Ajker Patrika

ফসলহানি হবে জেনেও ইটভাটায় কেন মাটি বেচছেন কৃষক

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ২১: ০৮
Thumbnail image

বারেক মিয়ার পাঁচ বিঘা জমি। নিচু এলাকা হওয়ায় এসব জমিতে মূলত ধান চাষ করেন তিনি। কিন্তু বছর বছর ধানের বাজারের নিম্নগতির কারণে লোকসানের চক্রে পড়ে গেছেন তিনি। এবার বোরো মৌসুমে আবাদ করার মতো পুঁজি নেই হাতে। তাই সবগুলো জমির উপরিস্তরের মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে ১ লাখ টাকা পেয়েছেন তিনি। এই টাকায় এক বছর নিশ্চিন্তে খেয়েপরে চলে যাবে তাঁর। অথচ ধান বেচে গত বছর বোরো ও আমন মৌসুম মিলিয়ে যে আয় হয়েছে, খরচ বাদ দিয়ে তার অর্ধেকও টেকেনি। 

শুধু বারেক মিয়া নন, দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই কৃষকদের মধ্যে এখন এই প্রবণতা বেড়েছে। আবাদি জমির উপরিস্তরের এই মাটির প্রধান ক্রেতা ইটভাটা। প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ আবাদি জমির মাটি ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে চলে যাচ্ছে ভাটায়। 

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উপরিস্তরের মাটি তুলে ফেলার পর জমির উৎপাদন সক্ষমতা ৩৭ থেকে ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অভিজ্ঞতা থেকে কৃষকেরা এটি বুঝলেও নানা কারণেই মাটি বিক্রি করছেন। গবেষণায় এই মাটি বিক্রির পেছনে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করছে এমন কয়েকটি বিষয় শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো জমি সমান/সমতল করা, জরুরি আর্থিক প্রয়োজন মেটানো, মাটির গুণগত মান খারাপ, ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত, পাশের জমির মালিকের কারণে বাধ্য হয়ে, ফসলি জমির মাটির বিক্রি বেশি লাভজনক বিবেচনা, কৃষিতে আগ্রহ হারানো, ইটভাটার মালিক অথবা দালালের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং মাছ চাষ। 

দেখা গেছে, জমি সমান করার উদ্দেশ্যেই সবচেয়ে বেশি কৃষক মাটি বিক্রি করেন। এরপরই আছে ভরণপোষণ অথবা চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর মতো জরুরি আর্থিক প্রয়োজনের বিষয়টি। 

বন্যাপ্রবণ এলাকায় কৃষকদের মধ্যে আবাদি জমির মাটি বিক্রির প্রবণতা বেশি

দেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে ঢাকার উপকণ্ঠ এবং বন্যামুক্ত অঞ্চল হিসেবে যশোর এলাকার মোট ১২০ জন কৃষকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, জমির উপরিস্তরের মাটি তুলে ফেলার কারণে ফসল উৎপাদন ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত এবং আয় ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন কৃষকেরা। দেখা গেছে, মাটি তুলে ফেলার কারণে কৃষি উৎপাদনে যে হ্রাস হয়, তার কারণে ফসল উৎপাদনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায়ও। 

বন্যাপ্রবণ এলাকায় কৃষকদের মধ্যে আবাদি জমির মাটি বিক্রির প্রবণতা বেশি। বন্যামুক্ত অঞ্চলের কৃষকেরা যেখানে প্রতিজনে গড়ে ৮৭৭ ঘনমিটার মাটি বিক্রি করেন, সেখানে বন্যাপ্রবণ এলাকার কৃষকেরা জনপ্রতি এক মৌসুমে ৩০০০ ঘনমিটারেরও বেশি মাটি বিক্রি করেন। শুধু বন্যাপ্রবণ এলাকায় জমির মাটি তোলা হয় তুলনামূলক অনেক গভীর করে। বন্যামুক্ত এলাকায় গড়ে ০ দশমিক ৫ মিটার গভীর করে তোলা হলেও বন্যাপ্রবণ এলাকায় তোলা হয় গড়ে ১ দশমিক ৩ মিটার গভীর করে। মাটি বিক্রির পরের মৌসুমে ফসল উৎপাদন সবচেয়ে বেশি কমে বন্যাপ্রবণ এলাকাতেই। অবশ্য এসব এলাকায় বন্যায় আবার পলি এসে এসব জমির উর্বরতা শক্তি দ্রুতই ফিরিয়ে আনে। যেখানে বন্যামুক্ত এলাকায় জমির স্বাভাবিক উৎপাদন সক্ষমতায় ফিরতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। 

এ ছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানান, অনেক কৃষক অথবা জমির মালিকদের জন্য মাটি বিক্রি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন মাটি বিক্রেতা জানান, একজন জমির মালিক মাত্র ৮০০ ঘনমিটার মাটি বিক্রি করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। এর জন্য মাত্র ০ দশমিক ০১ হেক্টর জমির মাটি বেচতে হয়। অথচ বন্যাপ্রবণ এলাকায় এই পরিমাণ জমিতে এক মৌসুমে ৬৫০ থেকে ৬৮০ কেজি ধান উৎপাদন করতে পারে, যার বাজারমূল্য মাত্র ১২ হাজার টাকা। তুলনামূলক বিচারে মাটি বিক্রির সমপরিমাণ অর্থ ধান উৎপাদন করে উপার্জন করতে হলে সেই কৃষককে অন্তত ৮ বছর অপেক্ষা করতে হতো। এ ছাড়া ফসল নিয়ে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন কৃষকেরা: আবহাওয়া, বাজারদর, সারের সরবরাহ ও দাম এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য এখানে খুবই অনিশ্চিত। 

হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, কমবেশি ১ হাজার ৫০০ কোটি ইট প্রতিবছর তৈরি হয়। ইটভাটাগুলো নদীর পাশে হওয়ার কথা থাকলেও জ্বালানি প্রাপ্তির জন্য সাধারণত বনের পাশে হয়ে থাকে। প্রতিবছর ১ শতাংশ জমি হারাচ্ছি। এর ১৭ শতাংশ জমি ইটভাটার জন্য হারাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। প্রতিবছর ২০ লাখ টন জ্বালানি কাঠ ও ২০ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হয়। বছরে ৯০ লাখ টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছি।  

জমির উপরিস্তরের মাটিতেই ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি পুষ্টি উপাদান থাকে

২০১১ সালে সরকারের পক্ষ থেকে জানা গেল দেশে ইটভাটার সংখ্যা ৫ হাজার। ২০১৫ সালে জানা গেছে, এ সংখ্যা ৬ হাজার ৯০০ টি। অর্থাৎ, প্রতি বছর প্রায় ৫০০টি করে ভাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

বন্যামুক্ত এলাকায় মাটি বিক্রি করে প্রতি হেক্টরে গড়ে আয় করেছেন ৮০ হাজার টাকার বেশি, আর বন্যাপ্রবণ এলাকায় একই পরিমাণ জমির মাটি বিক্রি করে আয় করেছেন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা। বন্যাপ্রবণ এলাকায় মাটি বেচে বেশি আয় করার বড় একটি কারণ, এসব এলাকায় মাটির দাম বেশি, এ ছাড়া এসব মাটি বেশি গভীর করে তুলে নেওয়া হয়। ফলে এসব এলাকায় মাটি তুলে ফেলার পর ফসল উৎপাদন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় ঢাকাসংলগ্ন এলাকায়। দ্রুত নগরায়ণের ফলে এসব এলাকায় ইটের চাহিদা বেশি বলে দামও বেশি। 

মাটি বিক্রির কারণে বাংলাদেশে ফসলের এই ক্ষতি ভারতের তামিলনাড়ুর চেয়ে বেশি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট জার্নালে, ‘The Drivers and Impacts of Selling Soil for Brick Making in Bangladesh’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। 

এ নিয়ে দুই দশক আগেই পাঁচ বছর মেয়াদি গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু হেনা মো. জুলফিকার আলী। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা সেই গবেষণাতেও ফসলি জমির উপরিস্তরের মাটি সরিয়ে নেওয়ার নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। সর্বশেষ এই গবেষণা সম্পর্কে আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণাতেও এমন বিষয়ই উঠে এসেছে। উপরিস্তরের মাটিতেই ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি পুষ্টি উপাদান থাকে। এই মাটি সরিয়ে নিলে স্বাভাবিকভাবেই উর্বরতা শক্তি কমে যায়। এতে ফসলহানি হয়।’ 

জমি সমান করার উদ্দেশ্যেই সবচেয়ে বেশি কৃষক ইটভাটার কাছে মাটি বিক্রি করেন

শুধু যে ফসলহানি বা উর্বরতা শক্তি কমে যায়, তা নয়। জমির উপরিস্তরের মাটি সরিয়ে নেওয়ার প্রভাব পড়ে সার্বিক পরিবেশের ওপর। অধ্যাপক আবু হেনা বলেন, ‘মাটির স্তরগুলোর মধ্যে তো বটেই আশপাশের পরিবেশের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মাটিতে ভেজিটেশন কমে যায়। এতে ধারাবাহিকভাবে মাটির সক্ষমতা কমতে থাকে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয় নদীতীরবর্তী এলাকায়। নদীর পার্শ্ববর্তী কোনো এলাকার জমির উপরিস্তর সরিয়ে নিলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। মাটি সরে গিয়ে ধীরে ধীরে নদী ভরাট হয়। সাভার অঞ্চলের ইটভাটাগুলোর কারণে এমনটা হয়েছে। এর প্রভাব তখন পড়ে নদীতে থাকা প্রাণীদের ওপরও। জলজ পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা সার্বিক জীববৈচিত্র্যের ওপর এর বাজে প্রভাব পড়ে।’ 

 ২০০১ সালে সরকারের একটি খণ্ডকালীন সিদ্ধান্ত ছিল যে, নতুন করে আর কোনো ইটভাটা হবে না। এ সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাবই পরবর্তী সময়ে পড়ল না। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বছরে ইটের চাহিদা ১ হাজার ৫০০ কোটি। কিন্তু এ জন্য ১২৭ কোটি সিএফটি মাটি লাগে। বিশ্বব্যাংক ২০১১, ইউএনডিপি ২০১২ ও বেলা নভেম্বর ২০১২ থেকে মার্চ ২০১৩ এবং জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত সময়ব্যাপী এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। 

তবে ড. আবু হেনার ভাষ্যমতে, একেবারেই যে প্রভাব পড়েনি, তা নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা সে সময় কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে অনুযায়ী কিছু কাজ হয়েছে। তবে যতটা হওয়া উচিত ছিল, ততটা হয়নি। ইটভাটার জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রের বিষয়টি কিন্তু এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটি আরও কঠোরভাবে হওয়া উচিত। ইটভাটা তো এমনিতেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত