Ajker Patrika

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের নিবন্ধ /ইরান-ইসরায়েল সংঘাত চলবে কত দিন

অনলাইন ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েল তার ইতিহাস প্রথমবারের মতো অবৈধভাবে আক্রমণ করে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায়। ইরাকি পারমাণবিক স্থাপনার ওপর সেই হামলা বিশ্ব বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যায়। ১৯৮১ সালের সেই হামলায় ইসরায়েলের এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলো ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু গত শুক্রবার ইরানের ওপর হামলা চালানোর পর ইসরায়েল আর সেই ছাড় পায়নি, যা ইরাকের ক্ষেত্রে শুরু হয়েছিল। ইসরায়েলি আক্রমণের ফলে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা দিনের পর দিন গড়াচ্ছে, সম্ভবত সপ্তাহও পেরিয়ে যাবে। এবারে ইসরায়েলের লক্ষ্য আরও বড়—তেহরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার ধ্বংস, একাধিক পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া, এমনকি ইরানি শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও এতে অন্তর্ভুক্ত।

দুপক্ষই জানে, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ঢুকে পড়লে চিত্র পাল্টে যেতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন সব বাংকার বিধ্বংসী বোমা আছে, যা ইসরায়েলের নেই। আর এসব বোমা দিয়ে ইরানের পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে থাকা পারমাণবিক কেন্দ্র ফোরদোতেও হামলা সম্ভব।

তবে আপাতত ইসরায়েল ও ইরান ১ হাজার কিলোমিটার বা তার চেয়েও বেশি দূরত্বে অবস্থান করে এক ব্যতিক্রমধর্মী লড়াইয়ে জড়িয়েছে। মুখোমুখি সেনাবাহিনী নয়, আকাশপথে চলছে সংঘাত। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা—সব মিলিয়ে রীতিমতো অস্ত্রভান্ডার খরচের যুদ্ধে রূপ নিয়েছে এই সংঘাত।

যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) সামরিক বিশ্লেষক সিদ কৌশল এই লড়াইকে বলছেন, ‘শহরের ওপর দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ।’ তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি এই সংঘাতে না নামে এবং শান্তি আলোচনাও শুরু না হয়, তাহলে কোনো পক্ষই সহজে এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না। তাঁর মতে, ‘ইসরায়েলি বাহিনীর আকাশযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব থাকা একটি সুবিধা, তবে এত দূরত্বে যুদ্ধ আর যন্ত্রপাতির ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়া একসময় ইসরায়েলের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

প্রতিরাতেই ইসরায়েলের আকাশে সাইরেন বাজছে। ইরানের পাল্টা হামলায় বিপুলসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি শহরগুলোতে আঘাত হানছে। আর সেই সময় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেগুলো ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থল ধ্বংস করছে, সামরিক নেতাদের টার্গেট করছে, জনবসতিতেও হামলা চালাচ্ছে এবং ধ্বংস করছে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।

ইসরায়েল ইরানের কিছু ক্ষতি করতে পারলেও, ইরান ৮০—এর দশকে ইরাকের সঙ্গে ৮ বছরের যুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেও টিকে ছিল। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) উপদেষ্টা আহমাদ বাহিদি দেশটির সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ নিয়েও আমরা চিন্তিত নই।’ তবে ইরানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় এরই মধ্যে ২০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে।

অন্যদিকে, ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মুখে ইসরায়েলকেও সহ্যের পরীক্ষা দিতে হবে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই যুদ্ধকে বলেছেন ‘যত দিন লাগবে’ চলবে। সোমবার পর্যন্ত ইসরায়েলে ২৪ জন নিহত এবং ৫৯২ জন আহত হয়েছে।

ইরানের হাতে এখনো কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র রয়ে গেছে এবং সেগুলো কতটা উন্নত প্রযুক্তির—তা সামরিক বিশ্লেষকেরা অনুমানই করতে পারছেন। সেই সঙ্গে হিসাব হচ্ছে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মজুত কতটা আছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বলতে—আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিং ও অ্যারো—ইরানের ছোড়া বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করতে পারছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার সীমাহীন নয়। ইউক্রেন দেখিয়েছে, যুদ্ধ যত দীর্ঘ হয়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তত দুর্বল হয়ে পড়ে।

যুক্তরাজ্যের সাবেক উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্যাডি ম্যাকগিনেস বলেন, ‘আমার মনে প্রশ্ন, ইরান কত দিন এই হারে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারবে, আর ইসরায়েল কত দিন নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা টিকিয়ে রাখতে পারবে?’ তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের হামলা অত্যন্ত নিখুঁত ও ধ্বংসাত্মক। ইরানের পাল্টা হামলা সামরিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই অকার্যকর। প্রতিবার ইসরায়েল হামলা চালানোর মাধ্যমে ইরানের যুদ্ধ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।’

ম্যাকগিনেস আরও বলেন, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তুলনামূলক কম নিখুঁত এবং লক্ষ্য ইসরায়েলের উপকূলীয় অঞ্চল এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সদর দপ্তর বা জ্বালানিকেন্দ্র। তবে এর প্রভাব তেমন নেই।’ তবে বাস্তবতা বলছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে অন্তত ১৪ হাজার আবেদন পড়েছে ইরানি হামলার পর।

নেতানিয়াহুও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে বলছেন ‘অস্তিত্বের হুমকি।’ প্রতিদিনের মৃত্যুর মিছিল এবং ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টির বাস্তবতা হয়তো ইসরায়েলের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলতে পারে। আইডিএফ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর সময় ইরানের হাতে ২ হাজারের বেশি ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছিল।

চার দিনে ইরান ৩৫০ টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার। কিন্তু আইডিএফের দৈনিক হিসাব অনুযায়ী, প্রথম রাতের পর হামলার গতি কমে এসেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইরান হয়তো ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণ করছে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে ব্যবহার করতে, অথবা ইসরায়েলি হামলার মধ্যে সেগুলো ছোড়া কঠিন হয়ে পড়েছে—বা উভয়ই।

তেল আবিবের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের ইরান-বিষয়ক গবেষক ড্যানি সিত্রিনোভিচ বলেন, ‘ইরানের এখনো ১ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ইসরায়েল লক্ষ্য করে ছোড়া সম্ভব। তবে তাদের হিসাব করতে হবে, কত দিন ইসরায়েলের মোকাবিলা করতে হবে। আমি নিশ্চিত নই যে, এই যুদ্ধ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে কি না।’

ইরানি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র এখনো সংরক্ষণে রেখেছে তেহরান—সম্ভবত ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার শেষ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। সামরিক উপদেষ্টা বাহিদি বলেন, ‘ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার কমে এসেছে—এমন ধারণা হাস্যকর। আমরা এখনো আমাদের কৌশলগত সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করিনি। আমাদের আধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তি, নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করব।’

এই উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র কতগুলো তৈরি হয়েছে, আর কতগুলো ইসরায়েল ধ্বংস করেছে, সে সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য নেই। এর মধ্যে রয়েছে কঠিন জ্বালানিচালিত (সলিড ফুয়েল) ‘ফাত্তাহ-১’ ও ‘হাজি কাসেম’ এবং তরল জ্বালানিভিত্তিক ‘খোররামশাহর’ ক্ষেপণাস্ত্র, যা ২ টন ওয়ারহেড বহন করতে পারে। চলতি বছরেই এসবের ঘোষণা দিয়েছিল ইরান। সোমবার আইডিএফ জানিয়েছে, তারা ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস করেছে।

আর্লিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিসের ডেকার এভেলেথ বলেন, ‘যদি আইডিএফ ইরানের অভ্যন্তরে উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করতে পারে এবং তা ধারাবাহিকভাবে করতে পারে, তবে তারা ইরানের পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারবে।’

তবে এটা করতে হলে ইসরায়েলকে ইরানের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে আকাশ আধিপত্য ধরে রাখতে হবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে কঠিন কাজ। ইসরায়েলের একটি সামরিক সূত্র জানিয়েছে, ‘পুরো পরিকল্পনা নির্ভর করছে—ইসরায়েল ইরানে শুধু সামরিক স্থাপনায় হামলা করবে, না কি এর বাইরেও যাবে—যেমন সরকারি প্রতীকী স্থাপনাগুলোতেও হামলা হতে পারে।’

সূত্রটি আরও জানিয়েছে, ইসরায়েল তাদের সামরিক লক্ষ্যে প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ফলে এই লক্ষ্যমাত্রার তালিকা পূরণ ‘সম্ভবত’ অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যেতে পারে। তবে সামরিক আধিপত্য মানেই যে ইসরায়েল তার মূল লক্ষ্য অর্জন করবে, তা নয়। এই বিষয়ে এভেলেথ বলেন, ‘তাদের (ইসরায়েল) ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে হবে বা এমন ক্ষতি করতে হবে যা ইরান মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু সেই অপূরণীয় ক্ষতি আসলে কী, সেটা কেউ জানে না।’

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জোন অল্টারম্যান বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত ফলাফল নির্ভর করবে কম সম্ভাবনা, কিন্তু বড় প্রভাব ফেলতে পারে এমন ঘটনার। এর মধ্যে—গণহত্যার মতো কোনো হামলা, কিংবা এমন কিছু, যা রাজনৈতিকভাবে চরম বিভক্তি তৈরি করবে ইরান বা ইসরায়েলে।’

অল্টারম্যানের মতে, ‘সামরিক অভিযান রাজনৈতিক ফল বয়ে আনে, আর যুদ্ধের লক্ষ্য মূলত রাজনৈতিকই হয়। এই যুদ্ধ রাজনৈতিকভাবে অন্য অনেক যুদ্ধের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুধু সামরিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়েই একে বিচার করা যাবে না।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেয়াদের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পরিকল্পনা সরকারের

নারীর সঙ্গে এনসিপি নেতা তুষারের কথোপকথন ফাঁস নিয়ে যা বললেন সহযোদ্ধা ইমি

ঐকমত্য কমিশনের মঙ্গলবারের সংলাপ ‘বয়কট’ করল জামায়াত

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব নয়, স্বীকার করল ইসরায়েল

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধে আইন পরিবর্তন করায় জাতিসংঘের উদ্বেগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত