Ajker Patrika

আকবর আলি খান: শ্রমলব্ধ লেখকের প্রতিকৃতি

রাজু নূরুল
আকবর আলি খান: শ্রমলব্ধ লেখকের প্রতিকৃতি

২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগে ড. আকবর আলি খান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। সে সময় দেশের গণতন্ত্রের সীমাহীন ক্রান্তিলগ্নে তিনিসহ আরও কয়েকজন উপদেষ্টার দৃঢ় অবস্থান দেশের আপামর জনতার মতো আমাকেও মুগ্ধ করেছিল। পদত্যাগের সংস্কৃতিহীন বাংলাদেশে পদত্যাগের মাধ্যমে দেশকে এক কঠিন সংকট থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁরা; যা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অনার্স শেষ হয়েছে কেবল, মাস্টার্সের ক্লাস শুরুর জন্য অপেক্ষা করছি। পদত্যাগী উপদেষ্টাদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা গুণগ্রাহী লেখা ছাপা হয়। সেসব পড়েই আকবর আলি খান বিষয়ে আগ্রহের জন্ম। ধীরে ধীরে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় হতে থাকলাম। সে পরিচয়পর্ব আজও চলছে। 

প্রথম পড়েছিলাম, ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’। আমি নিজে অর্থনীতির ছাত্র। তত দিনে জেনেছি, অর্থনীতি মানেই হিসাব-নিকাশ, নানা গাণিতিক সূত্র আর থিউরির সন্নিবেশ। যেসব থিউরির প্রায় সবই শুরু হয় ‘ধরি’ বা ‘মনে করি’ দিয়ে। ফলে আকবর আলি খান পড়ে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলাম। অর্থনীতির মতো আপাত দাঁতভাঙা একটা বিষয়কে নিতান্ত হাস্যরসের মাধ্যমে কত সহজে উপস্থাপন করা যায়, ১৫টি অতি সুখপাঠ্য প্রবন্ধের মাধ্যমে আকবর আলি খান তা দেখিয়েছিলেন। বইটি পড়লে অর্থনীতির নানা খুঁটিনাটি তো বটেই; এই কঠিন বিষয় সম্পর্কে যে কারও গভীর আগ্রহ যে তৈরি হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আরও পরে, উন্নয়ন খাতে কাজ শুরু করার বেশ কিছু বছর পরে, বইটি দ্বিতীয়বার হাতে নিয়েছি। উন্নয়ন আর সুশাসনের নানা সংকট বুঝতে বইটির নানা অংশ পুনঃপাঠ করেছি। মনে হয়েছে, উন্নয়ন অর্থনীতিতে আগ্রহ আছে, এমন যে কারও জন্য এই বই অবশ্যপাঠ্য। 

প্রশ্ন জেগেছে, হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করলে অর্থনীতির মতো এত সিরিয়াস একটা বিষয় লঘু হয়ে যায় কি না! বিষয়বস্তুর গুরুত্ব কি খাটো হয়ে আসে? এর উত্তরও আকবর আলি খান ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে দিয়েছেন। উত্তরের জন্য রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়েছেন, ‘আমারে পাছে সহজে বোঝ, তাইতো এত লীলার ছিল; বাহিরে যার হাসির ছটা, ভিতরে তার চোখের জল।’ তাঁর মতে, ‘হালকা ও চটুল ভঙ্গি অর্থনীতির বক্তব্যকে লঘু করে দেয় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে গভীরতর দ্যোতনা দেয়। তিনি লিখেছেন, ‘অর্থনীতির দুজ্ঞেয় তত্ত্ব ও দুর্বোধ্য পদ্ধতি রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের মধ্যে প্রবল অনীহা সৃষ্টি করে। ফলে বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদের অবস্থা রবীন্দ্রনাথের “বিদায় অভিশাপ” কবিতার অভিশপ্ত কচের মতো; তারা যা শিখেছেন তা প্রয়োগ করতে পারেন না। উদাহরণের জন্যও তিনি কৌতুকের আশ্রয় নিয়েছেন, লিখছেন, একবার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তাঁর একটি প্রিয় প্রকল্পের দুর্বলতা বোঝাতে গিয়ে “অপরচুনিটি কস্ট” (বিকল্পের নিরিখে ব্যয়) সম্পর্কে কিছু বক্তব্য পেশের চেষ্টা করেছিলাম। কর্মকর্তাটি রেগে বললেন, “অপরচুনিস্ট” (সুবিধাবাদ) তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।’

বইটিরই একটি প্রবন্ধের নাম ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’। এই প্রবন্ধে তিনি ব্রিটিশ আমলের আসানসোলের মহকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটের কথা লিখেছেন। মাইকেল ক্যারিট তাঁর সঙ্গে এক পাঞ্জাবি ঠিকাদারের কথোপকথন বর্ণনা করেছেন এভাবে, সেই পাঞ্জাবি ঠিকাদার বলেছিল, হুজুর, এ দেশে তিন ধরনের মানুষ আছে। যারা ঘুষ খায় না। যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে। আর ৩ নম্বর দলে আছে কিছু শুয়োরের বাচ্চা, যারা ঘুষও খায় কিন্তু কাজ করে দেয় না। তাঁর মতে, শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি হলো, ৩ নম্বরও দলের লোকজন, যারা ঘুষ খেয়েও কাজ করে দেয় না। আর শুয়োরের বাচ্চাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হলো, যারা ঝাড়ু হাতে ফটোসেশন করলেও রাস্তাটা পরিষ্কার করে না। 

বইটা পড়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে তাঁর সব লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। নানা জনকে দেওয়া তাঁর প্রতিটা সাক্ষাৎকার, পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ, বিভিন্ন ঈদসংখ্যায় প্রকাশিক প্রবন্ধ খুঁজে খুঁজে পড়েছি, আর দারুণভাবে উপকৃত হয়েছি। তাঁর লেখা পড়ে উন্নয়নের সঠিক দিশা বুঝতে সহায়ক হয়েছে। বৈষম্য নিয়ে সম্যক ধারণা পেয়েছি। বছর কয়েক আগে একটি দৈনিক পত্রিকার ঈদসংখ্যায় দুনিয়াজুড়ে চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ে একটা প্রবন্ধ ছাপা হলো, সেখানে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তান, কানাডা, যুক্তরাস্ট্র, যুক্তরাজ্যে প্রতিদিন কতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, তার সবিস্তার তুলে এনেছিলেন। জ্ঞান অনুসন্ধানে কতটা অন্তঃপ্রাণ হলে ওরকম একটা লেখা তৈরি করা যায়। হাস্যরস, কৌতুকপ্রধান কিংবা সর্বোপরি সুলেখকই শুধু নন, তিনি ছিলেন পরিশ্রমী লেখক। তাঁর প্রতিটি বই, সাক্ষাৎকার কিংবা নিবন্ধ তথ্য ও উপাত্তনির্ভর। এ ক্ষেত্রে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা যে তাঁকে সহযোগিতা করেছিল সেটা তাঁর বয়ানেই জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় সাতাশ বছর আগে আমি যখন কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে এমএ পড়তে যাই, তখন আমার শিক্ষকদের কণ্ঠে গণিত বিনা কোনও গীত ছিল না। তাই আমাকে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে অর্থনীতির বুলি (জারগান) ও দূরধিগম্য পদ্ধতি রপ্ত করতে হয়েছে।’ 

সমাজবিজ্ঞানের দুয়োরানী অর্থনীতিই আজকের সমাজবিজ্ঞানের সম্রাজ্ঞী। রাষ্ট্রচালনা থেকে ইতিহাস, জীবনযাপনের সর্বস্তরে অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ রাখে। অর্থনীতির বই মানে বিদেশি লেখকদের কঠিন ইংরেজিতে লেখা তত্ত্ব। বাংলায় অর্থনীতি পড়ার ইচ্ছে পোষণ যেন অপরাধতুল্য! অথচ জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক এরকম নানা বিষয় নিয়ে তিনি বাংলায় লিখেছেন, ‘আজব ও জবর আজব অর্থনীতি’। যে বইটির সূচিপত্র পাঠককে কৌতূহলোদ্দীপক করে তুলবে। বইটিতে সন্নিবেশ ঘটেছে ‘মিত্রপক্ষের গুলি: অনভিপ্রেত পরিণামের অর্থনীতি’, ‘সুখের লাগিয়া’, ‘জন্মদিনের অর্থনীতি’ নামের দারুণ সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। 

দারিদ্র্য নিয়ে সুসংবাদ হলো, ১৯৯০ সালে বিশ্বে ৫৫.১ শতাংশ মানুষ সহনীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০১৫ সালে এ হার ২৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দুঃসংবাদ হলো, ২০১৫ সালে পৃথিবীতে ১৯৩ কোটি মানুষ ছিল দরিদ্র, অথচ ১৯০০ সালে সারা দুনিয়ার জনসংখ্যাই ছিল ১৬৫ কোটি। ফলে সম্পূর্ণ দারিদ্র্য বিমোচন এখনো বহু দূরে। এসব নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’। গোটা বইয়ে যে পরিমাণ তথ্য ও উপাত্ত তিনি হাজির করেছেন, তা দেখে খানিকটা আন্দাজ করা যায়, কতটা শ্রমলব্ধ লেখক ছিলেন তিনি। 

শুধু অর্থনীতির বই নয়, সাহিত্যের আরও নানা শাখায় তিনি সাবলীল ছিলেন। যেমন ‘দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন নিয়ে নানা রকম অপপ্রচার আছে। একদল যেমন রবীন্দ্রনাথকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক মনে করে, ঠিক আরেক দল আছে যারা মনে করে রবীন্দ্রনাথ অতিমূল্যায়িত হয়েছেন, তারা মনে করে, রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চলমান অপপ্রচারগুলো তালিকাবদ্ধ করেছেন বইটিতে। তারপর নানা ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে সাতটি প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চলমান অপপ্রচারের সারবত্তা নেই। আবার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যারা অতিভক্তি দেখায়, তাদের জন্য আছে আরও সাতটি প্রবন্ধ। আবার জীবনানন্দ দাশের বনলতা কবিতার বই নিয়ে লিখেছেন, ‘চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন’। 

২০২২ সালের বইমেলায় ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ নামে তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে। বেশ ঢাউস সাইজের বই। দামও বেশ চড়া। অথচ এই বইটি এবারের মেলায় প্রকাশিত সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় বইগুলোর অন্যতম। নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে সম্ভবত সবচেয়ে বিক্রীত বই ছিল এটি। লেখক হিসেবে তিনি কতটা অনন্য ছিলেন, পাঠকের কতখানি কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, এটিই তার প্রমাণ। বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড আসবে, যেখানে ৭৫-পরবর্তী সময়ের নানা কথা থাকবে। তবে সেটি প্রকাশিত হবে তাঁর মৃত্যুর পরে, কারণ জীবদ্দশায় সব কথা বলে যাওয়া সম্ভব নয়। যদিও প্রবল আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষা করেছি; কিন্তু আরও বহু দিন তাঁকে পেতে চেয়েছে দেশ। 

 লেখক হিসেবে শুধু অর্থনীতির বই নয়, তার রয়েছে আরও অসামান্য সব কাজ। আকবর আলি খানের বইসমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ঐতিহাসিক উত্থান নিয়ে প্রামাণ্য দলিল। বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তন এবং এ দেশে ইসলামের বিকাশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণালব্ধ লেখা আছে তাঁর।

সুলেখকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সংগঠকও। ৭১-পূর্ববর্তী সময়ে তিনি সর্বদাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের সমর্থক। ২৫ মার্চের কালরাতের পর যখন অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়নি, তখনই হবিগঞ্জে পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করেন তিনি। নিজ হাতে তৈরি করেন অস্ত্র উন্মুক্তকরণের সরকারি লিখিত অনুমতি। অস্থায়ী সরকারের জন্য তহবিল গড়তে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩ কোটি টাকা ট্রাকে করে আগরতলা পৌঁছে দেন। বাঙালির চেতনা ও অহংকারের মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতার সঙ্গে কর্তব্য পালনে পিছপা হননি। 

এই যে প্রবল উচ্চকণ্ঠ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাওয়া, অকপটে সত্য কথা বলা,  সরকারের খোলাখুলি সমালোচনা করা, এটা বোধ হয় তাঁর মতো এ দেশে আর কেউ করেননি। জেনেছি, একজন মানুষ কতখানি দেশপ্রেমিক হতে পারে, কতটা সৎ হলে কেউ বলতে পারেন যে, ‘আমি সত্য বলতে চেষ্টা করি।’

চাকরিজীবনের শেষের দিকে এসে লেখায় মনোনিবেশ করেন। অবসরের পর তাঁর আবির্ভাব ঘটে পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে। গত কয়েক বছর নিজ হাতে লিখতেও পারতেন না। হাত কাঁপত। শ্রুতলিখনের সাহায্য নিয়েছেন। যদি আরও আগে লেখা শুরু করতেন, যদি সুস্থ থাকতেন, তবে আরও দারুণ সব কাজ উপহার দিয়ে যেতেন নিঃসন্দেহে। 

আকবর আলি খানের মৃত্যুতে স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছি। একজন পাঠক হিসেবে তাঁর কাছ থেকে যা পেয়েছি, সে অনন্য; এ ঋণ শোধের সাধ্য নেই। তাঁর লেখা পড়লে আমাদের বারবার মনে পড়বে যে, একজন লেখক কতটা পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান হতে পারেন। মনে করিয়ে দেবে, কীভাবে প্রচলিত চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হয়। যেকোনে প্রতিকূলতায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে তাঁর লেখা বইগুলোর কাছে বারবার ফেরত যেতে হবে আমাদের। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, তাঁর মতো এক গুণীকে তার ঔরসে ধারণ করেছে। এক গুণমুগ্ধ পাঠকের পক্ষ থেকে শত সহস্র প্রণতি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১০
সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।

লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।

লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।

‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।

এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত