Ajker Patrika

ট্রাম্প-সি বৈঠক: দর-কষাকষিতে এগিয়ে কে, সম্ভাব্য ফলাফল কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ২১
দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে বৈঠক করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে বৈঠক করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা করছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান নানা সমস্যা ‘অনেকটাই সমাধান হবে’। আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকটি দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই পরাশক্তির সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের পণ্যের ওপর শতভাগের বেশি প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, আর বেইজিং রপ্তানি সীমিত করেছে প্রতিরক্ষা শিল্প ও এআই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য বিরল খনিজে।

গত আগস্ট থেকে বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে দুই দেশের কর্মকর্তারা আলোচনায় বসেছেন। গত সপ্তাহান্তে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি বাণিজ্য চুক্তির কাঠামোতেও তারা একমত হন। দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংজু শহরে গতকাল বুধবার এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপেক) সম্মেলনের ফাঁকে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তিটি দুই দেশের জন্যই ইতিবাচক হবে এবং ‘সবার জন্য উত্তেজনাপূর্ণ কিছু নিয়ে আসবে’।

তবে প্রকৃতপক্ষে কোনো বাণিজ্য চুক্তি হতে যাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করবে কেবল ট্রাম্প-সি বৈঠকই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই চুক্তি নিয়ে প্রত্যাশা খুব বেশি নয়। দুই দেশের সম্পর্কের গভীর জটিলতা এখন দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের দিকেই ইঙ্গিত করছে।

ট্রাম্প ও সি আজ বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরনগরী বুসানে সাক্ষাৎ করবেন। বৈঠকটি স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় শুরু হয়ে গেছে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে প্রবেশে পর দুই নেতার প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ এটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে জাপানের ওসাকায় জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে তাদের দেখা হয়েছিল।

বুধবার দক্ষিণ কোরিয়াগামী এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট সির সঙ্গে আমাদের দারুণ একটি বৈঠক হবে। অনেক সমস্যার সমাধান হবে।’ একই দিনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানায়, দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে মতবিনিময় করবেন।

বৈঠকে আলোচনার বিষয়গুলো হতে পারে—বাণিজ্য শুল্ক, যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণঘাতী ফেন্টানিল মাদক পাচার, চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনা, যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তাইওয়ান ইস্যুতে ভূরাজনৈতিক অবস্থান, যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে চীনা জাহাজের ওপর আরোপিত বন্দর ফি এবং টিকটকের মালিকানা বিক্রি সংক্রান্ত আলোচনা।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলেহান্দ্রো রেইয়েস বলেন, উভয় পক্ষই এই বৈঠকে অস্থিতিশীল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে, তবে উদ্দেশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটনের লক্ষ্য হলো প্রমাণ করা যে, তাদের কঠোর অবস্থান ফল দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া ও জাপানের সঙ্গে যেসব বাণিজ্য চুক্তি করেছে, সেগুলো বাজারে প্রবেশাধিকারকে জাতীয় নিরাপত্তার সহযোগিতার সঙ্গে যুক্ত করছে। এসব চুক্তিতে অংশীদার দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ শৃঙ্খলার নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বাধ্য করছে।’

রেইয়েস আরও বলেন, অন্যদিকে ‘বেইজিংয়ের লক্ষ্য শান্ত ও স্থিতিশীল ভাবমূর্তি উপস্থাপন করা। চীন সম্প্রতি সি চিনপিংয়ের ক্ষমতাকে পুনর্নিশ্চিত করেছে এবং আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করেছে। চীন এখন বার্তা দিতে চায়— তারা পশ্চিমা চাপ সামলে উঠেছে, এখন উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।’

তবে রেইয়েসের মতে, বাণিজ্য শুল্ক, বিরল খনিজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ভূরাজনৈতিক কৌশল—এসব ইস্যু এত গভীরে প্রোথিত যে সহজে মীমাংসা হবে না। তিনি বলেন, ‘এখন অবিশ্বাস কাঠামোগত। শক্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে দুই দেশের চিন্তাভাবনাতেই সেটি প্রোথিত।’

দর-কষাকষিতে কার অবস্থান কতটা শক্ত

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার ভারসাম্য সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বদলেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি সীমিত করেন, যা চীনের জন্য বড় ধাক্কা ছিল। চলতি বছরের শুরুতে ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্কারোপ করে উত্তেজনা আরও বাড়ান।

চীন পাল্টা ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসায়, যতক্ষণ না মে মাসে উভয় দেশ নতুন আলোচনার সুযোগ দিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। এর মধ্যেই চীন এপ্রিল মাসে সাতটি বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, পরে অক্টোবর মাসে আরও পাঁচটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জবাবে ট্রাম্প ১০০ শতাংশ নতুন শুল্কের হুমকি দেন।

চীন এদিকে সরবরাহ শৃঙ্খলা বৈচিত্র্য আনতে আসিয়ান (আসিয়ান) সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি জোরদার করেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রও জাপান, মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে। বুধবার দক্ষিণ কোরিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক কমানোর একটি বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা করেছে।

রেইয়েস বলেন, উভয় পক্ষের হাতেই ভিন্ন ধরনের শক্তি আছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন এক নতুন মিত্রজোট গড়ে তুলেছে, যারা কার্যত ওয়াশিংটনের শর্তে সই করেছে।’ মালয়েশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক চুক্তি তারই উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, ‘তবে চীনের কাছে রয়েছে সহনশীলতা ও অর্থনৈতিক স্থিতি। তারা এখনো বিশ্ব উৎপাদনের কেন্দ্র, বিরল খনিজ প্রক্রিয়াজাতে প্রভাবশালী, এবং শুল্ক যুদ্ধেও ভেঙে পড়েনি। বরং এই যুদ্ধ তাদের আরও দক্ষ ও দ্রুত করেছে।’ তাঁর ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের হাতে উচ্চ স্বরে চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা, চীনের হাতে স্থিতিশীল সহনশক্তি। ওয়াশিংটন সংঘাত বাড়াতে পারে, কিন্তু বেইজিং টিকে থাকতে জানে।’

বৈঠকের সম্ভাব্য ফল

ট্রাম্প যদিও বৈঠককে ‘দারুণ’ বলে উল্লেখ করেছেন, বিশ্লেষকেরা খুব বড় কোনো ফলাফল আশা করছেন না। রেইয়েস বলেন, ‘বৈঠকের পর দুই পক্ষই হয়তো কিছু ছোট সাফল্যের কথা জানাবে— যেমন শুল্ক কার্যকরে বিলম্ব, বাণিজ্য স্থিতিশীলতা নিয়ে যৌথ বিবৃতি, বা বিরল খনিজ সহযোগিতায় একটি কার্যকরী কমিটি।’

তাঁর মতে, ‘এই সম্মেলন প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ করার নয়; বরং নতুন একপর্যায়ে প্রবেশের ঘোষণা। যুক্তরাষ্ট্র নতুন চুক্তির মাধ্যমে জোট গড়ছে, চীনও তাই করছে সহনশীলতা ও স্থিতিশীলতা দিয়ে। মূলত, এই বৈঠক শেখাবে— প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ করা নয়, বরং তা নিয়েই কীভাবে সহাবস্থান করা যায়।’

তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...