Ajker Patrika

রাখাইন দখলের পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে আরাকান আর্মি, বাংলাদেশ-ভারত কী করবে 

আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১৭: ৫১
রাখাইন দখলের পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে আরাকান আর্মি, বাংলাদেশ-ভারত কী করবে 

মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন রাজ্য রাখাইনের অধিকাংশ এলাকাই এখন স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণে। জান্তা বাহিনীর দখলে রাজ্যটির যে পরিমাণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আছে, তা খুবই নগণ্য। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে যে তবে কি রাখাইন মিয়ানমারের কাঠামোর মধ্যেই স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাচ্ছে। এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। গবেষণার সারবস্তু আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান। 

মিয়ানমারের বাংলাদেশসংলগ্ন রাজ্য রাখাইনে ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে তীব্র আক্রমণ শুরু করে অঞ্চলটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় গোষ্ঠীটি রাজ্যটির প্রায় শতভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এমনকি কয়েক লাখ বাসিন্দার অঞ্চলটিতে একটি প্রোটো-স্টেট গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছে। সাধারণত, প্রোটো-স্টেট হলো এমন একটি অবস্থা, যখন একটি অঞ্চল কোনো একটি দেশের সঙ্গে খুবই শিথিলভাবে যুক্ত থাকে। 

মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে নির্বিচারে হামলা ও অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে, অঞ্চলটিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখা দিয়েছে। তবে স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনসংখ্যা আরাকান আর্মিকেই সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, জান্তা বাহিনী রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোতে স্থানীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করেছে এবং রাখাইনে স্থানীয়দের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। 

এখন যুদ্ধ বজায় থাকলেও এটি স্পষ্ট যে আরাকান আর্মি শিগগির রাখাইনের শাসনের ক্ষেত্রে ডি-ফ্যাক্টো কর্তৃপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। এ ক্ষেত্রে বাইরের যেসব অংশীদার বা পক্ষ আছে, তাদের ঠিক করতে হবে তারা কীভাবে এবং কখন আরাকান আর্মির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবে। তবে আরাকানের স্থিতিশীলতা চাইলে, আরাকান আর্মিকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের সম্পর্ককে নতুন করে বিবেচনা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে নিগ্রহমূলক আচরণ করা হয়েছে, তার তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিতে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গে আরাকান আর্মিকে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। 

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আরাকান আর্মি মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর কাছ থেকে এককভাবে সবচেয়ে বেশি এলাকা—জনসংখ্যা ও আয়তনের ভিত্তিতে—কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে গোষ্ঠীটি পুরো রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের করে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এর জন্য গোষ্ঠীটিকে অনেক বেশি চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। একই সঙ্গে রাজ্যটির বেসামরিক লোকদেরও উচ্চ মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। 

আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধে রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জান্তা বাহিনী দৈনন্দিন ভিত্তিতে রাজ্যটির বিভিন্ন অঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়েছে। জান্তা ও আরাকান আর্মি উভয়ের বিরুদ্ধেই বেসামরিক নাগরিকদের নিগ্রহ করার অভিযোগ আছে। মে মাসের শেষ দিকে জান্তা বাহিনী রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ের উপকণ্ঠের একটি শহরে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। আরাকান আর্মিও মংডু শহরে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায় বলে অভিযোগ আছে। এতে অন্তত ২০০ লোক নিহত হয়েছিল।

আরাকান আর্মি হয়তো রাখাইনের পুরো ভূখণ্ডের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে, কিন্তু এর রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান রাজ্যটি শাসন করার ক্ষমতা রাখে কি না এবং তাদের শাসনে রাজ্য স্থিতিশীলতা ফিরবে কি না—তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন জনগোষ্ঠীর সমর্থন হয়তো আরাকান আর্মি ও এর রাজনৈতিক শাখাকে নিজেদের শাসন দৃঢ় করার জন্য কিছু সময় দেবে। কিন্তু বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটসহ প্রয়োজনীয় সেবার অনুপস্থিতি, সংঘাতে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে নিয়ে তারা কতটা এগিয়ে যেতে পারবে তাই এখন ভাবনার বিষয়। 

একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরাকান আর্মিকে শুরুতেই গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। রাজ্যটির প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার থাকলেও প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও নিকটবর্তী ভারতের সঙ্গে তাদের খুব একটা যোগাযোগ নেই। এই দুটি দেশের সরাসরি রাখাইনে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যার কারণে, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, ব্যাংকিং ও অন্যান্য সেবার জন্য রাজ্যটিকে বাধ্য হয়েই নেপিডোর ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। ভূকৌশলগত কারণে ভারত ও চীন উভয়ই রাখাইনে নিজেদের উপস্থিতি জোরালো করতে চায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ চায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে তাদের নিজ ভূখণ্ডে ফেরত পাঠাতে। এই জটিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সামলানো মোটেও আরাকান আর্মির জন্য সহজ হবে না। 

লালচে রঙের অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির দখলে এবং সবুজাভ অঞ্চলগুলো জান্তা বাহিনীর দখলে। ছবি: আইসিজিআরাকান আর্মির জন্য আরেকটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হলো—রাজ্যটিতে বৌদ্ধপ্রধান রাখাইন জনগোষ্ঠী ও মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতময় সম্পর্ক। ১৯৪২ সাল থেকেই এই দুই গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে। সংখ্যায় কম হলেও রোহিঙ্গারা এখনো রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশে বেশি প্রভাবশালী। রোহিঙ্গা-রাখাইন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও জান্তা বাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার রাখাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। জান্তা বাহিনী আগে যেসব রোহিঙ্গা সংগঠনকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছিল এখন সেগুলোকেই আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছে। এমনকি বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে খবর আছে। 

যদিও অধিকাংশ রোহিঙ্গা বাধ্য হয়েই জান্তার হয়ে লড়ছে। তবে অনেকেই আছে, যারা স্বেচ্ছায় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে রাখাইন বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এই বিষয়টি আরাকান আর্মিকে ক্ষুব্ধ করেছে। একই সঙ্গে, রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় জনগোষ্ঠীর নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে পরিস্থিতি আবারও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দিকে রূপ নিচ্ছে। 

রাখাইন রাজ্য বর্তমানে এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। যেখানে রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের ঐতিহাসিক শত্রুতার ঊর্ধ্বে উঠে উত্তেজনা প্রশমিত করতে হবে। তাঁদের উচিত বিষাক্ত বক্তব্য এড়িয়ে সহিংসতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে সংলাপ বসা এবং তাদের একে-অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া সরকারি প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করা। 

আরাকান আর্মিকে নিশ্চিত করতে হবে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করবে এবং তাদের মানবাধিকারকে সম্মান করবে, প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগের একটি স্বাধীন তদন্ত করবে। এই তদন্ত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু হওয়া উচিত। 

রাখাইন রাজ্য অভ্যন্তরীণভাবে যেসব সংকট মোকাবিলা করছে, তার কাটিয়ে উঠতে বাহ্যিক অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশও একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। রাখাইন যদি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত হবে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। বিশেষ করে, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় বাংলাদেশের উচিত এই দাবি করা যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা হবে। 

এ ছাড়া, সীমান্ত স্থিতিশীল করতে ও অনিয়মিত অভিবাসনের বিষয়টি মোকাবিলা করার জন্য ঢাকাকে এই অঞ্চলে আরও মানবিক সহায়তা, সীমান্তজুড়ে বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া উচিত। ঢাকার উচিত শরণার্থীশিবিরে নিরাপত্তার উন্নতি করা, সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব কমানো এবং একটি প্রকৃত রোহিঙ্গা নাগরিক সমাজের আন্দোলন গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া। অন্য বিদেশি সরকারগুলোকেও আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া, যাতে তারা উভয় পক্ষে সহযোগিতা করতে পারে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। 

যা–ই হোক, আরাকান আর্মি এখন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় সাফল্য অর্জন করার পরে তাদের দেখাতে হবে, তারা দেশের অবহেলিত কোণে স্থিতিশীলতা আনতে পারে এবং সেখানে বসবাসকারী সব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে শাসন করতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ট্রাম্প বনাম মোদি: ভূরাজনীতির জটিল খেলায় কে হারাবে কাকে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ১৯
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে। আর রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছেন সবার চালচলন।

এ খেলার মূল বাজি রুশ অপরিশোধিত তেল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এ তেল যাচ্ছে ভারত ও চীনে। ট্রাম্প এখন সেটা বন্ধ করতে চান এবং বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ওয়াশিংটনের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরে থেকে তেলের বাজারে ভারত মস্কোর অন্যতম বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো এড়িয়ে গেলেও ভারত সস্তা দামে রুশ তেল কিনছে—যা ঘরোয়া জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখতে ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সমালোচনা করলেও বৈশ্বিক জ্বালানি স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসেছে। রুশ তেল কেনার অপরাধে তারা ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ উত্তেজনাও চলছে। অনেকে বলছেন, এতে ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্ব হয়তো শেষ হয়ে গেছে।

অবশ্য ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারত আর রুশ তেল কিনবে না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—ট্রাম্প কি ‘ব্লাফ’ দিচ্ছেন, না সত্যিই মোদির কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে, ভারত রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে? ট্রাম্প দাবি করেছেন, ‘ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে, এটার জন্য আমি অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু মোদি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁরা আর রুশ তেল কিনবেন না। এটা বড় পদক্ষেপ। এখন আমরা চীনকেও একই কাজ করাতে যাচ্ছি।’

তবে প্রশ্ন দুটি থেকেই যায়—প্রথমত, মোদি কি সত্যিই এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় রুশ তেল আমদানিকারক চীন কি যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলবে?

চীন প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ব্যারেল তেল আমদানি করে, যার বড় অংশই আসে রাশিয়া থেকে। ২০২৩ সালে রাশিয়া সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে চীনের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী হয়। এটিই প্রমাণ করে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মস্কো-বেইজিং সম্পর্ককে আরও শক্ত করেছে। চীন ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘একতরফা ও অর্থনৈতিক জবরদস্তি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাল্টাব্যবস্থার হুমকি দিয়েছে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা সতর্ক। দিল্লি জানিয়েছে, রুশ তেল আমদানি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও দামের ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে সত্যিই ফোনালাপ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখা ও সরবরাহ নিশ্চিত করাই আমাদের নীতির মূল লক্ষ্য। এ জন্য আমরা উৎস বৈচিত্র্য বজায় রেখে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী তেল আমদানি করি।’

এই অস্পষ্ট মন্তব্যের পর অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন—ফোনালাপ আদৌ হয়েছিল কি না এবং হয়ে থাকলে মোদি সত্যিই কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কি না।

মস্কো অবশ্য স্পষ্ট জানিয়েছে, ভারত তাদের জ্বালানি নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রুশ সরকার বলেছে, ‘ভারতের অর্থনীতির জন্য রুশ তেল অপরিহার্য। আমরা ভারত সরকারের নীতিকে সম্মান করি এবং তেল ও গ্যাস খাতে সহযোগিতা চালিয়ে যাব।’

উল্লেখ্য, একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজেরাই চেয়েছিল ভারত রুশ তেল কিনুক, যাতে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়ে না যায়। ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা রুশ তেল কেনা নিষিদ্ধ করিনি, বরং মূল্যসীমা নির্ধারণে ভারতকে সহায়তা করতে বলেছিলাম। ভারত ঠিক তা-ই করেছে। এখন এই প্রশাসন বলছে, ভারত নাকি রাশিয়ার যুদ্ধ যন্ত্রে অর্থ জোগাচ্ছে। এটা একধরনের নীতিগত দ্বিচারিতা।’

পশ্চিমা বাজার হারানোর ক্ষতি পোষাতে রাশিয়া ইতিমধ্যে এশীয় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছে। ভারত ও চীন এখন রাশিয়ার জন্য প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। একই সঙ্গে ইউরোপও রাশিয়া থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে।

ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক বহু পুরোনো। সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মস্কো ছিল ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক মিত্র। এখনো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, পারমাণবিক প্রকল্প, জ্বালানি বিনিয়োগ ও যৌথ উদ্যোগ—সব ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক অটুট।

এ দীর্ঘ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও ভারত সহজে রুশ তেল থেকে সরে আসবে না। তবে দিল্লির জন্য ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাণিজ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। অনেকের মতে, ওয়াশিংটন হয়তো কৃষিপণ্য ও শুল্কে ছাড় দিয়ে ভারতকে রুশ তেল আমদানি কমানোর প্রস্তাব দেবে।

তবে বর্তমানে ভারতের রুশ তেল আমদানি কমার কোনো ইঙ্গিত নেই। সেপ্টেম্বর মাসে ভারত দৈনিক ১৬ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে, যা অক্টোবরে বেড়ে ১৮ লাখ ব্যারেল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব তেল পরিবহন হচ্ছে পশ্চিমাদের নজরদারির বাইরে থাকা ‘শ্যাডো ফ্লিট’ বা তেলবাহী গোপন জাহাজের মাধ্যমে।

বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, ভারত হঠাৎ রুশ তেল কেনা কমালে বিশ্ববাজারে সরবরাহ ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে, দাম পড়ে যেতে পারে এবং রাশিয়া আরও বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

২০২২ সালে যখন রাশিয়ার কারণে বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন বাইডেন প্রশাসন ভারতকে ছাড় দিয়েছিল, যেন বিশ্বে ঘাটতি না হয়। সে সময় ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮০–৯০ ডলার। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৬১ ডলারে, যা মার্কিন শেল তেল উৎপাদকদের জন্য উদ্বেগের কারণ।

ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, ভারত ও চীনকে রুশ তেল কেনা কমাতে বাধ্য করলে সরবরাহ কমে যাবে, ফলে দাম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, এতে যেন তাঁর নিজ দেশের ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

তবে এই ‘গেম’ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কারণ, বেশি চাপ দিলে দাম উল্টো বেড়ে যেতে পারে আর কম চাপ দিলে রাশিয়া বিপুল অর্থ উপার্জন চালিয়ে যাবে। যেকোনো ভুল হিসাব মার্কিন কৌশলকে দুর্বল করতে পারে বা মস্কোর অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। তাই এ মুহূর্তে ট্রাম্পের বাজি সফল হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আর মোদির জন্য এটি নিঃসন্দেহে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। তবে ভারসাম্য রক্ষা করা এত সহজ নয়। রাশিয়া থেকে সরে আসা মানে পুরোনো জোট দুর্বল করা; আবার যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করা মানে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলা। তাই অর্থনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও অনিশ্চিত মার্কিন রাজনীতির দাবার বোর্ডে মোদিকে একসঙ্গে চাল দিতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।

টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের নিবন্ধ

ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করেনি নাকি করতে পারেনি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৯: ০৭
হামাস সেনারা। ছবি: এএফপি
হামাস সেনারা। ছবি: এএফপি

গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আনুমানিক ১৫ হাজার হামাস যোদ্ধা আবারও সংগঠিত হয়ে উঠে এসেছে। তাদের অনেকে পূর্ণ সশস্ত্র এবং এরই মধ্যে গাজায় প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেছে। গাজা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন বলছে, তারা সন্দেহভাজন সহযোগীদের খুঁজে বের করে প্রকাশ্যে হত্যা করছে। অর্থাৎ হামাস ধ্বংস হয়নি, রক্তাক্ত ও বিভক্ত হলেও সংগঠনটি টিকে গেছে।

এ ফলাফল আসলে অপ্রত্যাশিত নয়। বিশ্বের সব প্রভাবশালী সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, হামাসকে কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। হামাস শুধু একটি সশস্ত্র নেটওয়ার্ক বা সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা নয়, এটি ফিলিস্তিনি সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে বসা একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক আন্দোলন। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ক্ষেত্রে দেখেছে, নেতা হত্যা করা যায়, অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, এলাকা দখল করা যায়, কিন্তু কোনো আদর্শকে বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় না।

ইসরায়েলের ঘোষিত ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ শুরু থেকে ছিল এক মরীচিকা। হামাসের নেতৃত্বকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সংগঠনটি এখনো স্থানীয় সেল ও মিলিশিয়া আকারে সক্রিয়। ইসরায়েলি অভিযানে গাজার অসংখ্য সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, আবাসিক এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেসব মূল কারণ হামাসের উত্থান ঘটিয়েছিল (বঞ্চনা, রাষ্ট্রহীনতা ও হতাশা), সেগুলো আজও বহাল ও আরও তীব্র।

২০০০-এর দশকের শুরুতে ফাতাহ নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার প্রতীকে পরিণত হয়। কয়েক বছরের ব্যর্থ শান্তি আলোচনা, অর্থনৈতিক পতন ও ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা পিএর প্রতি আস্থা হারায়। হামাস এ ক্ষোভকে রাজনৈতিক পুঁজি বানায়, নিজেদের পরিচয় দেয় দুর্নীতিমুক্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, ন্যায় ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।

২০০৬ সালে গাজায় হামাস নির্বাচনে জয় পায় মূলত ফাতাহর স্থবিরতার কারণে; উগ্র ইসলামপন্থার প্রতি সমর্থন হিসেবে নয়। কিন্তু বিজয়ী হয়ে হামাস ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার চিরাচরিত একনায়কতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের গাজা থেকে উৎখাত করে, নির্বাচন বাতিল করে আর জনগণের কল্যাণে ব্যয় না করে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সুড়ঙ্গ, রকেট তৈরি ও সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে।

তবে এখানে ইসরায়েলের নীতির ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজাকে বিভক্ত রাখার নীতি হাতে নেয়। নেতানিয়াহু জানতেন, একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব দ্বিরাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে শক্তিশালী করত আর বিভক্ত নেতৃত্ব সেই সম্ভাবনাকে দুর্বল করেছে। এ কৌশলের অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিম তীর পিএকে দুর্বল করার পাশাপাশি গাজায় হামাসের শাসনকে পরোক্ষভাবে মেনে নেওয়া।

এ স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। হামাসকে শক্তিশালী হতে দিয়ে নেতানিয়াহু কার্যত দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছেন। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক আপসে না গিয়ে বসতি সম্প্রসারণ ও দখল চালিয়ে যাওয়ার পথে এক সহজ অজুহাত ছিল।

কিন্তু এ নীতি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ভয়াবহভাবে উল্টো ফল দিয়েছে। হামাসের হামলা ইসরায়েলের নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দিয়েছে, ভয়াবহ এক যুদ্ধের সূচনা করেছে এবং শান্তিপ্রক্রিয়াকে পুরো এক প্রজন্ম পিছিয়ে দিয়েছে।

গাজার জনগণের মধ্যে হামাসের প্রতি গভীর ভালোবাসা নেই। অনেক ফিলিস্তিনি হামাসকেই দোষারোপ করছে ধ্বংস ও রক্তপাত ডেকে আনার জন্য। কিন্তু বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা বিশ্বাসযোগ্য শান্তির রূপরেখা না থাকায় হামাসের বয়ান টিকে আছে। চরমপন্থা বাঁচে হতাশার ওপর আর গাজায় এখন হতাশার প্রাচুর্য।

হামাসকে প্রকৃত অর্থে পরাজিত করার একমাত্র উপায় অস্ত্র নয়, বরং আদর্শিক লড়াই। হামাস যে বক্তব্যের ওপর টিকে আছে—তা হলো, রাষ্ট্রহীন মানুষের জন্য সম্মানের একমাত্র পথ হচ্ছে সহিংসতা। এ বক্তব্য ভেঙে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বাস্তব, আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত ও বিশ্বাসযোগ্য দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথ তৈরি করা।

এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা ফিরিয়ে আনা ও একটি নতুন প্রযুক্তিগত বা বহুপক্ষীয় প্রশাসনের মাধ্যমে গাজাকে পুনর্গঠন করা। শহীদ হওয়ার বাসন নয়, শাসন ও উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা। গাজার রাজনৈতিক সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে তহবিল পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া। ইসরায়েলকেও বুঝতে হবে, স্থায়ী অবরোধ ও দখলদারত্ব নিরাপত্তা বাড়ায় না; প্রকৃত নিরাপত্তা আসে সহাবস্থান থেকে।

ইসরায়েলের অভিযান প্রমাণ করেছে, যেমনটা বিশেষজ্ঞরা বহু আগে বলেছেন, আপনি একটি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারেন, কিন্তু একটি আদর্শকে নয়। হামাসকে সত্যিকার অর্থে পরাজিত করতে হলে ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে ও চিন্তায় বিশ্বাসযোগ্য শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ দেখাতে হবে।

ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে বিশ্লেষণটি লিখেছেন ড. আজিম ইব্রাহিম। তিনি নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির সিনিয়র ডিরেক্টর এবং ‘অথরিটেরিয়ান সেঞ্চুরি: উইমেনস অব আ পোস্ট-লিবারাল ফিউচার’ বইটির লেখক। অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভারতে মুসলিম ঘৃণা যেভাবে নিত্যদিনের বিনোদন হয়ে উঠেছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতের মুসলিমরা এখন সাধারণ অধিকার নিয়ে আওয়াজ তুললেও অপরাধী গণ্য হচ্ছেন। ছবি: আল-জাজিরার সৌজন্যে
ভারতের মুসলিমরা এখন সাধারণ অধিকার নিয়ে আওয়াজ তুললেও অপরাধী গণ্য হচ্ছেন। ছবি: আল-জাজিরার সৌজন্যে

ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী তকমা পাচ্ছে। এই দুই বাস্তবতার মাঝখানে একটি বার্তা স্পষ্ট—মুসলমানদের কষ্টক্লিষ্ট মুখ হয় অদৃশ্য করে দেওয়া হয়, নয়তো সেটিকে পরিণত করা হয় এক ধরনের টিভি ‘শো’তে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সান্ধ্যকালীন বিনোদন। আজ ভারতে মুসলমানের জন্মই যেন আজন্ম পাপ! তার জন্মই হয় অপরাধী হয়ে। তাদের কণ্ঠস্বর কেউ শোনে না।

গত সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে সাত বছরের এক মুসলিম শিশুর লাশ উদ্ধার হয়। লাশ ব্যাগে ভরা ছিল। প্রতিবেশীরাই জড়িত ছিল এ হত্যাকাণ্ডে। খবরটা স্থানীয়ভাবে একদিন দুদিন প্রচারিত হলেও দেশের বড় কোনো সংবাদমাধ্যমে জায়গা পায়নি। সেসময় নিউজরুমে আলোচনায় ছিল ‘লাভ জিহাদ’, সীমান্ত উত্তেজনা ও ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। ফলে একটি মুসলিম শিশুর মৃত্যু জাতীয় ক্ষোভের গল্প হিসেবে ভাইরাল হয়নি। ধীরে ধীরে তা হারিয়ে গেছে। দ্রুত স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া আর দশটা ঘটনার তালিকায় যোগ হয়েছে এই শিশুহত্যা।

সমাজবিজ্ঞানী স্ট্যানলি কোহেন এটিকে বলেন— ‘স্টেটস অব ডিনায়াল’। রাষ্ট্র এখানে নির্লিপ্ত। এখানে নৃশংসতাগুলো আড়াল করা হয় না, বরং এমনভাবে গ্রহণ করা হয় যেন তা স্বাভাবিক। ভারত আজ সেই অবস্থায়। এখানে মুসলমান হত্যার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার যোগ্য নয়, যেন এটা নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার।

কানপুরে মুসলমানেরা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই এফআইআর দায়ের করে। গ্রেপ্তার করে ১ হাজার ৩০০ জনকে। ভালোবাসার প্রকাশও যেন আজ অপরাধ। অথচ মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশে যখন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেয়, তখন টেলিভিশন হয় তাদের মুখপত্র, নয়তো নীরব দর্শক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা যেন এক মঞ্চনাটক, যেখানে মুসলমানেরা চিরকাল অপরাধী/ভিলেন চরিত্রে আর হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো সভ্যতার ধারক-বাহক ও রক্ষক হিসেবে অভিনয় করে।

ইন্দোরে ‘জিহাদি-মুক্ত বাজার’ নীতিতে রাতারাতি মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে—এ যেন অর্থনৈতিক লিঞ্চিং বা গণপ্রহার। অনেক পরিবার এতে উপার্জন হারায়, শিশুরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, নারীরা খাবারের জন্য প্রতিবেশীর দ্বারে দ্বারে ঘোরে। অথচ দেশের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে দেখায় ‘আইন-শৃঙ্খলার সমন্বয়’ হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যাগুরুরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, নানা মিম বানায়, বানানো হয় অনেক ভিডিও। এসব দেখে মনে হয়, মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন ও বঞ্চনা যেন বিনোদনের উপকরণ!

উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এ সংস্কৃতির জন্মদাতা। তিনি প্রকাশ্যে মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘সন্ত্রাসীদের সহযোগী’ আখ্যা দেন। এমন ভাষা এখন ভারতের মূলধারার রাজনীতিরই অংশ। তথাকথিত বিরোধী দলগুলোও প্রতিবাদ না করে বরং নিজস্ব সংস্করণে নিজেদের হিন্দুত্ববাদী প্রমাণ করতে প্রতিযোগিতা করছে। মুসলমানেরা তাই এখন ভারতের রাজনীতিতে নাগরিক নয়, বরং নাটকের প্রপস মাত্র। (প্রপস বলতে মঞ্চ বা পর্দায় অভিনয়ের জন্য ব্যবহৃত বস্তু যেমন; আসবাব, অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি)

ভারতে আজকের দিনে একজন মুসলিম হিসেবে বাঁচা মানে ‘স্থায়ী সন্দেহভাজন’ আতঙ্কে থাকা। মসজিদে তাঁদের ওপর নজর রাখা হয়, বাজারে আড়চোখে তাকানো হয়, শ্রেণিকক্ষে সন্দেহ করা হয়। প্রতি শুক্রবার জুমার জামাতে যাওয়াই ঝুঁকি বলে মনে হয়। আজানের প্রতিটি ধ্বনি কারও কারও কাছে উসকানি বলে মনে হয়।

গীতিকার ও কবি সাহির লুধিয়ানভি একবার লিখেছিলেন, ‘যিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পার, ওহ কাহাঁ হ্যায়?’ (ভারতের জন্য যারা গর্বিত, তারা এখন কোথায়?)। প্রশ্নটি আজও প্রতিধ্বনিত হয়—যারা ভারত ও ভারতের মহত্ত্ব নিয়ে গর্বিত, তারা আজ কোথায়? তারা কী মুসলিমদের এ দুর্দশা দেখেন না?

উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম গবেষক মাহমুদ মামদানি তাঁর ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’ বইয়ে লিখেছেন—রাষ্ট্র ও সমাজ মুসলমানদের ভাগ করে ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ দুই শ্রেণিতে। ‘ভালো’ মুসলমান সে, যে চুপচাপ থাকে; আর ‘খারাপ’ সে, যে আত্মপরিচয় ও মর্যাদা জানান দিতে চায়। ভারতের বাস্তবতাও তা-ই—যে মুসলমান নিজের ধর্মবিশ্বাস আড়াল করে, সে টিকে থাকে; আর যে ভালোবাসা প্রকাশ করে, সমঅধিকার চায়, তাঁকে বলা হয় ‘মুজরিম’ বা অপরাধী। মামদানি আমাদের মনে করিয়ে দেন, এটি ধর্মতত্ত্বের বিষয় নয়, ক্ষমতার বিষয়। এই ক্ষমতাবানেরাই ঠিক করে দেয়, কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ— হোক সেটা ধর্মবিশ্বাস বা অধিকারের প্রশ্ন।

এই কারণেই গণপিটুনির ভিডিওগুলো হোয়াটসঅ্যাপে মিমের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই মুসলমানদের জন্মহার বেশি, তারা দ্রুতই হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে— সংবাদ উপস্থাপকেরা এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলেন আর হাসেন। এই কারণেই জনতা মুসলমানদের দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার পরে হাসি-তামাশা করে। ঘৃণা এখন আর শুধু রাজনীতি নয়, এটি এখন সমাজের বিনোদনে পরিণত হয়েছে। আর নিষ্ঠুরতা যখন কমেডি হয়ে ওঠে, যখন কাউকে অপমান করার ভিডিও প্রাইম-টাইম স্ক্রিপ্ট হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না।

কিন্তু ইতিহাস দেখুন, যে সমাজ সংখ্যালঘুদের কষ্টকে বিনোদনে পরিণত করে, সে সমাজ নিজেও রক্ষা পায় না। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি নিধনে তথাকথিত লিবারেলদের বা উদারপন্থীদের নীরবতা, কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনির শিকার হতে দেখেও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের উদাসীনতা, কিংবা গাজায় বোমা হামলা দেখে ইসরায়েলিদের উল্লাস—সবই মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণার বিনোদন একসময় নিজের সমাজকেই গ্রাস করে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।

তাহলে প্রশ্নটা রয়ে যায়—আমরা মুসলিম, না মুজরিম? কেন প্রতিদিন আমাদের বিচার হয়, অথচ হত্যাকারীরা মুক্ত থাকে? কেন আমাদের সন্তানদের মৃত্যু চাপা পড়ে রাষ্ট্রীয় উৎসবের আড়ালে?

এর উত্তর তালাশ করতে হবে শুধু মুসলমানদের নয়, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠেরও। তারা কি ঘৃণাকে টেলিভিশন শো হিসেবে দেখবে, নাকি একদিন টেলিভিশন বন্ধ করে দেবে? কারণ ঘৃণা যেদিন দেশের একমাত্র বিনোদন হয়ে উঠবে, সেদিন শুধু মুসলমানের লাশ নয় ভারতের প্রজাতন্ত্রেরও পর্দা নামবে। সেদিন কেউ জিজ্ঞেস করবে না আপনি হিন্দু নাকি মুসলিম, ডানপন্থী নাকি উদারপন্থী। সেদিন ঘৃণার অট্টহাসিই হবে এই প্রজাতন্ত্রের একমাত্র অবশিষ্ট আওয়াজ।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত

লেখক: ইসমাইল সালাউদ্দিন, ভারতীয় লেখক ও গবেষক, মুসলিম পরিচয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সিএনএনের প্রতিবেদন

বিরল খনিজ ও তোষামোদের কূটনীতি: পাকিস্তান দেখাল কীভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ২৯
মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত গাজা শান্তি সম্মেলনে শেহবাজ শরিফকে মঞ্চ ছেড়ে দেন ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত গাজা শান্তি সম্মেলনে শেহবাজ শরিফকে মঞ্চ ছেড়ে দেন ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

গাজা যুদ্ধবিরতির পর গত সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্বনেতাদের সামনে নিজের সাফল্য তুলে ধরছিলেন, তখন তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিজের ‘প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ বলে সম্বোধন করেন। এরপর মঞ্চ ছেড়ে দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে, যিনি ট্রাম্পের উদ্যোগের প্রশংসা করে ঘোষণা দেন, তিনি ট্রাম্পকে আবারও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেবেন।

এক বছর আগেও এমন দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন ছিল। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে পাকিস্তানের কথিত সম্পর্কের কারণে ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। তা ছাড়া চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়াটাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল এক অস্বস্তির কারণ।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুরো মেয়াদে কোনো পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেননি। এমনকি ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তিনি পাকিস্তানকে বলেছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি’।

কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যেন উল্টোপাল্টা এক দাবার ছক, যেখানে পুরোনো মিত্ররা দূরে সরে যাচ্ছে, আর আগে যাদের ‘শত্রু’ ভাবা হতো, তারাই এখন হোয়াইট হাউসে জায়গা পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান একেবারে আদর্শ উদাহরণ তৈরি করেছে।

পাকিস্তানের নেতারা এখন প্রায়ই হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হচ্ছেন। দেশটির সামরিক বাহিনী পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি র‍্যাথিয়ন ক্ষেপণাস্ত্র। বাণিজ্যে তারা পেয়েছে প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় কম শুল্কের সুবিধা।

এই কূটনৈতিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে দুটি মূল উপাদান। প্রথমত, চীনের নিয়ন্ত্রণে না থাকা দুর্লভ খনিজে প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের প্রশংসা।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের এই সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও বেশ সাড়া ফেলেছে। ফলে ভারতের জন্য এটি ক্ষোভের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির ওপর বড় অঙ্কের শুল্ক আরোপ করেছে এবং রাশিয়া থেকে সস্তা তেল কেনা নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিপরীতে, পাকিস্তান প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র এই উষ্ণ সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তিনি বর্তমানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান। ৫৭ বছর বয়সী এই সেনা কর্মকর্তা শান্ত ও সংযত চরিত্রের বলে পরিচিত। গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চার দিনের সংঘাতে আসিম মুনির আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। সে সময় উভয় দেশের বেশ কয়েকজন সেনা ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। পরিস্থিতি একসময় পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে গড়াচ্ছিল।

এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। সংঘাত থামলে ট্রাম্প নিজের কৃতিত্ব দাবি করেন, আর পাকিস্তান তা প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়। এরপরই ইসলামাবাদ ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন দেয়। অন্যদিকে, ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে, যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই।

এ ছাড়া পাকিস্তান এই সংঘাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাতটি জেট ভূপাতিতের দাবি করে, যা প্রকাশ্যে বারবার উল্লেখ করেন ট্রাম্প। ভারত এই সংখ্যা কখনোই নিশ্চিত করেনি এবং প্রাথমিকভাবে তাদের কোনো জেট ভূপাতিত হওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল।

এর কিছুদিন পর আসিম মুনির ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদে উন্নীত হন এবং একা ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দুপুরের খাবার খান। সেখানে কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুজা নওয়াজ বলেন, ট্রাম্প ‘জয়ীদের’ পছন্দ করেন। তিনি সব সময় বলেছেন যে...তিনি পরাজিতদের পছন্দ করেন না। তাই তিনি স্পষ্টতই ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের মধ্যে একজন বিজয়ীকে দেখেছেন, যিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছুক...ট্রাম্প যখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁরা একই পথে ছিলেন।

পাকিস্তান কেন ট্রাম্পের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সুবিধা পাচ্ছে। কারণ, তাদের ভৌগোলিক অবস্থান।’ কুগেলম্যান ইসলামাবাদ ও ইরানের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য পাকিস্তান এমন একটি দেশ, ‘যা ওয়াশিংটন থেকে তেহরানে বার্তা পৌঁছানোর ভূমিকা পালন করতে পারে।’

তবে কঠিন আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করার ইতিহাস পাকিস্তানের রয়েছে। ১৯৭১ সালে তারা ইসলামাবাদ থেকে বেইজিংয়ে হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন সফরের ব্যবস্থা করেছিল, যার ফলে মাও সে-তুংয়ের কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।

কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় তাস হলো দুর্লভ খনিজ সম্পদ। চীনের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন এই খনিজ সম্পদগুলো আইফোন থেকে শুরু করে এমআরআই মেশিন, এমনকি সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমান এবং সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের জন্য প্রয়োজন।

বর্তমানে ১৭ ধরনের খনিজ পদার্থের বৈশ্বিক সরবরাহে চীনের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে; বিশেষ করে প্রক্রিয়াকরণ ও পরিশোধনের ক্ষেত্রে তাদের কর্তৃত্ব রয়েছে। শুল্ক, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিরোধ চলার কারণে বেইজিং এই সুবিধা কাজে লাগাতে চাইছে।

পাকিস্তান সরকারের হিসাবে, দেশটির ভূমির নিচে প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অপ্রাপ্ত খনিজ সম্পদ রয়েছে। তাই ইসলামাবাদ নিজেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ খনিজের নতুন কেন্দ্র’ হিসেবে তুলে ধরছে এবং এ কারণেই ট্রাম্প প্রশাসনের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে ওভাল অফিসের বৈঠকে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, জেনারেল মুনির গর্বের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পাকিস্তানের খনিজ পদার্থের নমুনাখচিত একটি কাঠের বাক্স উপহার দিচ্ছেন।

একই মাসে ইউএস স্ট্র্যাটেজিক মেটালস কোম্পানি (ইউএসএসএম) সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এরপর পাকিস্তানের বিরল খনিজ পদার্থ প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এই চুক্তির অংশ হিসেবে পাকিস্তান ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে খনিজ পদার্থের প্রথম চালান পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। চালানের পরিমাণ নির্দিষ্ট না করলেও জানা গেছে, এতে অ্যান্টিমনি, কপার কনসেন্ট্রেট, নিওডিমিয়াম, প্রাসেওডিমিয়ামসহ দুর্লভ খনিজ উপাদান রয়েছে।

পাকিস্তানের বেশির ভাগ দুর্লভ খনিজ বেলুচিস্তান প্রদেশে রয়েছে বলে মনে করা হয়। রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবিতে এই কৌশলগত ও খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চলটিতে বছরের পর বছর ধরে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ চলছে।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের অভিযোগ, এই গোষ্ঠীকে ভারত অর্থায়ন করে আসছে। পরের মাসেই পাকিস্তানে র‍্যাথিয়ন অ্যাডভান্স মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল বিক্রির অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে মুনিরের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সামরিক বাহিনীর প্রভাব নিয়ে পুরোনো উদ্বেগগুলোকে আবার সামনে এনেছে।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান চারজন ভিন্ন সামরিক শাসকের নেতৃত্বে ছিল এবং তিনটি অভ্যুত্থান দেখেছে। ১৯৭৩ সালে বর্তমান সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।

মুনিরের সমালোচকেরা বলেন, তিনি সামরিক বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছেন। সরকারি সিদ্ধান্ত এবং এমনকি সুপ্রিম কোর্টের ওপরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছেন।

গত মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, রাষ্ট্রটি ‘বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত ও সমালোচনা, বিশেষ করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সমালোচনা করার জন্য স্থানীয় অধিকারকর্মী এবং বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।’

এ ছাড়া ইউএস স্ট্র্যাটেজিক মেটালস কোম্পানির (ইউএসএসএম) সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির পাকিস্তানি অংশীদার হলো সামরিক মালিকানাধীন ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন। অর্থাৎ মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি সফল হলে লাভের বড় অংশও যাবে সামরিক বাহিনীর হাতে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এর বাইরে কিছু নেই।’

তবে বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এই উষ্ণ সম্পর্কেরও একটি সীমা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি বলেন, ‘এই সম্পর্ক সব সময় ট্রাম্পের মর্জির ওপর নির্ভর করবে। ট্রাম্পের সম্পর্ক পাকিস্তানের প্রতি নয়, বরং প্রশংসার প্রতি। পাকিস্তান তাঁকে ভালোবাসে, আর এ জন্যই তিনিও পাকিস্তানকে ভালোবাসছেন।’

তাই ধারণা করা হচ্ছে, এই সম্পর্ক কত দিন টিকে থাকবে, তা নির্ভর করবে হোয়াইট হাউসে বসা ট্রাম্পের মনোভাবের ওপর। কারণ, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সব সময় অনিশ্চিত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত