Ajker Patrika

যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে উপসাগরীয় দেশগুলো

  • যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র
  • উপসাগরীয় দেশগুলোয় হামলা চালিয়ে বসতে পারে ইরান
  • ইরানের পরমাণু কর্মসূচি জোরদার হতে পারে
  • ইরানে সরকারপতন হতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে শূন্যতা
আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৫, ১৬: ১২
গতকাল শুক্রবার রাতে তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ছবি: সংগৃহীত
গতকাল শুক্রবার রাতে তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ছবি: সংগৃহীত

ইরানে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় তেহরানের সামরিকপ্রধান, শীর্ষ বেশ কয়েকজন জেনারেল, শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীসহ নিহত হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন। হামলার জবাবে বেশ কয়েক দফায় ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে ইরানও। পাল্টাপাল্টি সেই হামলা গতকাল শনিবারও অব্যাহত ছিল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এ সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যকে কোন দিকে নিয়ে যাবে?

এখন পর্যন্ত জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বই উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সেই আহ্বানে যদি সংঘাতে জড়ানো দেশ দুটি কান না দেয়, তাহলে কী ঘটতে পারে? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক বিশ্লেষণে এ সংঘাতের সম্ভাব্য কিছু পরিণতি অনুমান করার চেষ্টা করা হয়েছে।

যুদ্ধে সরাসরি জড়াতে পারে যুক্তরাষ্ট্র

ইরানে হামলা করার পরপরই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দাবি করেছিলেন, ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে নিজ দায়িত্বে। যুক্তরাষ্ট্র এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। কিন্তু হামলার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই জানত। কাজেই ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুগুলোয় আঘাত হানতে পারে।

বিশেষ করে ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এবং ওই অঞ্চলে মার্কিন কূটনৈতিক মিশনগুলো হতে পারে তাদের লক্ষ্যবস্তু। ইরানের সমর্থনপুষ্ট হামাস ও হিজবুল্লাহ এখন হয়তো দুর্বল হয়ে পড়েছে; কিন্তু ইরাকের ইরান সমর্থক মিলিশিয়া বাহিনীগুলো এখনো সক্রিয়।

মার্কিন লক্ষ্যবস্তুগুলোয় যে হামলা হতে পারে, সে আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরও রয়েছে। এ কারণে তারা ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিছু জনবল সরিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালালে তার পরিণতি হবে করুণ। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে পড়ে তেল আবিব কিংবা অন্য কোথাও কোনো মার্কিন নাগরিক হতাহত হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সত্যিই বসে থাকতে পারবেন না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বহু আগে থেকেই ইরানকে ঘায়েল করতে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি মাঠে নামানোর চেষ্টা করে আসছেন। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই ইরানের অতি সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসে সক্ষম বোমারু বিমান ও বাঙ্কারবিধ্বংসী বোমার মজুত রয়েছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র চাইলে সেখানে হামলা করতেও পারে।

ট্রাম্প অবশ্য তাঁর নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ‘চিরকালীন যুদ্ধের’ সূত্রপাত ঘটাবেন না। কিন্তু বহু রিপাবলিকান ইসরায়েল সরকার ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। বিশেষ করে ইরানে সরকার পরিবর্তনে ইসরায়েলের তৎপরতাকে সমর্থন করে তারা। যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তা হবে এক সুদীর্ঘ সংঘাত, যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

সংঘাতে জড়াতে পারে উপসাগরীয় দেশগুলো

ইরান ইসরায়েলের সুরক্ষিত সামরিক ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলে তারা গায়ের ঝাল মেটাতে উপসাগরীয় অঞ্চলে সহজ কোনো লক্ষ্যবস্তু বেছে নিতে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশ তার শত্রুদের সহায়তা করে আসছে বলে মনে করে তাদেরকে। মধ্যপ্রাচ্যে হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে এমন বহু জ্বালানিসহ অন্যান্য অবকাঠামো রয়েছে। ২০১৯ সালে ইরান সৌদি আরবের তেলখনিতে হামলা চালিয়েছিল। ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুতিরা ২০২২ সালে হামলা করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে মার্কিন বিমানঘাঁটি রয়েছে। আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশ গত বছর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলে সহযোগিতা করেছিল। এই অবস্থায় উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় যদি ইরানি হামলা হয়, তাহলে হয়তো প্রতিরোধ গড়তে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো আকাশে উড়তে পারে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি জোরদার হতে পারে

ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে এবারের অভিযান শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের কাছে ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম রয়েছে, যা সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। অর্থাৎ ওই ইউরেনিয়াম অস্ত্র তৈরির মানে উঠতে খুব বেশি বাকি নেই। এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম ১০টির মতো পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ধারণা, ইরানের এই সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়াম মাটির নিচে গোপন কোনো খনির গভীরে লুকানো রয়েছে। সেটা হয়তো ধ্বংস করা ইসরায়েলের পক্ষে সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক অস্ত্রই নিজেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় মনে করে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব তা তৈরির কাজের গতি আরো বাড়িয়ে দিতে চাইতে পারে। এটা ঘটলে ইসরায়েল অন্তত আরও হামলা চালাবে ইরানে। পাল্টা জবাব দেবে তেহরানও। ফলে মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি দীর্ঘ সংঘাতের কবলে পড়বে।

বিশ্ব ফের অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে পারে

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরু হতে না হতেই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সংঘাতের জেরে ইরান যদি পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরকে যুক্ত করা জলপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের চেষ্টা করে, তাহলে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি ইয়েমেনের হুতিরা যদি আরো পশ্চিমে থাকা লোহিতসাগরে তাদের উৎপাত আরও বাড়িয়ে দেয়, তার প্রভাব হবে আরও জটিল। ২০১০ সালের বৈশ্বিক মন্দা, কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধসহ নানা সংঘাত-সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি দেড় দশক ধরে ধুঁকছে। তার জেরে বহু দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে তেলের দাম বেড়ে গেলে বিপর্যস্ত হবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

অবশ্য এমন পরিস্থিতিতে একটি দেশ লাভবান হতে পারে। সেই দেশটি হলো রাশিয়া। তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে ক্রেমলিনের পকেটে আরও হাজার কোটি বাড়তি ডলারের প্রবাহ। সেই অর্থনৈতিক প্রবাহ নিঃসন্দেহে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার শক্তি আরও বাড়াবে।

ইরানে সরকারপতন, সৃষ্টি হতে পারে শূন্যতা

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করাই তাঁর লক্ষ্য। তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ইরানে সরকার পরিবর্তন। নেতানিয়াহু ইরানের জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর এই অভিযান দেশটির ‘স্বাধীনতাকামীদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করছে’।

কিন্তু ইরানে যদি সত্যিই সরকার পতন ঘটে যায়, তাহলে বিশাল এক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। তার পরিণতি কী হবে, তা এখনই কল্পনা করা সম্ভব নয়। তবে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের পতনের পর ইরাক ও লিবিয়ায় কী ঘটেছে বিশ্ব তা দেখেছে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত