নাজমুল ইসলাম
শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডবিহীন একটি প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষাবিহীন একটি জাতি সমৃদ্ধ হতে পারে না। রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। ফলে মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে পরিকল্পনাহীন এক কাঠামোর ওপর। এই কাঠামোর মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। ফলে সমস্যার অন্ত নেই।
‘পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে’—এই বাক্য ছোট সময়ে শোনেনি, এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের একধরনের ধারণা আছে। এই বাক্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা পুরোপুরি মিলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলে বড় চাকরি মিলবে। গাড়ি-বাড়ি হবে, পাওয়া যাবে সম্মান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পেছনে আমাদের এই আকাঙ্ক্ষাগুলোই থাকে। অথবা বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের ধারণাই এমন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে–এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটা খুবই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য হয় যখন চাকরিপ্রাপ্তি।
ছোট থেকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নের পেছনে থাকে বড় চাকরিপ্রাপ্তির প্রত্যাশা। কারণ, আমরা সমাজ থেকেই গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার সেই বাক্য শুনে এসেছি। ফলে আমরা তাই শিখেছি। সমাজ আমাদের শেখায় না—বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানে হলো জ্ঞানের চর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। অবশ্য এখানে সমাজের দোষ দিয়েও লাভ নেই। যেই সমাজে এখনো ৩০ শতাংশের মতো মানুষ নিরক্ষর, সেই সমাজের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা অস্বাভাবিক নয়। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রভাব তো আছেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর সময় অতিবাহিত করার পরও শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় কী—সেটা বুঝতে ব্যর্থ হয়, সেটা নিশ্চয়ই খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই ব্যর্থতার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চয়ই দায় আছে।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, অর্থায়ন ছাড়া শিক্ষা কাঠামোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই কম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে, এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষা খাতে বেশি ব্যয় করে।
বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে শিক্ষা বাজেট ছিল জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ।
জাতিসংঘের মতে, একটি দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। সেদিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ফলে উচ্চশিক্ষা খাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। আর নতুন জ্ঞান সৃজনের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণাকর্মেও বাজেটের পরিমাণ খুবই নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ৪৬ তম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে দেশের ১২৫টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে মোট ১৫৩ কোটি টাকা গবেষণা খাতে ব্যয় করে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গড় বার্ষিক ব্যয় ১ কোটি ২২ লাখ টাকা।
বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান শিক্ষা এ যুগে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব আমরা খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার তেমন হয়নি। বরং দিন দিন বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হচ্ছে। মাধ্যমিকে ১৯৯০ সালে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং উচ্চমাধ্যমিকে ছিল ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে ২২ দশমিক ৯২ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম।
সময়ের সঙ্গে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বাড়ছে। এ সমস্যা বাংলাদেশের মতো অন্য উন্নয়নশীল দেশেও। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: নতুন যুগের সন্ধানে’ বইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অতনু রব্বানী তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি বেশি মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়। ২০১১ সালের তথ্যানুযায়ী, মানবিক ও বাণিজ্যিক বিষয়সহ সামাজিক বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ৭৮ শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা একটা সুষম চিত্র দেখতে পাব। জার্মানিতে প্রায় ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ, ১৭ শতাংশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করে।’
এ তো গেল বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহের অবনমনের বিষয়টি। পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষাদান পদ্ধতিও মানসম্মত নয়। বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের গবেষণাগার প্রয়োজন, তা নেই। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। শিল্পক্ষেত্রে যে দক্ষতা প্রয়োজন, তা অর্জিত হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে উঁচু পদগুলো দখল করে আছে বিদেশিরা; বিশেষ করে শ্রীলঙ্কান ও ভারতীয়রা। ভারতীয়রা প্রতি বছর ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার আয় করে ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে লাখ লাখ তরুণ বেকার বসে আছে। শুধু উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে একদিকে আমাদের বেকারত্ব, অন্যদিকে দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার পরিমাণগত সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে উচ্চশিক্ষার শতকরা হার খুব বেশি নয়। সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। কিন্তু আমাদের দেশে চিত্র উল্টো। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে অনেকে উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের অধিকাংশই পড়াশোনা করছে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে। আমাদের দেশে এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে কাজ করার সুযোগ খুবই সীমিত। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান অনেক বেশি। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকপ্রতি শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় ২৬। উন্নত বিশ্বে অনুপাতের ব্যবধান অনেক কম। সুইজারল্যান্ডে একজন শিক্ষকপ্রতি ছাত্রের সংখ্যা ৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৪, চীনে ১৯ ও থাইল্যান্ডে ২০ জন।’ পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলা। এ কাজে পারদর্শী হওয়ার জন্য শিক্ষককে গবেষণা ও পড়াশোনা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের শিক্ষকের অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে অন্যান্য স্তরের মতো উচ্চশিক্ষা স্তরেও শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষককেন্দ্রিক। শিখনফল সবচেয়ে বেশি অর্জিত হয়, যখন শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু করার মাধ্যমে শেখে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই লেকচার পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে থাকে। এ পদ্ধতিতে শিখনফল অর্জনের মাত্রা সবচেয়ে কম। কারণ, এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ তেমন থাকে না। ফলে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাদান পদ্ধতিও একটি বড় সমস্যা। ফলে দেখা যায়, অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত তরুণের কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা নেই। ফলে কর্মজীবনে তাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দলীয় রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী—সেটাই মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মগজ থেকে বিলীয়মান। এ কথা শুনে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মগজ আছে নাকি? এ প্রশ্ন খুবই যৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মগজ নেই, মগজ আছে মানুষের। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে মানুষই জড়িত। তাঁদের তো মগজ আছে। তাঁরা মনে হয় ভুলেই গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? তাঁদের কাছে এখন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতির অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। দলীয় ছাত্রনেতাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল, মিটিং, রাজনীতিটাই মুখ্য, আর পড়াশোনাটা হলো গৌণ। এ নিয়ে সবিস্তারে এখানে বলাটা বাতুলতা মনে হতে পারে। তাই তা এড়িয়ে গিয়ে শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্রটির দিকেই তাকানো যাক পূর্ণ চোখে। সেখানে শুধুই নড়বড়ে দশা। শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে এখনো স্বীকার করা হয়, তবে বলতেই হয় জাতি এখন ভঙ্গুর ও নড়বড়ে এক মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডবিহীন একটি প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষাবিহীন একটি জাতি সমৃদ্ধ হতে পারে না। রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। ফলে মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে পরিকল্পনাহীন এক কাঠামোর ওপর। এই কাঠামোর মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। ফলে সমস্যার অন্ত নেই।
‘পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে’—এই বাক্য ছোট সময়ে শোনেনি, এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের একধরনের ধারণা আছে। এই বাক্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা পুরোপুরি মিলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলে বড় চাকরি মিলবে। গাড়ি-বাড়ি হবে, পাওয়া যাবে সম্মান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পেছনে আমাদের এই আকাঙ্ক্ষাগুলোই থাকে। অথবা বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের ধারণাই এমন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে–এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটা খুবই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য হয় যখন চাকরিপ্রাপ্তি।
ছোট থেকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নের পেছনে থাকে বড় চাকরিপ্রাপ্তির প্রত্যাশা। কারণ, আমরা সমাজ থেকেই গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার সেই বাক্য শুনে এসেছি। ফলে আমরা তাই শিখেছি। সমাজ আমাদের শেখায় না—বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানে হলো জ্ঞানের চর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। অবশ্য এখানে সমাজের দোষ দিয়েও লাভ নেই। যেই সমাজে এখনো ৩০ শতাংশের মতো মানুষ নিরক্ষর, সেই সমাজের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা অস্বাভাবিক নয়। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রভাব তো আছেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর সময় অতিবাহিত করার পরও শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় কী—সেটা বুঝতে ব্যর্থ হয়, সেটা নিশ্চয়ই খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই ব্যর্থতার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চয়ই দায় আছে।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, অর্থায়ন ছাড়া শিক্ষা কাঠামোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই কম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে, এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষা খাতে বেশি ব্যয় করে।
বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে শিক্ষা বাজেট ছিল জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ।
জাতিসংঘের মতে, একটি দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। সেদিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ফলে উচ্চশিক্ষা খাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। আর নতুন জ্ঞান সৃজনের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণাকর্মেও বাজেটের পরিমাণ খুবই নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ৪৬ তম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে দেশের ১২৫টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে মোট ১৫৩ কোটি টাকা গবেষণা খাতে ব্যয় করে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গড় বার্ষিক ব্যয় ১ কোটি ২২ লাখ টাকা।
বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান শিক্ষা এ যুগে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব আমরা খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার তেমন হয়নি। বরং দিন দিন বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হচ্ছে। মাধ্যমিকে ১৯৯০ সালে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং উচ্চমাধ্যমিকে ছিল ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে ২২ দশমিক ৯২ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম।
সময়ের সঙ্গে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বাড়ছে। এ সমস্যা বাংলাদেশের মতো অন্য উন্নয়নশীল দেশেও। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: নতুন যুগের সন্ধানে’ বইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অতনু রব্বানী তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি বেশি মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়। ২০১১ সালের তথ্যানুযায়ী, মানবিক ও বাণিজ্যিক বিষয়সহ সামাজিক বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ৭৮ শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা একটা সুষম চিত্র দেখতে পাব। জার্মানিতে প্রায় ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ, ১৭ শতাংশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করে।’
এ তো গেল বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহের অবনমনের বিষয়টি। পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষাদান পদ্ধতিও মানসম্মত নয়। বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের গবেষণাগার প্রয়োজন, তা নেই। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। শিল্পক্ষেত্রে যে দক্ষতা প্রয়োজন, তা অর্জিত হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে উঁচু পদগুলো দখল করে আছে বিদেশিরা; বিশেষ করে শ্রীলঙ্কান ও ভারতীয়রা। ভারতীয়রা প্রতি বছর ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার আয় করে ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে লাখ লাখ তরুণ বেকার বসে আছে। শুধু উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে একদিকে আমাদের বেকারত্ব, অন্যদিকে দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার পরিমাণগত সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে উচ্চশিক্ষার শতকরা হার খুব বেশি নয়। সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। কিন্তু আমাদের দেশে চিত্র উল্টো। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে অনেকে উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের অধিকাংশই পড়াশোনা করছে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে। আমাদের দেশে এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে কাজ করার সুযোগ খুবই সীমিত। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান অনেক বেশি। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকপ্রতি শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় ২৬। উন্নত বিশ্বে অনুপাতের ব্যবধান অনেক কম। সুইজারল্যান্ডে একজন শিক্ষকপ্রতি ছাত্রের সংখ্যা ৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৪, চীনে ১৯ ও থাইল্যান্ডে ২০ জন।’ পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলা। এ কাজে পারদর্শী হওয়ার জন্য শিক্ষককে গবেষণা ও পড়াশোনা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের শিক্ষকের অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে অন্যান্য স্তরের মতো উচ্চশিক্ষা স্তরেও শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষককেন্দ্রিক। শিখনফল সবচেয়ে বেশি অর্জিত হয়, যখন শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু করার মাধ্যমে শেখে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই লেকচার পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে থাকে। এ পদ্ধতিতে শিখনফল অর্জনের মাত্রা সবচেয়ে কম। কারণ, এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ তেমন থাকে না। ফলে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাদান পদ্ধতিও একটি বড় সমস্যা। ফলে দেখা যায়, অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত তরুণের কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা নেই। ফলে কর্মজীবনে তাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দলীয় রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী—সেটাই মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মগজ থেকে বিলীয়মান। এ কথা শুনে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মগজ আছে নাকি? এ প্রশ্ন খুবই যৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মগজ নেই, মগজ আছে মানুষের। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে মানুষই জড়িত। তাঁদের তো মগজ আছে। তাঁরা মনে হয় ভুলেই গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? তাঁদের কাছে এখন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতির অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। দলীয় ছাত্রনেতাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল, মিটিং, রাজনীতিটাই মুখ্য, আর পড়াশোনাটা হলো গৌণ। এ নিয়ে সবিস্তারে এখানে বলাটা বাতুলতা মনে হতে পারে। তাই তা এড়িয়ে গিয়ে শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্রটির দিকেই তাকানো যাক পূর্ণ চোখে। সেখানে শুধুই নড়বড়ে দশা। শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে এখনো স্বীকার করা হয়, তবে বলতেই হয় জাতি এখন ভঙ্গুর ও নড়বড়ে এক মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
মিয়ানমারে জান্তা বাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেই ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি ও কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে গত ২৪ জুলাই মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কিছু ব্যক্তি ও কোম্পানির ওপর...
৪ ঘণ্টা আগে১৫৮ বছর আগে মাত্র ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রি করে দিয়েছিল রাশিয়া। আর ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানসূত্র খুঁজতে সেখানেই বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন ট্রাম্প-পুতিন। মার্কিন মুল্লুকের এত সব জৌলুস এলাকা বাদ দিয়ে কেন এই হিমশীতল অঙ্গরাজ্য আলাস্কাকে বেছে নেওয়া হলো? এর পেছনে রহস্য কী?
১৬ ঘণ্টা আগেট্রাম্প মনে করছেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব দিয়ে সরাসরি আলোচনায় ক্রেমলিনকে যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে রাজি করানো সম্ভব। ছয় মাসের স্থবিরতার পর ট্রাম্প-পুতিনের মুখোমুখি বৈঠক হয়তো ক্রেমলিনকে যুদ্ধ থামাতে রাজি করাতে পারে, কিন্তু পুতিন সম্প্রতি স্পষ্ট করেছেন, তাঁর কাছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের জনগণ এক এবং যেখানে রুশ
২ দিন আগেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের ফলে ভারত এক গুরুতর বাণিজ্য সংকটের মুখে পড়েছে। যদি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে, যা ভারতের রপ্তানি খাতকে প্রায় অচল করে দিতে পারে। ভারত এখন আলোচনার জন্য ট্রাম্পের কাছে ভারত
৩ দিন আগে