Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন

মাদুরোর পতন ঘটাতে ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মাচাদো

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মারিয়া কোরিনা মাচাদো। ছবি: এএফপি
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মারিয়া কোরিনা মাচাদো। ছবি: এএফপি

২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি। ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলের প্রধান মারিয়া কোরিনা মাচাদোর দলের চারজন প্রতিনিধি ক্যাপিটল হিল অফিসের সোফায় বসেন। বৈঠক চলছে মাইক ওয়াল্টজের সঙ্গে, যিনি কিছুদিন পরই আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক হতে যাচ্ছেন। ভেনেজুয়েলায় তাঁর গোপন আস্তানা থেকে মাচাদো বৈঠকে ভিডিও কলে অল্প কিছু সময়ের জন্য যোগ দেন।

ডেভিড স্মোলানস্কি, যিনি ওয়াশিংটনে মাচাদোর অফিসটা চালান, তিনি বৈঠকে ব্যাখ্যা করলেন, কীভাবে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো আসলে দেশটির সশস্ত্র সংগঠন ত্রেন দে আরাগাকে (টিডিএ) নিয়ন্ত্রণ করেন।

বৈঠকে উপস্থিত অন্তত দুজনের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। সেই দুজনই জানিয়েছেন, বৈঠকে ওয়াল্টজ পুরোটা সময় নোট নিয়েছেন।

এর আগে কখনো এই বৈঠকের ভেতরের খবর সংবাদমাধ্যমে আসেনি। বৈঠকটি মাচাদোর দিক থেকে একটি ‘ঝুঁকি যেমন, তেমন লাভ’ পরিকল্পনার অংশ ছিল। কিছুদিন আগে শান্তিতে নোবেলজয়ী মাচাদোর দিক থেকে ওই বৈঠক ছিল ট্রাম্পের দলের উচ্চপদস্থদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করার একটি মাধ্যম। ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী দল মনে করে, অপরাধী চক্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় ঝুঁকি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে (ট্রাম্পের দলের) এমন ধারণার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।

রয়টার্স ৫০টির বেশি ‘সূত্রে’র সঙ্গে কথা বলেছে, যেগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলের সদস্য, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তথ্য সরবরাহকারীসহ অনেকে আছেন। মাচাদোর দল কীভাবে ভেনেজুয়েলারই সরকারের বিরুদ্ধে বয়ান তৈরি করে ট্রাম্প প্রশাসনকে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেটা ওই ‘সূত্রগুলোর’ সঙ্গে রয়টার্সের আলোচনায় উঠে এসেছে। এমনকি ট্রাম্পের কঠোর পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের ওপর ধাক্কা আসার শঙ্কাও পাত্তা পায়নি মাচাদোর দলের কাছে।

ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ও পরে মাচাদোর নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের নেতারা বেশ কয়েকবার ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল, যাতে মাদুরোর ওপর চাপ বাড়ে। মাদুরোর বিরোধিতায় মাচাদোর সঙ্গী দলগুলোও মাচাদোর দলের পেশ করা বক্তব্য ও প্রতিবেদনের নেপথ্যের গবেষণায় হাত লাগিয়েছেন। সূত্রকে উৎস জানিয়ে রয়টার্স লিখেছে, মাদুরো এবং এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে অনেক তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোকে জানিয়েছেন মাচাদোর দলের সদস্যরা।

মাচাদো ও অন্য বিরোধী দলগুলোর সাহায্যে বানানো প্রতিবেদন দেখে বোঝা যায়, মাদুরোই ত্রেন দে আরাগাকে নিয়ন্ত্রণ করেন—এই ধারণাকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছে মাচাদোর নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো। ট্রাম্প প্রশাসন ও তাঁদের স্বার্থ একই জায়গায় মিলছে দেখে গোপনে এবং প্রকাশ্যে এই ধারণার প্রচারও চালিয়েছে তারা। তবে ভেনেজুয়েলা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান কৌশলের নেপথ্যে তাদের প্রচারণার সম্পর্ক কতটা, সেটা রয়টার্স পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি।

জানুয়ারিতে ওয়াল্টজের সঙ্গে মাচাদোর দলের বৈঠকের পর ওয়াশিংটন ত্রেন দে আরাগাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে ঘোষণা করে। মাদুরো এই সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে বলেও জানায় ওয়াশিংটন; পাশাপাশি মাদুরোকে গ্রেপ্তারের পুরস্কার হিসেবে ৫ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।

ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে নৌবাহিনীর দাপট বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ভেনেজুয়েলার উপকূলে অন্তত আটটি নৌকায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। নৌকাগুলো মাদকদ্রব্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে দাবি তাদের। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, পাচার হয়ে যে পরিমাণ কোকেন যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকে, তার খুবই সামান্য অংশই ভেনেজুয়েলা হয়ে আসে।

ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিহত ১১ জন ত্রেন দে আরাগার সদস্য, যদিও তাদের সদস্য থাকার কোনো প্রমাণ হাজির করা হয়নি। এর আগে এই মাসের শুরুর দিকে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর গোপন কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছেন। এ-ও বলেছিলেন, ভেনেজুয়েলার সীমানার ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ট্রাম্পের তেমন কৌশলেও অকুণ্ঠ সমর্থন মাচাদোর। তাঁর কথা, পরিস্থিতি তেমন হতে দিতে না চাইলে মাদুরোর পদত্যাগ করা উচিত।

রয়টার্সের এই প্রতিবেদনের জন্য মন্তব্যের আবেদনে অবশ্য ‘না’ জানিয়ে দিয়েছেন মাচাদো। আর ৬ জানুয়ারির বৈঠক নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেননি ওয়াল্টজ, যিনি এখন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মাদুরোর সম্পর্ক নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি ভেনেজুয়েলার তথ্য মন্ত্রণালয়।

হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর মাদুরো ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট বনে যান ২০১৩ সালে। এরপর থেকে তাঁর শাসনামলে ভেনেজুয়েলা অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেখেছে, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগও আছে মাদুরোর বিরুদ্ধে। ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাচাদোর নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ৭০ শতাংশ ভোট নিয়ে জিতেছে, সেই নির্বাচন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে, তবু সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা মাদুরো চেয়ার ছাড়েননি। পশ্চিমের নানা নিষেধাজ্ঞা, অনেক আলাপ-আলোচনা ও অপরাধের অভিযোগও তাঁকে টলাতে পারেনি।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবিষ্কৃত তেলের মজুত ভেনেজুয়েলায়। সে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারির হস্তক্ষেপ করা উচিত কি না—এই প্রশ্নটা মাচাদোকে করা হয় ১০ অক্টোবর, তিনি শান্তিতে নোবেল জেতার পর। উত্তরে মাচাদো বলেছেন, ‘আপনি যখন একটা অপরাধী প্রশাসনের সঙ্গে লড়ছেন, তখন শক্তির প্রয়োগ ছাড়া তো স্বাধীনতা আসবে না।’ শান্তিতে নোবেল জয়ের পর সেটি ভেনেজুয়েলার জনগণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উৎসর্গ করেছিলেন মাচাদো।

এর আগে সেপ্টেম্বরে ট্রাম্পকে একটি চিঠি লিখেছিলেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, তাঁর সরকারের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্কের অভিযোগ ‘পুরোপুরি মিথ্যা’। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দাবিও অসত্য জানিয়ে মাদুরো বলেছেন, ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র কার্যকর।

মূলত ভেনেজুয়েলায় জেলে থাকা কয়েকজনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ত্রেন দে আরাগা এখন লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন দেশেই নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। লাতিন দেশগুলোর সরকার ত্রেন দে আরাগাকে তাদের দেশের জন্য বড় হুমকি মনে করে। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রে ‘হামলা চালানো’র পরিকল্পনা করছে—এমন দাবি নাকচ করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আপিল আদালত। ট্রাম্প প্রশাসন পাইকারি হারে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার কৌশল নেওয়ার পর ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)’ আপিল আদালতে অভিযোগ করে, সে মামলার শুনানিতেই কথাটা বলেছিলেন আদালত।

এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের ফাঁস হয়ে যাওয়া এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ত্রেন দে আরাগার সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সরকারের সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলান প্রশাসনের অল্প কয়েকজন কর্মকর্তা ‘অর্থের বিনিময়ে টিডিএকে সাহায্য করে থাকতে পারেন।’ তবে মাদুরো এই গ্রুপের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।

উভয়সংকট

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে মাচাদোর আঁতাতকে ‘সমাধান-অসাধ্য উভয়সংকট’ জানিয়ে মাচাদোরই দলের কেউ কেউ এর বিরোধিতা করছেন। টিডিএর কারণে মাদুরোর প্রশাসনের ওপর ট্রাম্প যে চাপ তৈরি করেছেন, সেটা মাদুরোর বিরোধী পক্ষের অনেক দিনের চাওয়া। কিন্তু এর পাশাপাশি নিজের অভিবাসনবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ভেনেজুয়েলানদেরও টিডিএর সদস্য বলে বিপদের মুখে ফেলছেন।

ট্রাম্প যখন হাজারো ভেনেজুয়েলান অভিবাসীর অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, শত শত ভেনেজুয়েলান অভিবাসীকে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন, টিডিএর সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে অভিযুক্তদের এল সালভাদরের জেলে পাঠিয়েছেন, মাচাদো তেমন কিছুই বলেননি। সম্প্রতি মাদক বহনের অভিযোগ তুলে ভেনেজুয়েলার উপকূলে বেশ কয়েকটি নৌকায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় অনেকে যখন মারা গেলেন, সেটা বিচারবহির্ভূত হত্যার সংজ্ঞায় পড়লেও মাচাদো এর সমর্থনে বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত।

মাচাদোর দল এটা বুঝতে পারছে যে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তাদের আঁতাতের কৌশলে বড় ঝুঁকি আছে। ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষ তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলতে পারে—এই ঝুঁকি তো আছেই। তবে বিরোধী দলের দুটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে আঁতাতই ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ফেরানোর সবচেয়ে সেরা উপায়। সম্ভাব্য ফাঁদ থাকা সত্ত্বেও মাদুরোকে সরানোই তাদের ‘বড় লক্ষ্য’ বলে জানিয়েছেন ওই দুজনের একজন।

তুলান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেনেজুয়েলা বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্মিলড রয়টার্সকে বলেছেন, যদি এতে কাজ হয়, তাহলে ‘তিনি (মাচাদো) বনে যাবেন ভেনেজুয়েলার রক্ষাকর্তা।’ কিন্তু কিছু না হলে, এত বছরে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের মিথ্যা আশ্বাস দেখে বিরক্ত এবং পরিবর্তনের আশায় মরিয়া ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের সমর্থন হারাবেন তিনি। আর যদি মাদুরোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হামলা থেকে কোনো যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে দেশের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞের দায় পড়বে তাঁর (মাচাদো) ঘাড়েই। এই পুরো কৌশলটাই ‘ঝুঁকিও বেশি, লাভও বেশি’ কৌশল।

যোগাযোগের পথটা মসৃণ

২০ জানুয়ারি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই মাচাদোর দলের প্রতিনিধিরা ফ্লোরিডার রিপাবলিকানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে সে সময়ের সিনেটর মার্কো রুবিও ছিলেন। ওয়াল্টজ পদত্যাগ করার পর থেকে রুবিওই ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক। ২০১৮ সালেই তিনি বলেছিলেন, ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা হামলা করলে সেটা অন্যায্য হবে না। একসময়ে ট্রাম্পের কড়া সমালোচক থেকে এখন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বনে যাওয়া রুবিও যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিমালা; বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বৈদেশিক নীতিমালা প্রণয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন।

ওই বৈঠকগুলোর কারণে টিডিএর সঙ্গে মাদুরোর সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য টিডিও এবং আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী কার্তেল দে লস সোলেস কতটা হুমকির—এসব ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নেতিবাচক ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র টমি পিগট অবশ্য রুবিওর সঙ্গে ভেনেজুয়েলার বিরোধীদের নিয়মিত যোগাযোগের ব্যাপারটি জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের কারণে টিডিএর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল বদলেছে, এমন ধারণাও অস্বীকার করেছেন।

ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলগুলোর প্রতি রুবিওর সমর্থন অবশ্য অনেক পুরোনো এবং সেটা জনসমক্ষেও বলেছেন রুবিও। ২০১৯ সালে মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টার সময় বিরোধী পক্ষের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পক্ষে কথা বলেছিলেন রুবিও।

মাচাদোকে শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত করে ২০২৪ সালে এক চিঠিতে রুবিও এবং ওয়াল্টজ—দুজনই সই করেছেন। গত এপ্রিলে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে’র তালিকায় মাচাদোর নাম থাকায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করে রুবিও লিখেছেন, এক দশক আগে তাঁদের পরিচয় হয়েছিল।

২০২৪ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় টিডিএর ব্যাপারে ট্রাম্পের আলোচনার আগেও, মাচাদোর দলের ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরামর্শক’ ইভান সিমোনোভিস সংবাদমাধ্যমে এসে বলেছিলেন, এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে মাদুরোই পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে, যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি দেননি। পরে ট্রাম্পও টিডিএর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে অনেক ভেনেজুয়েলানকে দেশে ফেরত পাঠানোর সময় মাদুরোর সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন, যদিও তিনিও কোনো প্রমাণ দেননি। ভেনেজুয়েলান পুলিশের সাবেক প্রধান সিমোনোভিচ রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য ও যোগাযোগের সূত্র দিয়েছেন। এই তথ্যগুলো ভেনেজুয়েলার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া বলেও জানিয়েছেন। যদিও রয়টার্সকে এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সিমোনোভিচ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের তৃতীয় আরেকজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ২০০২৪ সালের শেষ অংশে ভেনেজুয়েলার নির্বাসিত সাবেক কর্নেল গুস্তাভো আরোচা, যিনি কিনা মাচাদোর দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, তিনি এই টিডিএর ব্যাপারে গবেষণার তথ্য মাচাদোর দলকে দিয়েছেন। সঙ্গে ডানপন্থী থিংকট্যাংক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের একটা গবেষণাপত্রও দিয়েছেন, যেখানে দাবি করা হয়েছে, এই টিডিএ গ্যাং আসলে মাদুরোরই একটা প্রক্সি।

জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে মাচাদোর দল অন্তত আটবার ওয়াল্টজ, রুবিও, সে সময়ের বিশেষ পরামর্শক মরিসিও ক্লাভের-কারোন, ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিস্টফার লানডাউয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে বৈঠকগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে। ক্লাভের-কারোনও রুবিওর মতোই একজন কিউবান-আমেরিকান, যিনিও ভেনেজুয়েলার ওপর মার্কিন মিলিটারি হামলাকে সমর্থন করেন। ভেনেজুয়েলা কিউবার কমিউনিস্ট পদ্ধতিতে সহায়তা করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভেনেজুয়েলান বিরোধী দলের দুটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, এই আটটি বৈঠকের তিনটিতে তাঁরা কার্তেল দে লস সোলেসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, মাদুরো কার্তেল দে লস সোলেসেরও নিয়ন্ত্রক। গত জুলাইয়ে এই সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বলেছে, এই গ্রুপ ত্রেন দে আরাগার সঙ্গে মিলে মাদকদ্রব্যকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। যদিও এরও কোনো প্রমাণ তারা হাজির করেনি।

ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকে অবশ্য মাদুরোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে নন। এই মাসের শুরুতে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দেওয়ার আগে মার্কিন দূত রিচার্ড গ্রেনেল বলে এসেছেন, যুদ্ধের বদলে তেল নিয়ে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়া উচিত। প্রসঙ্গত, ভেনেজুয়েলার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন কোম্পানি শেভরনের ভেনেজুয়েলায় তেলের উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স আছে। এ চুক্তি থেকে আর্থিক লাভ হয় ভেনেজুয়েলার। চুক্তিটিতে বড় অবদান আছে গ্রেনেলের। চুক্তিটি অনুমোদন করেছেন ট্রাম্পও।

তবে কট্টরপন্থী মাচাদোর সঙ্গে ট্রাম্পের মিত্র ব্রাজিলের ডানপন্থী নেতা জইর বলসোনারো এবং আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইয়ের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। মাচাদো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পকে দ্রুত বেসরকারীকরণ করবেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন।

২০২৩ সাল পর্যন্ত ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জিমি স্টোরি রয়টার্সকে বলেছেন, ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলের নেতাদের হাতে মাদুরোকে সরানোর পরিকল্পনায় ট্রাম্পের সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। ‘ওরা প্রতিবাদ করেছে, এ কারণে মারাও পড়েছে। আমরা তাদের (বিরোধীদের) আলোচনায় যেতে বলেছি, তারা আলোচনার টেবিলে গেছে। নির্বাচনে যেতে বলেছি, তারা নির্বাচনে গেছে। নির্বাচনে জিতেছেও। কিন্তু এরপরও সে (মাদুরো) চেয়ার ছাড়বে না। এরপর এটা (যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল) সমর্থন করা ছাড়া আর কী করার আছে তাদের সামনে?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, ভাইরাল সেই তরুণী গ্রেপ্তার

জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার বদলে অনৈক্যের প্রচেষ্টার জন্য কমিশনকে ধন্যবাদ: সালাহউদ্দিন

বিসিএসে রিপিট ক্যাডারে নিয়োগের পথ বন্ধ

প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন আসিফ নজরুল: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...