সুমিত গাঙ্গুলি
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হয়। সেই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে কোনো পাকিস্তানি বাণিজ্যিক জাহাজ নোঙর করেনি। পাঁচ দশকের বিরতির পর গত মাসে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নোঙর করে। এই জাহাজের আগমন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ঢাকা এরই মধ্যে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র–গোলাবারুদের ক্রয় বাড়িয়েছে এবং পাকিস্তানি আমদানির ক্ষেত্রে সশরীরে সম্পূর্ণ কাস্টমস পরিদর্শনের প্রথা বাতিল করেছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাস আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই পরিবর্তনগুলো দ্রুত ঘটছে। গত আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার সম্মতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন। হাসিনা তাঁর শেষ দুই মেয়াদে ভারত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। (হাসিনা বর্তমানে নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং ঢাকা সম্প্রতি ইন্টারপোলকে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে।)
আন্দোলনের মুখে হাসিনার পতন ভারতের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই শীতল ছিল। ফলে, এখন বাংলাদেশে বন্ধুপ্রতিম শক্তির অভাব অনুভব করছে ভারত, যদিও ড. ইউনূস দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো রাখার আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের পাকিস্তানের প্রতি সদয় মনোভাব ভারত–বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে এখন যা ঘটছে, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের ভাষায় ‘পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস’ বলা হয়। এ ধরনের পরিবর্তন সাধারণত দুটি কারণে ঘটে: বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন যা একটি দেশকে তার অগ্রাধিকার ও কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তন। দ্বিতীয় কারণটি সম্ভবত ঢাকার পররাষ্ট্রনীতির অভিমুখে নাটকীয় পরিবর্তন আনছে। যার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে নয়াদিল্লির ওপর।
হাসিনার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে একটি পরস্পরনির্ভর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। হাসিনা বাংলাদেশের ইসলামি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে আশ্রয় দেননি এবং ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অন্য দিকে, দিল্লি হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংকট উপেক্ষা করেছে, বাংলাদেশকে ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার দিয়েছে এবং আন্তসীমান্ত রেল ও সড়ক সংযোগ বাড়িয়েছে।
এত কিছুর পরও কিছু অন্তর্নিহিত টানাপোড়েন—দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কিত—এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিঘ্নিত করেছে। হাসিনার বিদায়ের পর এই পার্থক্যগুলো আরও বড় হয়ে সামনে আসছে, যা উভয় পক্ষকে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত অগ্রাধিকার পুনর্বিবেচনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
নয়াদিল্লি বা ঢাকায় ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশিদের অনিয়মিত অভিবাসন সব সময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল। এই বিষয়টি আরও বেশি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে। হাসিনার শাসনামলেও, ঢাকা এই বিষয়টি সমাধানে অনিচ্ছুক ছিল। বিজেপি বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যুতে বিজেপির অনড় অবস্থান মূলত ধর্মীয় পরিচয় ও ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এখন উত্তেজনা আরও বাড়ছে। গত নভেম্বরে বাংলাদেশে এক হিন্দু সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার (যিনি ইসকনের সাবেক নেতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার) এবং এর পরবর্তী বিক্ষোভের ঘটনায়, উভয় দেশই নিজেদের সীমার মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগে একে অপরকে দোষারোপ করেছে। যদি বাংলাদেশি হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় চায়, তবে অভিবাসন সমস্যা আরও জটিল রূপ নিতে পারে। বিজেপি সরকার এই অভিবাসীদের আশ্রয় দেবে, পাশাপাশি বাংলাদেশকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করবে।
চাপে পড়ে ঢাকা অবশ্যই ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি আচরণের জন্য নয়াদিল্লিকে দোষারোপ করবে—যা শত্রুতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। এই শত্রুতা ভুল তথ্যের কারণে আরও তীব্র হচ্ছে। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, এমনকি ঘটনাগুলোকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে তুলে ধরেছে।
আরেকটি বিষয়, যেখানে দুই পক্ষ একমত হতে পারেনি, তা হলো—তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, যদিও ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ মেটেনি। এই ইস্যুটি বিশেষভাবে জটিল। কারণ, বিজেপি সরকার সমাধানে আগ্রহী থাকলেও বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তির জন্য একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে, নয়াদিল্লিতে যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কিছু দিক দীর্ঘদিন ধরেই ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। এর মধ্যে একটি হলো—বাংলাদেশে ইসলামপন্থী উগ্রপন্থার উত্থান এবং এর নেতিবাচক প্রভাব, বিশেষত দেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যারা সহায়তা করেছে, তাদের মধ্যে ইসলামপন্থী এবং ভারতবিরোধী গোষ্ঠীগুলোও রয়েছে, যারা এখন উল্লসিত। সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি থাকার পরও ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ও আশঙ্কাগুলো সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে।
ভারত নিজ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্ভাব্য সংক্রমণ নিয়েও উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিমদের ক্ষেত্রে। ভারতের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) বহুদিন ধরে এসব পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। বিজেপির মূল সমর্থন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বাংলাদেশের হিন্দুদের ব্যাপারে মোদি সরকারকে উদাসীন মনে হলে তা বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। তবে আপাতত, ভারতের পক্ষে কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের নিন্দা জানানো এবং বক্তৃতা–বিবৃতির মাধ্যমে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। কারণ, যে কোনো ধরনের উত্তেজনা বৃদ্ধি নিশ্চিতভাবে বিজেপির জন্য বুমেরাং হবে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে এবং নির্বাচনের পর বিএনপি নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির অতীতের ঝামেলাপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচের স্তরে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতির পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে ভারতের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি সীমিত হয়ে পড়তে পারে।
যদি বাংলাদেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী অতীতের মতো বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে, তবে পররাষ্ট্রনীতির এই পুনর্বিন্যাস পুরোপুরি বাস্তবে রূপ নিতে পারে। ভারতের আশঙ্কা একটি ক্রমবর্ধমান বৈরী প্রতিবেশীর রূপ ধারণ করতে পারে। এই সম্ভাব্য পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য ভারতের হাতে তেমন কার্যকর হাতিয়ার নেই। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার ওপর বাড়াবাড়ি নির্ভরতা, অন্য দল ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে উপেক্ষা করার কারণে ভারত নিজেকে এই অস্বস্তিকর অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
লেখক: সুমিত গাঙ্গুলি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির হুভার ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়ার। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—‘ইন্ডিয়ান ফরেন পলিসি’, ‘সিনো–ইন্ডিয়ান রাইভালরি’, ইন্ডিয়া–পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য বম্ব’।
অনুবাদ: আব্দুর রহমান
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হয়। সেই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে কোনো পাকিস্তানি বাণিজ্যিক জাহাজ নোঙর করেনি। পাঁচ দশকের বিরতির পর গত মাসে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নোঙর করে। এই জাহাজের আগমন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ঢাকা এরই মধ্যে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র–গোলাবারুদের ক্রয় বাড়িয়েছে এবং পাকিস্তানি আমদানির ক্ষেত্রে সশরীরে সম্পূর্ণ কাস্টমস পরিদর্শনের প্রথা বাতিল করেছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাস আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই পরিবর্তনগুলো দ্রুত ঘটছে। গত আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার সম্মতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন। হাসিনা তাঁর শেষ দুই মেয়াদে ভারত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। (হাসিনা বর্তমানে নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং ঢাকা সম্প্রতি ইন্টারপোলকে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে।)
আন্দোলনের মুখে হাসিনার পতন ভারতের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই শীতল ছিল। ফলে, এখন বাংলাদেশে বন্ধুপ্রতিম শক্তির অভাব অনুভব করছে ভারত, যদিও ড. ইউনূস দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো রাখার আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের পাকিস্তানের প্রতি সদয় মনোভাব ভারত–বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে এখন যা ঘটছে, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের ভাষায় ‘পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস’ বলা হয়। এ ধরনের পরিবর্তন সাধারণত দুটি কারণে ঘটে: বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন যা একটি দেশকে তার অগ্রাধিকার ও কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তন। দ্বিতীয় কারণটি সম্ভবত ঢাকার পররাষ্ট্রনীতির অভিমুখে নাটকীয় পরিবর্তন আনছে। যার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে নয়াদিল্লির ওপর।
হাসিনার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে একটি পরস্পরনির্ভর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। হাসিনা বাংলাদেশের ইসলামি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে আশ্রয় দেননি এবং ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অন্য দিকে, দিল্লি হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংকট উপেক্ষা করেছে, বাংলাদেশকে ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার দিয়েছে এবং আন্তসীমান্ত রেল ও সড়ক সংযোগ বাড়িয়েছে।
এত কিছুর পরও কিছু অন্তর্নিহিত টানাপোড়েন—দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কিত—এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিঘ্নিত করেছে। হাসিনার বিদায়ের পর এই পার্থক্যগুলো আরও বড় হয়ে সামনে আসছে, যা উভয় পক্ষকে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত অগ্রাধিকার পুনর্বিবেচনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
নয়াদিল্লি বা ঢাকায় ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশিদের অনিয়মিত অভিবাসন সব সময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল। এই বিষয়টি আরও বেশি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে। হাসিনার শাসনামলেও, ঢাকা এই বিষয়টি সমাধানে অনিচ্ছুক ছিল। বিজেপি বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যুতে বিজেপির অনড় অবস্থান মূলত ধর্মীয় পরিচয় ও ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এখন উত্তেজনা আরও বাড়ছে। গত নভেম্বরে বাংলাদেশে এক হিন্দু সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার (যিনি ইসকনের সাবেক নেতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার) এবং এর পরবর্তী বিক্ষোভের ঘটনায়, উভয় দেশই নিজেদের সীমার মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগে একে অপরকে দোষারোপ করেছে। যদি বাংলাদেশি হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় চায়, তবে অভিবাসন সমস্যা আরও জটিল রূপ নিতে পারে। বিজেপি সরকার এই অভিবাসীদের আশ্রয় দেবে, পাশাপাশি বাংলাদেশকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করবে।
চাপে পড়ে ঢাকা অবশ্যই ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি আচরণের জন্য নয়াদিল্লিকে দোষারোপ করবে—যা শত্রুতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। এই শত্রুতা ভুল তথ্যের কারণে আরও তীব্র হচ্ছে। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, এমনকি ঘটনাগুলোকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে তুলে ধরেছে।
আরেকটি বিষয়, যেখানে দুই পক্ষ একমত হতে পারেনি, তা হলো—তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, যদিও ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ মেটেনি। এই ইস্যুটি বিশেষভাবে জটিল। কারণ, বিজেপি সরকার সমাধানে আগ্রহী থাকলেও বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তির জন্য একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে, নয়াদিল্লিতে যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কিছু দিক দীর্ঘদিন ধরেই ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। এর মধ্যে একটি হলো—বাংলাদেশে ইসলামপন্থী উগ্রপন্থার উত্থান এবং এর নেতিবাচক প্রভাব, বিশেষত দেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যারা সহায়তা করেছে, তাদের মধ্যে ইসলামপন্থী এবং ভারতবিরোধী গোষ্ঠীগুলোও রয়েছে, যারা এখন উল্লসিত। সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি থাকার পরও ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ও আশঙ্কাগুলো সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে।
ভারত নিজ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্ভাব্য সংক্রমণ নিয়েও উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিমদের ক্ষেত্রে। ভারতের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) বহুদিন ধরে এসব পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। বিজেপির মূল সমর্থন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বাংলাদেশের হিন্দুদের ব্যাপারে মোদি সরকারকে উদাসীন মনে হলে তা বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। তবে আপাতত, ভারতের পক্ষে কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের নিন্দা জানানো এবং বক্তৃতা–বিবৃতির মাধ্যমে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। কারণ, যে কোনো ধরনের উত্তেজনা বৃদ্ধি নিশ্চিতভাবে বিজেপির জন্য বুমেরাং হবে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে এবং নির্বাচনের পর বিএনপি নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির অতীতের ঝামেলাপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচের স্তরে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতির পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে ভারতের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি সীমিত হয়ে পড়তে পারে।
যদি বাংলাদেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী অতীতের মতো বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে, তবে পররাষ্ট্রনীতির এই পুনর্বিন্যাস পুরোপুরি বাস্তবে রূপ নিতে পারে। ভারতের আশঙ্কা একটি ক্রমবর্ধমান বৈরী প্রতিবেশীর রূপ ধারণ করতে পারে। এই সম্ভাব্য পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য ভারতের হাতে তেমন কার্যকর হাতিয়ার নেই। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার ওপর বাড়াবাড়ি নির্ভরতা, অন্য দল ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে উপেক্ষা করার কারণে ভারত নিজেকে এই অস্বস্তিকর অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
লেখক: সুমিত গাঙ্গুলি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির হুভার ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়ার। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—‘ইন্ডিয়ান ফরেন পলিসি’, ‘সিনো–ইন্ডিয়ান রাইভালরি’, ইন্ডিয়া–পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য বম্ব’।
অনুবাদ: আব্দুর রহমান
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সাম্প্রতিক বেলুচ বিদ্রোহীদের প্রতি হুঁশিয়ারি অনেকের কাছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি মনে হচ্ছে—ঠিক যেমনটা করেছিলেন ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালে। বিভাজন, দমন ও অস্বীকারের সেই পুরোনো কৌশলই যেন ফিরে এসেছে নতুন ইউনিফর্মে। ইতিহাস আবার প্রশ্ন করছে—পাকিস্তান কি কিছুই শিখল না?
২ ঘণ্টা আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বাণিজ্য যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির বেশ কিছু নজির রয়েছে। উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ছয়টি অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা বলতে ছয় বা তার বেশি ত্রৈমাসিক পর্যন্ত টানা অর্থনৈতিক সংকোচন বোঝানো হয়। যদিও এর কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই।
৬ ঘণ্টা আগেমার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি দ্রুত অগ্রগতির কোনো ইঙ্গিত না পান, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়াবেন। ট্রাম্পের এমন মনোভাব নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
২ দিন আগেট্রাম্পের শুল্ক ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য বিশাল ধাক্কা। এই দেশগুলো চিপস থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে জড়িত। তারা এখন বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দ্বন্দ্বের মাঝে আটকা পড়েছে। যেখানে চীন তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশী ও সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।
২ দিন আগে