Ajker Patrika

আলী ইমামের জন্য ভালোবাসা

আনজীর লিটন
আলী ইমামের জন্য ভালোবাসা

তাঁর সঙ্গে প্রথম কবে কোথায় দেখা হয়েছে, স্মৃতি হাতড়ে খোঁজার চেষ্টা করছি। কোথায় দেখা হলো? ময়মনসিংহে? ঢাকায়? বিটিভিতে? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে? খেলাঘরে? কচি-কাঁচার আসরে? নাকি কিশোর বাংলা অফিসে? মনে পড়ছে না।

তবে মনে পড়ছে তাঁর প্রবাল দ্বীপের আতঙ্কের কথা। কালো রঙের প্রচ্ছদে বোর্ড বাঁধাই এ বইটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছড়াকার সরকার জসীম। তিরাশি-চুরাশি সাল হবে। অথবা আরও পরের কোনো বছর। ঘটনাটি লিখে রাখিনি বলে স্মৃতিগুলো অস্পষ্ট হয়ে আছে। তবু মনে পড়ছে, আমি তখন নবীন লেখকদের একজন। কৌতূহলী মন নিয়ে ঘুরে বেড়াই। যা পাই, তা-ই পড়ি। পড়ার জন্য বই খুঁজি। ময়মনসিংহ শহরের পাবলিক লাইব্রেরি, মুসলিম স্কুল পাঠাগার আর স্টেশন রোডের গসপেল হল—এই ছিল সেই সময়ের ময়মনসিংহ শহরের পাঠকেন্দ্র।

মনে পড়ছে জসীম ভাইয়ের বাউন্ডারি রোডের বাসায় কোনো এক বিকেলে আলী ইমামের বই পড়তে দিলেন আমাকে। পড়লাম। প্রবাল দ্বীপ চিনলাম। সাগর চিনলাম।

সাগরের ঢেউ চিনলাম। সেই উত্তাল ঢেউয়ের ছবি বুকে ধরে আলী ইমামকে খুঁজে পেলাম বইয়ের পাতায়, পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, বিটিভির অনুষ্ঠান শেষে চমৎকার হাতে লেখা টাইপোগ্রাফিতে ভেসে উঠতে দেখলাম প্রযোজনা আলী ইমাম। তত দিনে আরও পড়লাম ‘অপারেশন কাঁকনপুর’, ‘তিতিরমুখী চৈতা’। ‘আলী ইমাম’-এ নামটি আস্তে আস্তে আমার মনকে রঙিন করে তুলতে লাগল।

স্মৃতি থেকে ভেসে এল একটা দৃশ্য। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে কোনো এক অনুষ্ঠানে আমার পঠিত ছড়া নিয়ে চমৎকার উৎসাহব্যঞ্জক কথা বললেন।

নবীন-লেখকদের প্রতি দরদমাখা প্রশংসা যেন প্রশংসা ছিল না, ছিল হাত বাড়িয়ে হাতটি ধরা। পরে দেখেছি এটিই তাঁর বৈশিষ্ট্য। নবীনদের কাছে টেনে নিতে জানতেন।

কাউকে নিরুৎসাহিত করতেন না। একটা দুর্বল লেখাকে সবল করে তোলার জন্য এমন সব উদ্দীপনামূলক বাক্য ব্যবহার করে উৎসাহ জোগাতেন—যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে, তারা জানে। আর তাই তো আধুনিক শিশুসাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আলী ইমাম।

আধুনিক শিশুসাহিত্যে সারথি আলী ইমাম। সুবিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন শব্দের জাদু দিয়ে। বাক্যের বুননে চিনিয়েছেন বাংলার অপরূপ ভাষার সৌন্দর্য। বৈচিত্র্যময় বিষয় তাঁর সুলিখিত রচনাগুলো হয়ে উঠল শিশুসাহিত্যের সম্পদ। এই সম্পদ আঁকড়ে ধরে আমরা আলী ইমামকে নিয়ে খুলছি শোক বইয়ের পাতা।

তিনি নেই। চিরতরে বিদায় নিলেন ২১ নভেম্বর, ২০২২। সেদিনের সন্ধ্যা স্তব্ধ করে দিল আমাদের চারপাশ। কী বিষণ্ন এক মুহূর্ত আমাদের জাপটে ধরল খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

তিনি আর হাঁটবেন না। তিনি আর লিখবেন না। তিনি আর কথা বলবেন না, স্বাক্ষর দেবেন না। তাহলে তিনি কোথায় থাকবেন? থাকবেন পাঠকের অন্তরে, বইয়ের পাতায় এবং শিশুসাহিত্যের শাখা-প্রশাখায়।

শিশুসাহিত্যের প্রতি দরদমাখা স্পর্শ ছিল তাঁর। যেমন তাঁর ব্যক্তিত্ব, তেমনি তাঁর লেখার শক্তি। দুইয়ে মিলে আলী ইমামকে এমন এক লেখকসত্তা দিয়েছে, যা তাঁকে বানিয়েছে শিশুসাহিত্যের রত্নখনি।

গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণা, প্রকৃতি, পশুপাখি, চলচ্চিত্র—প্রতিটি বিষয় তিনি শিশুসাহিত্যের পাতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। সমৃদ্ধ করেছেন শিশুসাহিত্যের ভান্ডার; যা কখনোই ফুরানোর নয়। দৃঢ়চিত্তে বলতে দ্বিধা নেই, বাঙালির যে ঘরে শিশুকিশোর রয়েছে, সেই ঘরে আছেন আলী ইমাম। বুকশেলফের কোনো এক তাকে শোভা পায় তাঁরই গ্রন্থ।

আলী ইমাম এমনই একজন অনিবার্য শিশুসাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন, যাঁকে পাঠ করতেই হবে। তাঁর রচনার জাদুকরি শব্দ বুননের স্পর্শে বাংলার প্রকৃতি হেসে ওঠে। বৈশাখ, নবান্ন, হেমন্ত, শিশির, ঘাসবিচালি, পাখ-পাখালি, আকাশ-চন্দ্র-সূর্য, তারা-নক্ষত্র-গ্রহ—কোনো কিছুই এড়ায়নি আলী ইমামের চোখ থেকে।

বাদুড়ের নীল নখ খুঁজে বেড়ানো কিশোরের কৌতূহলী মন তিনি যেমন ধরতে পেরেছিলেন, তেমনি ধরতে পেরেছেন কল্পবিজ্ঞানের যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্যমালা কিংবা রহস্যভরা গোয়েন্দাগিরির শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাডভেঞ্চার।

আলী ইমামের নিজস্ব একটা পাঠক মহল আছে। এই মহলে বাস করেন তরুণ থেকে বৃদ্ধরা। এই মহলে বসে স্বপ্নের রঙিন ঘুড়ি ওড়ায় কিশোর-কিশোরীর দল।

লোকজ ঐতিহ্য লালন করার মধ্য দিয়ে এ দেশের শিশুকিশোর পাঠকদের জন্য আলী ইমাম নিষ্ঠার সঙ্গে রচনা করেছেন দেশ-মহাদেশের গল্প এবং ছন্দময় বিষয়-আশয়।

বাঙালির আবেগঘন গর্বিত উচ্চারণে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি চেতনা, বারবার নতুন স্পন্দনে জেগে উঠেছে আলী ইমামের কলমে। বিদেশি শিশুসাহিত্যও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে।

তিনি যখন হ্যান্ডস অ্যান্ডারসনের কথা বলেন, মনে হয় অ্যান্ডারসনের বাড়িতে বসে আছি। তিনি যখন সুকুমার রায়কে চিনিয়ে দেন, মনে হয় ওই তো, সুকুমার রায় দাঁড়িয়ে।

ঈশ্বরচন্দ্র, অবন ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, জসীমউদ্‌দীন তাঁদের জাদুকরি বর্ণনায় শিশুসাহিত্যের পাতায় পাতায় তুলে ধরতেন তিনি; শুধু তা-ই নয়, শিশুসাহিত্যবিষয়ক পত্র-পত্রিকা নিয়ে তাঁর ছিল বিস্তর গবেষণা। জাতীয় জাদুঘরের জন্য নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র। নিশ্চয়ই জাদুঘর কর্তৃপক্ষ মর্যাদার সঙ্গে এসব প্রামাণ্যচিত্র সংরক্ষণ করবে।

তিনি জন্মেছেন ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। স্থায়ীভাবে তাঁদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

লেখকসত্তার বাইরে তিনি কর্মময়কাল প্রবাহিত রেখেছিলেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

টেলিভিশনের পর্দায় এনে দিয়েছেন শুদ্ধ ভাষা ও উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান। শিশুসাহিত্যের পাতায় যেমন উজ্জ্বল তিনি, তেমনি টেলিভিশন পর্দায় উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে হয়েছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। ইউনিসেফের মীনা কার্টুনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।

তাঁর প্রযোজিত অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’, ‘হ্যালো’, ‘আপনাকে বলছি’, ‘কুইজ-কুইজ সুখী পরিবার’, ‘পুষ্টি তথ্য’, ‘শিশুর অধিকার নিশ্চিত এবং সুরক্ষা’বিষয়ক অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

ছড়ায় ছন্দ দিয়ে অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট আমাকে দিয়ে লেখাতেন তিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ শিক্ষাটা লাভ করেছি তাঁর কাছ থেকেই।

ছয় শর বেশি বই লিখে আলী ইমাম এক বিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন। দুঃখকে আড়াল করতে জানতেন। কাজকে ভীষণ ভালোবাসতেন। নিত্যনতুন সৃজনশীল উদ্ভাবনের মধ্যে ডুবে থাকতেন। যেমন লিখতেন, তেমনি পড়তেন।

তিনি যখন হাঁটতেন—হন হন করে হাঁটতেন। যখন কথা বলতেন, শুদ্ধ উচ্চারণে তথ্যের বাহারে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতেন। আর যখন লিখতেন,
তখন তাঁর লেখায় শব্দমালায় ঝরে পড়ত অপূর্ব এক কোমলতা। পুকুরজলের তিরতির করা ঢেউ, বুনো হাঁসের ডিম, রূপকথার রাজ্যের ডালিমকুমার—এমন এক 
আবহ তৈরি করে দেয়, যা পাঠকদের নিয়ে যায় আবহমান বাংলার চিরচেনা প্রকৃতির কাছে।

প্রকৃতির কোলজুড়ে তখন নেমে আসে একরাশ স্নিগ্ধতা। পাঠকের অনুভূতিতে তৈরি হয় অপূর্ব এক মুগ্ধতা।

আমরা আলী ইমামের মুগ্ধ পাঠক। জীবনভর বয়ে বেড়াব আলী ইমামের সান্নিধ্যের স্মৃতিকথা। বারবার পাঠ করব তাঁকে। কিশোর মনের কৌতূহল মেটানো দুর্দান্ত সব মনকাড়া রচনা থেকে খুঁজব চাঁদ-তারা-জোনাকি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১০
সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।

লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।

লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।

‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।

এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত