Ajker Patrika

মূল্যস্ফীতি: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঐতিহাসিক অনুঘটক

অনলাইন ডেস্ক
মূল্যস্ফীতি: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঐতিহাসিক অনুঘটক

অর্থনৈতিক সংকট এখন বৈশ্বিক পটপরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। বিষয়টি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ঐতিহাসিক এই বিষয়টি রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রভাবকে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো দেশে সরকারের পতনেরও কারণ হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অনেক সময়ই নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হয় মূল্যস্ফীতির কারণে। স্বৈরতান্ত্রিক দেশেও যে বিষয়টি ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে তা এযাবৎ সামান্যই আলোচিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি হলো সেই অনুঘটক যা সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করে—যে সংহতিকে ব্যবহার করে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব খাটায় স্বৈরশাসকেরা।

সম্প্রতি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন কট্টর ডানপন্থী হাভিয়ের মিলেই। নিজস্ব ধাঁচের অ্যানার্কো–ক্যাপিটালিজম বা নৈরাজ্যবাদী–পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারণা প্রচার করছেন তিনি। তাঁর এমন জয়ের ক্ষেত্রে তৈরি করে দিয়েছে স্থবির অর্থনৈতিক সংকট। সংকট এতটাই তীব্র যে, মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৪৩ শতাংশে। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি—যেমন, দ্রব্যমূল্য কমানো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলোপ ও মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভর থেকে বেরিয়ে আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসোকো প্রতিস্থাপন করা।

মুদ্রা ব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসন আর্জেন্টিনার মতো দেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ এর ফলে আর্থিক বিষয়াদির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে কমে যাবে এবং মিলেইয়ের মূল ফোকাস মূলত এখানেই। কারণ আগের সরকার যথেষ্ট চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় জনগণ মনে করছে, মিলেইয়ের এই উদ্যোগ অন্তত ভুল ব্যবস্থাপনার চেয়ে ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। 

আর্জেন্টিনার বাইরে রাশিয়ার কথা যদি ধরা যায়, তাহলে আপাতদৃষ্টি দেখা যায়—দেশটি বর্তমানে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটিয়ে বেশ স্থিতিশীল রয়েছে। দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ৭ শতাংশ। বিপরীতে গত বছরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোজোনের দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুটা সময়ের জন্য দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোজোন শিগগিরই সেই মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। বিপরীতে রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকেই।
 
২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি বাড়ে। বিশেষ করে, সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর। তবে মাসখানেক পরই মূল্যস্ফীতি কমতে থাকে। একটা পর্যায়ে, রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি মাত্র আড়াই শতাংশে নেমে আসে। ধারণা করা হচ্ছিল, এই পরিস্থিতি বজায় থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। সে বছরের গ্রীষ্মে মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে শুরু করে। বাড়তে বাড়তে ৬ শতাংশে ঠেকেছে। 

মস্কো বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের হতাশা ব্যক্ত করা থেকে দীর্ঘদিন বিরত থাকলেও সম্প্রতি পুতিন বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন। এমনকি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বনিম্ন সুদহার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতিতে যে বর্ধিত সুদহার ঘোষণা করা হয়েছে তার তিনগুণ।

পুতিন হয়তো ভালো করেই জানেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে অসন্তোষ প্রায়শই একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের সামাজিক সমর্থন হারানোর প্রথম লক্ষণ। যদিও সাধারণ নাগরিকেরা সরকার সম্পর্কে খোলাখুলি অভিযোগ করতে পারে না—পাছে গ্রেপ্তার হতে হয় বা কঠোর শাস্তি দেওয়া হয় এই ভয়ে। সাধারণ নাগরিকেরা সর্বোচ্চ যা করতে পারেন তা হলো—বাজারে গিয়ে দর-কষাকষি করা! 

রাশিয়ার মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ যুদ্ধের কারণে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি। তবে কেবল ব্যয় বৃদ্ধি নয়, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাও মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে। সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে ক্রেমলিন জনসমর্থন কেনার চেষ্টা করার কারণেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, রুশ সৈন্যরা এখন আগের গড় বেতনের তুলনায় আড়াই গুণেরও বেশি বেতন–ভাতা পায়। কোনো সৈন্য মারা গেলে পরিবারকে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যা রুশ মুদ্রা রুবলে প্রায় ৫০ লাখ। 
 
সব মিলিয়ে রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতির লক্ষণগুলো সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে মূলত সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হতে না চাওয়া ৮ থেকে ৯ লাখ কর্মক্ষম যুবকের দেশ ছেড়ে যাওয়ায়। এতে দেশটির শ্রমবাজারে অদক্ষ শ্রমিক বেড়েছে। ফলে দক্ষ জনশক্তি টানতে বেতন দিতে হচ্ছে বেশি। বিষয়টি হয়তো স্বল্প মেয়াদে কাজ করতে পারে, কিন্তু খুব শিগগিরই মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে যে, তারা যে বেতন পায় তা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও কঠিন হয়ে উঠছে।
 
মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতি একটি ঐতিহাসিক শিক্ষার ওপর নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে। যেমন, ১৯১০–এর দশকে মূল্যস্ফীতির কারণেই জারের শাসনামলে সামাজিক সংহতি ভেঙে পড়ে। পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রুশ সাম্রাজ্য বাজেটে ভারসাম্য রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়েছিল। এমনকি রাশিয়া সে সময় বিশ্বের খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ হয়েও মূল্যস্ফীতি থেকে বাঁচতে পারেনি। যুদ্ধের শুরুর দিকে রুশ কৃষকেরা সামরিক বাহিনীর কাছে খাদ্যশস্য বিক্রি করে ভালোই পয়সা কামিয়েছিল। কিন্তু ১৯১৬ সাল নাগাদ কৃষকেরা বুঝতে পারেন, তাঁরা খাদ্যশস্য বিক্রি করে যে টাকা পাচ্ছেন তা দিয়ে ন্যূনতম চাহিদা ব্যয় সংস্থানও করা যাচ্ছে না। হতাশ হয়ে তাঁরা খাদ্যশস্য বিক্রি না করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে শুরু করেন।
 
মূল্যস্ফীতি একসময় এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, জারের আমলের পিটার দ্য গ্রেটের প্রতিচ্ছবিযুক্ত ৫০০ রুবলের নোট আর জারিনা ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটের প্রতিচ্ছিবযুক্ত ১০০ রুবলের নোট কার্যত মূল্য হারায়। স্রেফ কাগজের টুকরায় পরিণত হয়। এমনকি একটা পর্যায়ে কৃষকেরা কাগুজে মুদ্রা নিতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে খাদ্যশস্যের ঘাটতি শুরু হয় এবং শহর অঞ্চলে জার শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৭ সালে দুইটি বিদ্রোহ, সবশেষে বিপ্লব সংঘটিত হয়। সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে শুরু করে। কারণ বেতন দিয়ে আর পোষাচ্ছিল না।
 
যাই হোক, বলশেভিকরা ক্ষমতায় এসে নাটকীয় কিছু উদ্যোগ নেওয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। সেটি করতে গিয়ে বলশেভিক সরকার চেরভোনেৎস বা স্বর্ণমুদ্রা চালু করার পরিকল্পনা করে। এমনকি তারা কিছু মুদ্রা তৈরিও করেছিল। 
 
যাই হোক, রাশিয়ার অতীত অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই আশ্চর্যজনক একটি ধারাবাহিকতা দেখা যায়। ১৯৯৭ সালে প্রবর্তিত বর্তমান ৫০০ রুবলের নোটও রাশিয়ার বাজারে সেই অবস্থায় পৌঁছেছে যেমনটা ১৯১০–এর দশকে পৌঁছেছিল পিটার দ্য গ্রেটের প্রতিচ্ছবি সংবলিত ৫০০ রুবলের নোট। সে সময় রাশিয়া যে পরিস্থিতিতে পড়েছিল বর্তমানের রাশিয়াও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। 

সাধারণ মানুষ তখনই সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় যখন ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে দেখে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এমনই একটি প্রাচীন প্রতিশ্রুতি যা যুগ যুগ ধরে সরকারগুলো সাধারণ জনগণকে দিয়ে এসেছে। রাশিয়ার অর্থনীতিও এখন এমন সব স্পষ্ট লক্ষণ দেখাচ্ছে যে, সরকার যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পূরণ করতে পারছে না। আর তাই, ইতিহাস বলে এমন সরকার প্রতিস্থাপিত হয়, কারণ তারা জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করে। মানুষ ‘সেকেলে অকার্যকর’ ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক হ্যারল্ড জেমসের নিবন্ধ।

অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

বগুড়ায় ইফতারের পর ডেকে নিয়ে যুবককে হত্যা

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত