব ঘটনায় একাধিকবার মালিক সমিতির কাছে অভিযোগ দেয়ার পরেও কোনো কাজ হয়নি।’ 

এফ বি মা নামে একটি ফিশিং ট্রলারের জেলে জিহাদ (২৫) জানান, বাংলাদেশ সীমানার দক্ষিণ পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন ও কুয়াকাটার কাছাকাছি এসে ইলিশ মাছ ধরছে ভারতীয় জেলেরা। 

আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘দুর্গাপূজার কারণে বর্তমানে ভারতের ব্যাপক ইলিশের চাহিদা। আমাদের দেশে এখন নিষেধাজ্ঞা চলছে। তাদের তো আর এখন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এই সুযোগে পাথরঘাটা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটারের দক্ষিণে এসেও তারা ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাবে।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে জানান, গভীর সমুদ্রে তারা বাংলাদেশের কোস্টগার্ড বা নৌবাহিনীর কোনো টহল তারা দেখেননি। তাদের দাবি, সাগরে টহল জোরদার করলে ভারতীয় জেলেরা যেমন দেশের জলসীমায় আসতে পারত না, তেমনি দেশের জেলেরাও নিরপরাধ বুকে মাছ শিকার করতে পারবে। 

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাগরে ভারতীয় জেলেদের তাণ্ডব নতুন নয়। প্রতি বছর ইলিশ মৌসুমে তারা আগ্রাসী ভূমিকায় অনুপ্রবেশ করে। আমাদের জেলেদের মারধর, জাল, মাছ ও অন্যান্য রসদ কেড়ে নেয়। সাগরে যেসব পয়েন্টে ইলিশের বিচরণ বেশি, সেগুলো ভারতীয়রা এরই মধ্যে দখল করেছে।বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য ঘাটের কাছে সাগরে বাংলাদেশের একটি মাছ ধরার ট্রলারবাংলাদেশে ইলিশ সুরক্ষায় তিন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর মধ্যে অক্টোবরে ২২ দিন। এ সময় মা মাছের ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর বাচ্চা হলে তার সুরক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাস নিষেধাজ্ঞা থাকে। মাছের বৃদ্ধির জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই আবার এক দফায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা থাকে। 

বাংলাদেশে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞা থাকে। ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। ১৫ জুন শুরু হয় তাদের মাছ ধরা। ওই সময় বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ে। ফলে ভারতীয় জেলেরা তখন একচ্ছত্রভাবে সাগরে মাছ ধরে। 

এবারও নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় অন্তত তিন হাজার মাছ ধরার ট্রলার ইলিশ ধরতে সমুদ্রে নামে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে ইলিশ ধরা পড়ে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে। 

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আমাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময়গুলো যেন ভারত ও বাংলাদেশে একসাথে দেয়া হয়। বর্তমান সরকার ড. ইউনুসের কাছে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।’ 

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গভীর সাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ ও ইলিশ আহরণের অভিযোগ আমি বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। দাপ্তরিক অভিযোগ এখনও পাইনি।;

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, কয়েক বছর সাগরে জলদস্যুর উপদ্রব না থাকলেও, ভারতীয় জেলেদের আতঙ্কে আছেন বাংলাদেশিরা। শক্তিশালী ও উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে তারা বাংলাদেশের ছোট ছোট ট্রলারে ধাক্কা দেয়, যেখানে জাল পাতা, তার ওপর দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রলার চালিয়ে কেটে দেয়। অভিযানে গেলে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা ভারতের জলসীমায় পালিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

দক্ষিণ স্টেশন কোষ্টগার্ড ভোলা জোনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশীয় জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ ঘটনা রয়েছে। তবে সামনের দিনগুলোতে আমরা আরো কঠোর হয়ে টহল জোরদার করব।’

তিনি বলেন, ‘ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ আমরা আর নিতে চাই না। এজন্য গভীর সমুদ্রে জাহাজের পাশাপাশি স্পেশাল টহলের জন্য ইতিমধ্যে অতিরিক্ত শক্তিশালী ট্রলার ও স্পিডবোট প্রস্তুত করা হয়েছে এবং অভিযান চলমান রয়েছে।’

আরও পড়ুন:–

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঋণের ১৩০০ কোটির এক টাকাও দেননি হলিডে ইনের মালিক

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

গণ–সমাবেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিলেন বিএনপি নেতা

হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যু, সেনা ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত