Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের ইতিহাস: পরিণতিতে পাঁচবার অর্থনৈতিক মন্দা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজকের দিনে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এত স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, যা আগে খুব কমই দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জবাবে বেইজিং মার্কিন পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে গেছে।

এর ফলাফল ও প্রভাব এখনো সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। সামনে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা আসতে পারে। এমনকি চীন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড কেনা বন্ধও করে দিতে পারে। অন্যান্য দেশ নতুন মার্কিন শুল্ক থেকে ৯০ দিনের জন্য ছাড় পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই শুল্ক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। তবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীরা তাঁদের ক্রয় ও বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতে দ্বিধায় ভুগছেন। ওয়াশিংটনের বারবার নীতি পরিবর্তন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা ঘুরছে খুব ধীরে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল আমদানি করা সব পণ্যের ওপর নতুন ও কঠোর শুল্ক আরোপের ঘোষণা করার পরই বোঝা গেল, পরিস্থিতি কত দ্রুত খারাপ হতে পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই আর্থিক বাজার থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গেছে।

বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলারে আস্থা হারিয়েছেন ও মার্কিন বন্ড বিক্রি করে অর্থ সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। এতে আর্থিক বিপর্যয়ের সংকেত দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প কিংবা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং কেউই ছাড় দিতে রাজি নন। আর তাই এই সংঘাত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নেওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বাণিজ্য যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির বেশ কিছু নজির রয়েছে। উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ছয়টি অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা বলতে ছয় বা তার বেশি ত্রৈমাসিক পর্যন্ত টানা অর্থনৈতিক সংকোচন বোঝানো হয়। যদিও এর কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই।

এই ছয়টি মন্দার মধ্যে পাঁচটি সরাসরি শুল্ক এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে হয়েছিল, অথবা এগুলোর কারণে মন্দা পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপের দিকে গিয়েছিল। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ধ্বংসাত্মক হবে—যদি না কেউ তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং এটি ঠেকিয়ে দেয়।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি হলো ‘কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজেস’ বা ‘তুলনামূলক সুবিধা’। এর মাধ্যমে কোনো দেশ গম উৎপাদন, কাপড় তৈরি বা সফটওয়্যার কোডিংয়ের মতো বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন করে লাভবান হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে এসব পণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে প্রতিটি দেশ তাদের সীমিত সম্পদকে সেসব জিনিস উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারে যা তাদের কৃষক, খনি শ্রমিক ও কারিগর সবচেয়ে কম খরচে তৈরি করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে সবাই উপকৃত হয়।

এই তত্ত্বটি বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। ১৮৪৬ সালে যখন মহাদেশব্যাপী ‘আলুর দুর্ভিক্ষ’ যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে খাদ্যপণ্যের অবাধ বাণিজ্য চালু করতে বাধ্য করে, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাপক সমৃদ্ধি আসে। এ সময় অবশ্য কিছু গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউরোপের ভূস্বামীরা অভিযোগ করেন যে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে।

তাদের অভিযোগের ভিত্তি ছিল—রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের উর্বর সমভূমি এত সস্তায় গম উৎপাদন করত যে ইউরোপে কৃষিজমির দামই কমে যায়। ফলে ব্রিটেন ও ইউরোপের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ শহরের দিকে যাত্রা করে, যা নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ঢেউ সৃষ্টি করে।

অবশ্যই, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় এবং শক্তিশালী অর্থনীতি অভিন্ন বাজার মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে পারে। তারা মুদ্রা বিনিময় হার নিজেদের রপ্তানির পক্ষে নিতে পারে। আবার বিশেষ কোনো বাণিজ্যকে সুবিধা দিতে ভর্তুকি দিতে পারে। যেমন—গম বাদ দিয়ে ভুট্টা, টেক্সটাইলের চেয়ে কম্পিউটার চিপস অথবা চালের চেয়ে টেক্সটাইলকে তারা সুবিধা দিতে পারে।

পরিবেশ ও শ্রম আইনও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, যা অনেক সময় অপ্রত্যাশিত হয়। বড় দেশের মনোপলিস্ট বা একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বিভিন্ন নিয়মকানুন ও শুল্কের পক্ষে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা প্রতিযোগিতা এড়িয়ে নিজেদের মূল্যবান সম্পদ আরও বাড়াতে পারেন।

একসময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বহু শতাব্দী ধরে ব্রিটেন তার উপনিবেশগুলোর বাণিজ্যকে নিজ দেশের প্রয়োজনে গড়ে তুলেছিল। নিউইয়র্ক, মেরিল্যান্ড ও সাউথ ক্যারোলিনার উপনিবেশগুলো থেকে আশা করা হতো যে, তারা ভার্জিনিয়া এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে দাস-শ্রমিক নির্ভর তামাক ও চিনির খামারগুলোর জন্য আটা ও চাল সরবরাহ করবে।

ব্রিটেন উপনিবেশগুলোকে নিজেদের বস্ত্র, লোহা ও কাগজ তৈরি করতে বাধা দিয়েছে। উপনিবেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ শেষ পর্যন্ত আমেরিকান বিপ্লবের দিকে ধাবিত করে। শুরু থেকেই, ব্রিটিশ কনফেডারেশন আর্টিকেলস এবং পরে দেশটির সংবিধান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্রুত বা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এমন নির্বাহী পদক্ষেপ সীমিত করার চেষ্টা করেছিল। রাজস্ব বিলগুলো হাউসে উত্থাপন করা হতো, সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ভেটোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

আমেরিকার প্রথম অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয় ১৮১৬ সালে। এর কারণ ছিল ব্রিটেন। ব্রিটেন তখন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে জিতেছিল। জয়ের পর ব্রিটেন বিপুল পরিমাণে উলের পোশাক বাজারে ছাড়ে। এই কাপড়গুলো মূলত ইউরোপের সৈন্য ও নাবিকদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

এটি ছিল ব্রিটেনের প্রথম সেনা ও নৌবাহিনীর উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির ঘটনা। আমেরিকার ব্যবসায়ী ও পশম উৎপাদনকারীরা এত সস্তা পশমের কাপড় দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধ করতে কংগ্রেসের কাছে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে, ১৮১৭ সালের মার্চে কংগ্রেস একটি আইন পাস করে। আইনের নাম ছিল ‘নেভিগেশন অ্যাক্ট’। এই আইন ব্রিটিশ জাহাজ এবং সস্তা পণ্য আসা বন্ধ করে দেয়।

জবাবে, মে মাসে ব্রিটেনও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। তারাও একটি আদেশ জারি করে। এই আদেশের ফলে মার্কিন জাহাজগুলো ব্রিটেনের ক্যারিবিয়ান উপনিবেশে শস্য সরবরাহ করতে পারত না। ফলে, মার্কিন কৃষকেরা গুরুত্বপূর্ণ বাজার হারান। এই বাজারে তারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন। ১৮১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গমের দাম ৫০ শতাংশ কমে যায়। কৃষকেরা জমির বন্ধকি ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। এই ঋণ তারা ইউএস ল্যান্ড অফিস থেকে নিয়েছিলেন। কৃষকেরা মুদি দোকানগুলোতে দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। ফলে গ্রামের দোকানগুলোও সরবরাহকারী বণিকদের পাওনা মেটাতে পারেনি।

১৮১৯ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে রীতিমতো আতঙ্ক শুরু হয় এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাজারকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কিনরা কানাডায় গম চোরাচালান করে নিজেদের রক্ষা করে। সেখানে টরন্টো ও মন্ট্রিয়লের মিল মালিকেরা সেই গম দিয়ে ব্রিটিশদের জন্য আটা তৈরি করত। সেই আটা আবার ক্যারিবীয় এলাকায় বিক্রি করা হতো।

ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া ও সাউথ ক্যারোলাইনার মতো অঙ্গরাজ্যগুলো কেবল গম ও ধান উৎপাদন ছেড়ে দাসভিত্তিক তুলা উৎপাদনে যাওয়ার মাধ্যমে উন্নতি লাভ করে। এক দশকের মধ্যে ইঙ্গ-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ ক্যারিবীয় দ্বীপের কৃষি খামারগুলোতে খাদ্য সরবরাহের খরচ এত বাড়িয়ে দেয় যে, সেখানকার দাস মালিকেরা ক্রীতদাসদের ক্ষতিপূরণসহ দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিপরীতে, ১৮১৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা পাস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে তুলা উৎপাদন আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর সঙ্গে দাসপ্রথারও বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে এর পরের মন্দা শুরু হয় মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের দ্রুত নির্বাহী পদক্ষেপের কারণে। ১৮১৯ সালের মহামন্দার পর থেকে দীর্ঘ সময়ের ক্রেডিট চেইন বা ঋণ শৃঙ্খল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে তুলার আবাদ সম্প্রসারণে অর্থায়ন করে আসছিল।

সেকেন্ড ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস এবং ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত সাতটি ব্রিটিশ ব্যাংক ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ধার করত। এরপর তারা ‘বিল অব এক্সচেঞ্জ’ ইস্যু করত। এর মাধ্যমে ছোট, আঞ্চলিক মার্কিন ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়া হতো। এই ব্যাংকগুলো আবার দক্ষিণাঞ্চলের ওপরের অংশের দাস ব্যবসায়ীদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিত। দাস ব্যবসায়ীরা ভার্জিনিয়া ও সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে দাস কিনত এবং জর্জিয়া, মিসিসিপি ও লুইজিয়ানার তুলার খামারে বিক্রি করত। সুদের হার ব্যাংক অব ইংল্যান্ড নির্ধারণ করত। ফলে লন্ডনে সুদের হার সামান্য বৃদ্ধি পেলে নিউ অরলিন্সে দাস মালিকদের জমি বা দাস কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ত।

প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বিশ্বাস করতেন, সেকেন্ড ব্যাংক এবং সেভেন সিস্টারস তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি ১৮৩৪ ও ১৮৩৬ সালে বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই আদেশগুলোর লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ঋণের ওপর থেকে দাস মালিকদের নির্ভরতা কমানো।

এক আদেশে জ্যাকসন যুক্তরাষ্ট্রের সেকেন্ড ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেন। সেই অর্থ তাঁর রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি পছন্দের ব্যাংকে জমা দেন। অন্য এক আদেশে কৃষকদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের বন্ধকি অর্থ ইউএস ল্যান্ড অফিসে পরিশোধ করতে নিষেধ করা হয়। এর ফলে কৃষকদের বাধ্য হয়ে স্বর্ণ ব্যবহার করতে হয়, যা সেই সময়ের মুদ্রা ছিল। এই পদক্ষেপের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের দাস মালিকেরা লাভবান হয়। এসব মালিকদের উত্তর জর্জিয়া ও উত্তর ক্যারোলাইনায় সোনার খনি ছিল। তবে, হঠাৎ করে সোনার চাহিদা বেড়ে গেলেও সরবরাহ অনেক কম ছিল।

এই অবস্থায় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড দেখতে পায়, তাদের সোনা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তারা ব্যাংক রেট তথা সুদহার বাড়াল। একই সঙ্গে তারা কিছু সময়ের জন্য ‘সেভেন সিস্টার্সকে’ আন্তর্জাতিক লেনদেন থেকে বিচ্ছিন্ন করল। এর ফলস্বরূপ ১৮৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফের মহামন্দা শুরু হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে জমিদারেরা ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়ে গেল। তারা চাষের জমি ফেলে ক্রীতদাসদের নিয়ে (তৎকালীন) টেক্সাসের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে চলে গেল। সেখানে তারা ঋণদাতাদের হাত থেকে বেঁচে যায়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। উৎপাদনকারীরা দেউলিয়া হয়ে গেল। পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি মার্কিন অঙ্গরাজ্য আন্তর্জাতিকভাবে ইস্যু করা বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলো।

এর পরের মহামন্দা শুরু হয় ১৮৭৩ সালে। এই অর্থনৈতিক মন্দা আন্তর্জাতিক পণ্যের দামের আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে হয়েছিল। তবে এর জন্য তড়িঘড়ি করে শুল্ক আরোপ করা হয়নি। কিন্তু ১৮৯৩ সালের মন্দার ক্ষেত্রে তেমনটা বলা যাবে না। ১৮৯০ সালে মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস আইন প্রণয়নের নিয়ম সংশোধন করে। এর ফলে কংগ্রেস অপ্রত্যাশিতভাবে কার্যকর ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সুযোগে রিপাবলিকানরা ১৮৯০ সালের ম্যাককিনলে ট্যারিফ অ্যাক্ট পাস করে।

এই আইনে বিদেশে তৈরি পণ্যের আমদানির ওপর শুল্ক ৩৮ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে। একই সঙ্গে আধা-পরিশোধিত চিনির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়। চিনি রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য এটি বিশাল পার্থক্য তৈরি করে দেয়। কারণ সে সময় আপেল, স্যামন ও গরুর মাংসের মতো খাদ্য সংরক্ষণে চিনি ব্যবহার করা হতো।

তবে, বেশি শুল্ক আরোপের ফলে প্রায়শই যা হয়—তেমনিভাবে মার্কিন রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। দুই বছরের মধ্যে এটি প্রায় মার্কিন ট্রেজারির সোনা শেষ করে ফেলে। এর ফলে বিদেশি ঋণদাতারা মার্কিন বন্ড বিক্রি করতে শুরু করে, বিশেষ করে রেল কোম্পানিগুলোর বন্ড। ঋণগ্রহীতারা আশঙ্কা করেছিল যে, ট্রেজারিতে সোনা না থাকলে ওয়াশিংটন মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণমান ত্যাগ করবে। তখন বন্ডের অর্থ হয়তো দুর্বল মার্কিন মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে।

এরপর, ১৯৩০–এর দশকের মহামন্দায় স্মুট-হাওলি শুল্ক আইন বড় ভূমিকা রেখেছিল। যদিও কিছু অর্থনীতি ঐতিহাসিক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা সরবরাহ, শেয়ারবাজারে তেজ–মন্দা চক্র এবং ইউরোপের অমীমাংসিত যুদ্ধকালীন ঋণ—এর প্রধান কারণ ছিল। উনিশ শতকের একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে শুধু বলব, শুল্কে দ্রুত পরিবর্তন বিশ্বকে বদলে দেয়। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এমন পরিবর্তন আনে, যার প্রভাব মোকাবিলা করতে বহু বছর লেগে যায় এবং এর ফলস্বরূপ অপ্রত্যাশিত ঘটনার একটি দীর্ঘ ধারা তৈরি হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত দুই শতাব্দীর মহামন্দা–মন্দার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে পারি। বর্তমানে ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক অনেক কোম্পানিকে তাদের পূর্বনির্ধারিত চুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে। উনিশ শতকে কৃষক, গ্রামের দোকানদার, বণিক এবং দাস ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গিয়েছিল।

পিটসবার্গভিত্তিক উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী কোম্পানি হাউমেট এরই মধ্যেই ‘ফোর্স ম্যাজিউর’ বা নিজেদের এমন অবস্থানে ঘোষণা করেছে যেখানে কেউ তাদের জোর করে চুক্তি পরিপালনে বাধ্য করতে পারবে না। তারা শুল্কের কারণে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে।

চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা করা বিভিন্ন খাতের আরও অনেক কোম্পানি সম্ভবত এখন চুক্তি বাতিল করবে, কারণ শুল্ক কার্যকর হতে শুরু করেছে। এসব কোম্পানির বাতিল করা অনেক লেনদেনই ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়। এই ঋণের বেশির ভাগই ব্যাংক, হেজ ফান্ড, বিমা কোম্পানি এবং অন্যান্য আর্থিক মধ্যস্থতাকারীদের কাছে থাকে। এর কিছু ঋণ আবার অসংখ্য বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করা হয়। শেয়ারবাজার ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে খুব দ্রুত সক্ষম। তবে এর চেয়ে অনেক বড় এবং জটিল ঋণবাজার, এটি দ্রুত ধাক্কা সামলাতে পারে না। যারা ২০০৮ সালের সংকটের কথা মনে রেখেছেন, তারা এটা জানেন। ২০০৮ সালে ফেডারেল রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত বন্ড কিনেছিল। এর মাধ্যমে তারা জমে যাওয়া বাজারে তারল্য ফিরিয়ে এনেছিল।

যদিও আমি কেবলই একজন ইতিহাসবিদ, তবে আমার বিশ্বাস ফেডারেল রিজার্ভ (মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক) এ পর্যন্ত যে বিশৃঙ্খলা দেখেছে তা সামাল দিতে পারবে। তবে চীন–মার্কিন বাণিজ্য স্থগিতের সম্পূর্ণ প্রভাব আমাদের এখনো মোকাবিলা করতে হবে। এ ছাড়া, বিশ্বের বাকি অংশের ওপর ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের পরে কী হবে তা এখনো অস্পষ্ট।

যদি কংগ্রেস শুল্কের ওপর তার সাংবিধানিক অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে না পারে এবং যদি মার্কিন বাণিজ্যনীতি নির্ধারণের ক্ষমতা একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়—যেমনটা ১৮৩০–এর দশকে অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ক্ষেত্রে ছিল—তাহলে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মন্দার ফলে সৃষ্ট তারল্য সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না, যে মন্দার আশঙ্কা আমি করছি।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক স্কট রেনল্ডস নেলসন

অনুবাদ করেছেন: আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তাইওয়ানের আকাশে যুদ্ধের ছায়া, চীনকে কি হারাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র

আবদুল বাছেদ, ঢাকা
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ৫৯
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ। এই অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌবহর ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি অবস্থায় থাকে। গত মাসে একবার দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ মাত্র ১৫০ মিটারের দূরত্বে চলে এসেছিল।

গত ২ আগস্ট তাইওয়ানে ‘জিরো ডে অ্যাটাক’ নামে একটি ডিস্টোপিয়ান টেভি সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করতে পারে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ষড়যন্ত্র, গণমাধ্যমে অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানো—সবকিছুই এতে বিশ্লেষণধর্মীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি কল্পকাহিনি হলেও সাম্প্রতিক বাস্তব ঘটনাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে।

১০ সিজনের বহুল প্রচারিত ও প্রশংসিত এই সিরিজের নির্মাতা চেং হসিন-মেই। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন টাইমকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় গেলে আপনি সত্যিই সেই উত্তেজনা টের পাবেন। চীন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েলিংটন কু মনে করছেন, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) যেকোনো সামরিক মহড়াকে সত্যিকারের আগ্রাসনে পরিণত করতে পারে। এমন সম্ভাবনা এখন উড়িয়ে দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই হুমকি আর চ্যালেঞ্জই এখন তাইওয়ানের সামনে।

চীন বলছে, এটি চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়, আর তাইওয়ান সরকারের ভাষায়, আসন্ন আগ্রাসনের সংকেত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যেই চীন তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বৈদেশিক মনোযোগের বিভ্রান্তি দেখা দিলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হয়তো তার আগেই পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে একা ছাড়বে না।

এখন ভাবুন, চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপ দেশটির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পেন্টাগনের প্রচলিত যুদ্ধনীতি মেনে মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী হাজার হাজার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে চীনের জাহাজ, কমান্ড সেন্টার ও লজিস্টিক ঘাঁটির দিকে। প্রথম দফার হামলাতেই ৩৩ হাজারেরও বেশি নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র সাড়ে ৮ হাজারের বেশি টার্গেটে আঘাত হেনেছে। সাইবার হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চীনের সামরিক নেটওয়ার্ক, ভেঙে পড়ছে নেতৃত্ব। ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বেইজিং হয় পিছু হটবে, নয়তো নিরুপায় পরাজয় মেনে নেবে।

কিন্তু যদি মনে করেন, এমনটি হবেই হবে, তাহলে ভুল করছেন। কারণ চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসের পর যখন একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়বে বেইজিং, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ। তখন দেশটি ভিন্নপথে হাঁটতে পারে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভার্টিক্যাল এস্কেলেশন বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। চীন হয়তো মার্কিন সমুদ্রসীমায় একটি পারমাণবিক পরীক্ষামূলক হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে যে এখানেই থেমে যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়াশিংটন কি এমন পদক্ষেপকে পারমাণবিক হামলার পূর্বঘোষণা বলে ধরে নেবে না?

এই বিপজ্জনক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে শুধু চীনের পারমাণবিক নীতির কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব যুদ্ধধারণার ফলেও। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার চীনের নেই। তাই বেইজিং হয়তো এখনো মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র আগে পারমাণবিক হামলা চালালে তারা পাল্টা আঘাত করার মতো সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ সক্রিয় পারমাণবিক বোমা ছিল, চীনের সেখানে ছিল মাত্র ৬০০। এই পশ্চাৎপদতার কারণে চীনা নেতারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন বড় পরাজয় ঠেকাতে।

আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, চীনের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দ্বৈত-ক্ষমতাসম্পন্ন; অর্থাৎ একই লঞ্চার থেকে কখনো প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র, আবার কখনো পারমাণবিক ওয়ারহেড নিক্ষেপ করা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব লঞ্চারে হামলা চালায়, বেইজিং সেটাকে তাদের পারমাণবিক প্রতিরোধশক্তির ওপর আঘাত হিসেবে দেখতে পারে। এটি পাল্টা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে।

বিশেষ করে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো এই জটিলতা বাড়ায়। একই ঘাঁটিতে প্রচলিত ও পারমাণবিক উভয় ধরনের ওয়ারহেড থাকে এবং প্রশিক্ষণে সৈন্যরা প্রথমে প্রচলিত হামলার মহড়া দেয়, পরে সেটি পারমাণবিক ওয়ারহেডে পরিবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘাঁটিতে আঘাত হানলে চীন সেটিকে পারমাণবিক হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে পারে। একেই বলে এনট্যাঙ্গলমেন্ট প্রবলেম বা এক হামলার দ্বৈত ব্যাখ্যা, যা পারমাণবিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।

এখানে মার্কিন সামরিক পরিকল্পকেরা পড়ে যান এক দোটানায়। তাঁরা যত দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের চিন্তায় যুদ্ধের কৌশল সাজাবেন, তত বেশি পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে যান। অথচ বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানোর মতো সরঞ্জাম মজুত নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিকল্পনায় যে ধরনের যুদ্ধনীতি প্রাধান্য পায়, সেখানে চীনের কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন, কম্পিউটার, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইলেন্স ও রিকনাইসেন্স (সি৪ আইএসআর) ব্যবস্থা লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার আক্রমণ চালানোর কথা বলা হয়। বাস্তবে তা হয়তো যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করার বদলে আরও দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক করে তুলতে পারে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সামরিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী উপগ্রহ এবং সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী কমান্ড সদর দপ্তর পর্যন্ত সবকিছু।

যদি কমান্ডাররা নিহত হন এবং কমান্ড ব্যবস্থা ধ্বংসও হয়ে যায়, তবুও যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদদের মনে করা উচিত নয় যে এতে দ্রুত বিজয় আসবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, কোনো বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই বিপুলসংখ্যক রুশ জেনারেল নিহত হন, তবুও তাদের বাহিনী আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, নেতৃত্ব ধ্বংস করলেও তাঁরা কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে টিকে থেকেছে, যতক্ষণ না তাদের বাহিনীকে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সামরিক অভিযানে পুরোপুরি দমন করা হয়েছে।

মার্কিন যুদ্ধনীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, আর ভূমি থেকে দূরপাল্লার হামলার অস্ত্র মজুত ফুরোবে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। এমনকি যদি তাইওয়ান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে চীনকে ঠেকাতেও পারে, তবু মূল্যটা ভয়াবহ হবে। ডজন-ডজন জাহাজ ডুবে যাবে, শত শত বিমান ধ্বংস হবে, আর হাজার হাজার সেনা নিহত হবে।

পেন্টাগন সম্প্রতি দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতাদের দূরপাল্লার অস্ত্রের উৎপাদন দ্বিগুণ বা এমনকি চারগুণ বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু এতে সমস্যা আরও বাড়ছে, কারণ এই ‘দূরপাল্লার আক্রমণনির্ভর’ যুদ্ধের ধারণাই আসলে পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে, কমাচ্ছে না।

এ বিপদের ব্যাপ্তি শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ নয়। ন্যাটোর অনেক পরিকল্পনাও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তারাও বুঝতে পারছেন না যে এসব ‘অপারেশনাল কনসেপ্ট’-এর মধ্যে কতটা বিপজ্জনক উত্তেজনা লুকিয়ে আছে।

কিছু কৌশলবিদ বলেন, পারমাণবিক উত্তেজনার ভয় পেলে যুদ্ধই করা যাবে না; এমন মনোভাবই এখনকার বাস্তবতা। কিন্তু যদি সত্যিই যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, কতটা ঝুঁকি নেওয়া যাবে, আর সেই ঝুঁকি কমানোর উপায় কী।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাইবার শক্তি ও ভবিষ্যৎ সংঘাতবিষয়ক সহযোগী ফেলো ফ্রান্জ-স্টেফান গ্যাডি প্রস্তাব করেন, ‘স্মার্ট অ্যাট্রিশনাল অ্যাপ্রোচ’ একটি বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষয়যুদ্ধনীতি। এতে চীনের কমান্ড সেন্টার বা পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলা না করে তাদের প্রচলিত বাহিনীকে রুখে দেওয়া হবে। এর মানে হলো, যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর, কিন্তু পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি কমবে।

এই কৌশলে জোর দেওয়া হবে স্বল্পপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে। বেশি টর্পেডো, ড্রোন এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায়। প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত বিজয়ের মোহ ত্যাগ করে, বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।

কিন্তু সমস্যাটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মতির অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কি সত্যিই হাজারো সেনার প্রাণ এবং অর্ধেক নৌবাহিনী হারানোর বিনিময়ে তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে রাজি?

অবশেষে প্রশ্ন একটাই, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সামরিক ইতিহাসবিদ মাইকেল হাওয়ার্ড যেমন বলেছিলেন, পশ্চিম এখনো শান্তির কুয়াশার ভেতর দিয়ে নৌযাত্রা করছে। শেষ মহাযুদ্ধ থেকে সময় যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ভয়াবহ ভুলের সম্ভাবনাও ততই বাড়ছে।

তাই যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। শিল্পক্ষমতা বাড়াতে হবে, পারমাণবিক ঝুঁকি কমানোর কৌশল নিতে হবে এবং জনগণকে জানাতে হবে, এই যুদ্ধের প্রকৃত মূল্য কী হবে। প্রযুক্তি দিয়ে দ্রুত জয়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভেসে চললে, আগামীতে ‘বৃহৎ দুই শক্তির যুদ্ধ’ হবে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ শিক্ষা। যেমনটি বলেছিলেন এথেন্সের কৌশলবিদ থুসিডিডিস, পরবর্তী মহাশক্তির যুদ্ধ হবে এক কঠোর শিক্ষক।

তথ্যসূত্র: টাইম ও ফরেন পলিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এবার থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ‘শান্তিচুক্তি’ বাগাতে যাচ্ছেন ট্রাম্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।

ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।

তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।

তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।

তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।

জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’

মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’

কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’

জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’

আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।

কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’

গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’

থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।

কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।

তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’

থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ট্রাম্পের কথায় যুদ্ধ বন্ধ করলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।

মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।

গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।

এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’

যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’

এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।

রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।

জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।

তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’

এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।

গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।

অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।

এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’

এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।

সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।

এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শশী থারুরের নিবন্ধ

অস্তিত্বসংকটে জাতিসংঘ: আঞ্চলিক জোটের কাছে কি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
অস্তিত্বসংকটে জাতিসংঘ: আঞ্চলিক জোটের কাছে কি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।

লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।

যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’

বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।

জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’

তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।

কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।

তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।

চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।

ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।

অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।

আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।

এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।

জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।

বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত