হিরোয়িকি আকিতা
লাতিন আমেরিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা আবারও তুঙ্গে উঠছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আগস্টের শুরুর দিকে অঞ্চলটির মাদক চক্র দমনে সামরিক বিকল্পগুলো খতিয়ে দেখতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা ওই অঞ্চলের আশপাশের জলসীমায় মোতায়েন করা হয়েছে।
তবে কেবল মাদকই এই উত্তেজনার ব্যাখ্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ঐতিহ্যের গভীরে থাকা এক প্রবল প্রবৃত্তিই মূলত ট্রাম্পকে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাড়িত করছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকাকে নিজেদের ‘পেছনের উঠান’ হিসেবে দেখে এসেছে। এটি এমন এক ভূখণ্ড, যেখানে কোনো সম্ভাব্য হুমকি বরদাশত করা যায় না। নিজ স্বার্থ রক্ষায় ধারাবাহিকভাবে মার্কিন প্রশাসনগুলো বারবার ওই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করেছে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র হাইতি দখল করে এবং ক্যারিবীয় এই দুর্বল রাষ্ট্রে অনুগত সরকার বসায়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় চিলি ও গুয়াতেমালায় যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী সরকার উৎখাতে অভ্যুত্থানকে সমর্থন দেয় ওয়াশিংটন। এমনকি কিউবা ও গ্রেনাডায় সৈন্য পাঠিয়েছিল দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র যখনই মনে করেছে, তাদের প্রভাব বলয়ে হুমকি তৈরি হয়েছে তখনই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ লাতিনে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ নয়, বরং চীনের প্রভাব বিস্তার। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বেইজিং দ্রুত লাতিন আমেরিকায় নিজ প্রভাব বাড়াচ্ছে। লাতিনের বৃহৎ অংশ যদি চীনা প্রভাবে ‘লাল’ হয়ে যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক ভিত টলোমলো হয়ে উঠবে।
বিশ্বের প্রবৃদ্ধির মূল ইঞ্জিন এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এই অঞ্চল এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার কেন্দ্রীয় মঞ্চে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে, লাতিন আমেরিকা এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকার দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ—পেরু ও চিলিতে চীনের বিপুল পরিমাণ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো—চানকাই বন্দর। পেরুর রাজধানী লিমার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনা কোম্পানির উদ্যোগে নির্মিত এবং গত জুনে এটি পূর্ণোদ্যমে কার্যক্রম শুরু করে। আলট্রা-লার্জ কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে সক্ষম এ বন্দর চালুর ফলে লাতিন আমেরিকা থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যকে আর উত্তর বা মধ্য আমেরিকা ঘুরে যেতে হচ্ছে না। সরাসরি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে এশিয়ায়।
চীনা বিনিয়োগের ফলে এই অঞ্চলে মাঠপর্যায়ে এমন পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। পণ্য খালাস সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংক্রিয়। ফলে বিশাল বন্দর প্রায় মানবশূন্য। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, সাংহাইয়ের বিশাল টার্মিনালে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই এখন পেরুতেও চালু হয়েছে। বর্তমানে বন্দরটিতে চারটি টার্মিনাল চালু রয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে মোট ১৫টি টার্মিনাল নির্মাণের। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চানকাই পরিণত হবে পুরো লাতিন আমেরিকার কেন্দ্রীয় বন্দরে।
চীনের প্রভাব পেরুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকায় চীন বর্তমানে ৩৭টি বন্দর প্রকল্পে যুক্ত। জ্বালানি খাতেও দেশটির দখল ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন অধিগ্রহণের মাধ্যমে চীনা কোম্পানিগুলো এখন চিলির জ্বালানি খাতের অর্ধেকের বেশি এবং পেরুর বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্কের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে।
বাণিজ্যিক হিসাবও বলছে পাল্টে যাওয়া শক্তির ভারসাম্যের গল্প। ২০০০—২০২৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার ১২টি দেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য প্রায় ৪০ গুণ বেড়েছে। চলতি শতকের শুরুতে এই ১২ দেশের মধ্যে ১১টির বড় বাণিজ্য অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র পাঁচে।
এ তথ্যের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে, লাতিন আমেরিকার ২০টি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে তিনটি বড় দলে ভাগ করা যায়। প্রথম দলটি—যুক্তরাষ্ট্রপন্থী পাঁচ দেশের। এর মধ্যে আছে আর্জেন্টিনা ও ইকুয়েডর। এ দেশগুলোর নেতারা ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ। আছে মেক্সিকো ও পানামাও—যারা ঐতিহ্যগতভাবেই ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্যে।
দ্বিতীয় দলটি স্পষ্টভাবেই বেইজিংপন্থী। চারটি দেশ এই শিবিরে পড়েছে। এর মধ্যে কিউবা বহু দশক ধরে মার্কিন প্রভাবের বিরোধিতা করছে। পাশাপাশি আছে ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়ার কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো।
বাকি দেশগুলো রয়েছে মাঝামাঝি এক অনিশ্চিত অবস্থানে। কেউ ঝুঁকছে ওয়াশিংটনের দিকে, কেউ বা বেইজিংয়ের দিকে, তবে কাউকেই পুরোপুরি একপক্ষের ঘরানায় ফেলা যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া ও পেরুর অবস্থান বেশ কৌশলগত। ঐতিহাসিকভাবে কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও বর্তমানে দেশটি পরিচালিত হচ্ছে এক বামপন্থী সরকারের হাতে, যারা ওয়াশিংটনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। অন্যদিকে পেরু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখলেও তাদের মোট রপ্তানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যায় চীনে।
ফলাফল হলো, মহাদেশটি এখন প্রায় সমান দুই ভাগে বিভক্ত—এক অংশ যুক্তরাষ্ট্রপন্থী, অন্য অংশ চীনপন্থী। আর মাঝখানে রয়েছে এক বিস্তৃত ক্ষেত্র, যেখানে দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে দুই পক্ষের সঙ্গেই খেলা করছে। দশকের পর দশক ধরে ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকার বড় বড় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে, একসঙ্গে কাজ করেছে সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধ মোকাবিলায়। তবে বেইজিং ভিন্ন পথে প্রভাব বিস্তার করছে—মূলত বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে হাতিয়ার বানিয়ে।
লাতিনে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার হচ্ছে। গত মে মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে ৬৬ বিলিয়ন ইউয়ান (৯৩০ কোটি ডলার) ঋণসুবিধা ঘোষণা করেছেন। এতে স্পষ্ট হয়েছে, লাতিন আমেরিকাকে বেইজিং তার বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে।
পেরুর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রান্সিসকো টুডেলা বলেন, ‘চীন তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু মার্কিন সরকার বেসরকারি মার্কিন কোম্পানিগুলোকে কোনো নির্দেশ দিতে পারে না। লাতিন আমেরিকাকে ঘিরে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় এটি চীনের জন্য অন্যায্য কৌশলগত সুবিধা।’
চীনের বাড়তে থাকা প্রভাব ঠেকাতে ওয়াশিংটন এখন পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন প্রকাশ্যে পানামা খালে চীনা ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার সমালোচনা করেছে। পাশাপাশি আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, মার্কিন প্রশাসন গোপনে বিভিন্ন সরকারকে মহাকাশ প্রযুক্তি ও তথ্য অবকাঠামোর মতো সংবেদনশীল খাতে চীনা বিনিয়োগ ঠেকাতে চাপ দিচ্ছে।
এখন মূল প্রশ্ন হলো, লাতিন আমেরিকা মধ্যম মেয়াদে ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকবে, নাকি বেইজিংয়ের দিকে? বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আগামী কয়েক বছর—এমনকি পরবর্তী দশকেও—অর্থনৈতিক শক্তির জোরে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তার অব্যাহত থাকবে। তবে একসময় এই গতি কমে আসবে।
চিলির পন্টিফিকাল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক জর্জ সাহদ বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে চীন কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে লাতিন আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করবে। তবে জনসংখ্যা হ্রাস ও বার্ধক্যের কারণে চীনের অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদে গতি হারাবে। এর প্রভাব লাতিন আমেরিকায় তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবকেও দুর্বল করে দেবে।’
কেবল তা-ই নয়, বেইজিংয়ের রাজনৈতিক মডেলও একধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। চিলির ফিনিস টেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক আলবার্তো রোহাস বলেন, ‘লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে চীনের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও, খুব অল্প কিছু দেশই রাজনৈতিকভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ হতে রাজি। চীন একটি একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন চলে—এ তথ্য অঞ্চলজুড়েই সুপরিচিত। আর এ কারণে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রটি সীমিত হয়ে যায়।’
এ অবস্থায় ভবিষ্যতের গতিপথটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিউবা ও নিকারাগুয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কট্টরপন্থী সরকারগুলো ছাড়া লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ পুরোপুরি চীনমুখী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং তারা ‘রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে আলাদা করার’ পথ বেছে নিচ্ছে বলে মনে হয়। এতে বেইজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত হবে, কিন্তু কূটনৈতিক অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ককে।
তবে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা হয়তো আসছে বেইজিং থেকে নয়, বরং ওয়াশিংটন থেকেই। যদি যুক্তরাষ্ট্র তার দক্ষিণের প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ না নেয়, বরং তার বদলে জোরজবরদস্তিমূলক কূটনীতিতে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের পেছনের আঙিনা মনে করা অঞ্চলটিকে দূরে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
নিক্কেই এশিয়া থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
লেখক: নিক্কেই এশিয়ার সাংবাদিক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ভূরাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করা এই বিশ্লেষক বছরখানেক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউএস-জাপান প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েটস হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
লাতিন আমেরিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা আবারও তুঙ্গে উঠছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আগস্টের শুরুর দিকে অঞ্চলটির মাদক চক্র দমনে সামরিক বিকল্পগুলো খতিয়ে দেখতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা ওই অঞ্চলের আশপাশের জলসীমায় মোতায়েন করা হয়েছে।
তবে কেবল মাদকই এই উত্তেজনার ব্যাখ্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ঐতিহ্যের গভীরে থাকা এক প্রবল প্রবৃত্তিই মূলত ট্রাম্পকে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাড়িত করছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকাকে নিজেদের ‘পেছনের উঠান’ হিসেবে দেখে এসেছে। এটি এমন এক ভূখণ্ড, যেখানে কোনো সম্ভাব্য হুমকি বরদাশত করা যায় না। নিজ স্বার্থ রক্ষায় ধারাবাহিকভাবে মার্কিন প্রশাসনগুলো বারবার ওই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করেছে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র হাইতি দখল করে এবং ক্যারিবীয় এই দুর্বল রাষ্ট্রে অনুগত সরকার বসায়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় চিলি ও গুয়াতেমালায় যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী সরকার উৎখাতে অভ্যুত্থানকে সমর্থন দেয় ওয়াশিংটন। এমনকি কিউবা ও গ্রেনাডায় সৈন্য পাঠিয়েছিল দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র যখনই মনে করেছে, তাদের প্রভাব বলয়ে হুমকি তৈরি হয়েছে তখনই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ লাতিনে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ নয়, বরং চীনের প্রভাব বিস্তার। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বেইজিং দ্রুত লাতিন আমেরিকায় নিজ প্রভাব বাড়াচ্ছে। লাতিনের বৃহৎ অংশ যদি চীনা প্রভাবে ‘লাল’ হয়ে যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক ভিত টলোমলো হয়ে উঠবে।
বিশ্বের প্রবৃদ্ধির মূল ইঞ্জিন এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এই অঞ্চল এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার কেন্দ্রীয় মঞ্চে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে, লাতিন আমেরিকা এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকার দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ—পেরু ও চিলিতে চীনের বিপুল পরিমাণ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো—চানকাই বন্দর। পেরুর রাজধানী লিমার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনা কোম্পানির উদ্যোগে নির্মিত এবং গত জুনে এটি পূর্ণোদ্যমে কার্যক্রম শুরু করে। আলট্রা-লার্জ কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে সক্ষম এ বন্দর চালুর ফলে লাতিন আমেরিকা থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যকে আর উত্তর বা মধ্য আমেরিকা ঘুরে যেতে হচ্ছে না। সরাসরি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে এশিয়ায়।
চীনা বিনিয়োগের ফলে এই অঞ্চলে মাঠপর্যায়ে এমন পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। পণ্য খালাস সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংক্রিয়। ফলে বিশাল বন্দর প্রায় মানবশূন্য। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, সাংহাইয়ের বিশাল টার্মিনালে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই এখন পেরুতেও চালু হয়েছে। বর্তমানে বন্দরটিতে চারটি টার্মিনাল চালু রয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে মোট ১৫টি টার্মিনাল নির্মাণের। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চানকাই পরিণত হবে পুরো লাতিন আমেরিকার কেন্দ্রীয় বন্দরে।
চীনের প্রভাব পেরুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকায় চীন বর্তমানে ৩৭টি বন্দর প্রকল্পে যুক্ত। জ্বালানি খাতেও দেশটির দখল ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন অধিগ্রহণের মাধ্যমে চীনা কোম্পানিগুলো এখন চিলির জ্বালানি খাতের অর্ধেকের বেশি এবং পেরুর বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্কের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে।
বাণিজ্যিক হিসাবও বলছে পাল্টে যাওয়া শক্তির ভারসাম্যের গল্প। ২০০০—২০২৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার ১২টি দেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য প্রায় ৪০ গুণ বেড়েছে। চলতি শতকের শুরুতে এই ১২ দেশের মধ্যে ১১টির বড় বাণিজ্য অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র পাঁচে।
এ তথ্যের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে, লাতিন আমেরিকার ২০টি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে তিনটি বড় দলে ভাগ করা যায়। প্রথম দলটি—যুক্তরাষ্ট্রপন্থী পাঁচ দেশের। এর মধ্যে আছে আর্জেন্টিনা ও ইকুয়েডর। এ দেশগুলোর নেতারা ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ। আছে মেক্সিকো ও পানামাও—যারা ঐতিহ্যগতভাবেই ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্যে।
দ্বিতীয় দলটি স্পষ্টভাবেই বেইজিংপন্থী। চারটি দেশ এই শিবিরে পড়েছে। এর মধ্যে কিউবা বহু দশক ধরে মার্কিন প্রভাবের বিরোধিতা করছে। পাশাপাশি আছে ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়ার কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো।
বাকি দেশগুলো রয়েছে মাঝামাঝি এক অনিশ্চিত অবস্থানে। কেউ ঝুঁকছে ওয়াশিংটনের দিকে, কেউ বা বেইজিংয়ের দিকে, তবে কাউকেই পুরোপুরি একপক্ষের ঘরানায় ফেলা যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া ও পেরুর অবস্থান বেশ কৌশলগত। ঐতিহাসিকভাবে কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও বর্তমানে দেশটি পরিচালিত হচ্ছে এক বামপন্থী সরকারের হাতে, যারা ওয়াশিংটনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। অন্যদিকে পেরু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখলেও তাদের মোট রপ্তানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যায় চীনে।
ফলাফল হলো, মহাদেশটি এখন প্রায় সমান দুই ভাগে বিভক্ত—এক অংশ যুক্তরাষ্ট্রপন্থী, অন্য অংশ চীনপন্থী। আর মাঝখানে রয়েছে এক বিস্তৃত ক্ষেত্র, যেখানে দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে দুই পক্ষের সঙ্গেই খেলা করছে। দশকের পর দশক ধরে ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকার বড় বড় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে, একসঙ্গে কাজ করেছে সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধ মোকাবিলায়। তবে বেইজিং ভিন্ন পথে প্রভাব বিস্তার করছে—মূলত বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে হাতিয়ার বানিয়ে।
লাতিনে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার হচ্ছে। গত মে মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে ৬৬ বিলিয়ন ইউয়ান (৯৩০ কোটি ডলার) ঋণসুবিধা ঘোষণা করেছেন। এতে স্পষ্ট হয়েছে, লাতিন আমেরিকাকে বেইজিং তার বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে।
পেরুর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রান্সিসকো টুডেলা বলেন, ‘চীন তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু মার্কিন সরকার বেসরকারি মার্কিন কোম্পানিগুলোকে কোনো নির্দেশ দিতে পারে না। লাতিন আমেরিকাকে ঘিরে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় এটি চীনের জন্য অন্যায্য কৌশলগত সুবিধা।’
চীনের বাড়তে থাকা প্রভাব ঠেকাতে ওয়াশিংটন এখন পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন প্রকাশ্যে পানামা খালে চীনা ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার সমালোচনা করেছে। পাশাপাশি আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, মার্কিন প্রশাসন গোপনে বিভিন্ন সরকারকে মহাকাশ প্রযুক্তি ও তথ্য অবকাঠামোর মতো সংবেদনশীল খাতে চীনা বিনিয়োগ ঠেকাতে চাপ দিচ্ছে।
এখন মূল প্রশ্ন হলো, লাতিন আমেরিকা মধ্যম মেয়াদে ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকবে, নাকি বেইজিংয়ের দিকে? বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আগামী কয়েক বছর—এমনকি পরবর্তী দশকেও—অর্থনৈতিক শক্তির জোরে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তার অব্যাহত থাকবে। তবে একসময় এই গতি কমে আসবে।
চিলির পন্টিফিকাল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক জর্জ সাহদ বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে চীন কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে লাতিন আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করবে। তবে জনসংখ্যা হ্রাস ও বার্ধক্যের কারণে চীনের অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদে গতি হারাবে। এর প্রভাব লাতিন আমেরিকায় তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবকেও দুর্বল করে দেবে।’
কেবল তা-ই নয়, বেইজিংয়ের রাজনৈতিক মডেলও একধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। চিলির ফিনিস টেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক আলবার্তো রোহাস বলেন, ‘লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে চীনের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও, খুব অল্প কিছু দেশই রাজনৈতিকভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ হতে রাজি। চীন একটি একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন চলে—এ তথ্য অঞ্চলজুড়েই সুপরিচিত। আর এ কারণে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রটি সীমিত হয়ে যায়।’
এ অবস্থায় ভবিষ্যতের গতিপথটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিউবা ও নিকারাগুয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কট্টরপন্থী সরকারগুলো ছাড়া লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ পুরোপুরি চীনমুখী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং তারা ‘রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে আলাদা করার’ পথ বেছে নিচ্ছে বলে মনে হয়। এতে বেইজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত হবে, কিন্তু কূটনৈতিক অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ককে।
তবে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা হয়তো আসছে বেইজিং থেকে নয়, বরং ওয়াশিংটন থেকেই। যদি যুক্তরাষ্ট্র তার দক্ষিণের প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ না নেয়, বরং তার বদলে জোরজবরদস্তিমূলক কূটনীতিতে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের পেছনের আঙিনা মনে করা অঞ্চলটিকে দূরে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
নিক্কেই এশিয়া থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
লেখক: নিক্কেই এশিয়ার সাংবাদিক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ভূরাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করা এই বিশ্লেষক বছরখানেক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউএস-জাপান প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েটস হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
ভেনেজুয়েলার আশপাশে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেশটিতে কোনো ধরনের স্থল অভিযানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। বিশ্লেষক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তারাও বলছেন, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন আক্রমণের কোনো সম্ভাবনা নেই।
২ দিন আগেভারতের প্রেস ট্রাস্টের বরাতে জানা গেছে, ট্রাম্প শুক্রবার ওভাল অফিসে বলেন, ‘আমি মোদির সঙ্গে সব সময় বন্ধু থাকব...তিনি একজন মহান প্রধানমন্ত্রী। তিনি অসাধারণ। তবে এই মুহূর্তে তিনি যা করছেন তা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে। চিন্তার কিছু নেই। আমাদের মাঝে মাঝে
৩ দিন আগেচীনের স্বাধীনতা দিবসের সামরিক কুচকাওয়াজকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে। এই কুচকাওয়াজে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের অংশগ্রহণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
৮ দিন আগেএরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তিন নেতার হাসিমুখে গল্প করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করছেন। যদিও এসব মন্তব্যে তেমন কিছু আসে যায় না, কিন্তু এই তিন দেশের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের এতে অনেক কিছুই আসে যায়। এই দেশগুলো হয়তো কিছু বলছে না, কিন্তু মোদি-সি-পুতিনের...
৮ দিন আগে