Ajker Patrika

‘আপনার আব্বা অনেক জ্বালায়!’

আপডেট : ১৯ জুন ২০২২, ১৯: ১৭
‘আপনার আব্বা অনেক জ্বালায়!’

রাত তখন ১১টা। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও আব্বুর ঘরে গেলাম ওষুধগুলো দিতে। জানুয়ারির শীতের রাত। অর্ধেকটা লেপ গায়ে তুলে আব্বু খাটের ওপর বসে আছেন। এক হাতে ওষুধ, অন্য হাতে পানির বোতল এগিয়ে দিলাম, ‘আব্বু খাও’। ‘হুম’ বলে এক হাতে ওষুধ আর অন্য হাতে পানির বোতল নিয়ে একমুহূর্ত সময় না নিয়েই উল্টো দিকে শুয়ে পড়লেন আব্বু। তাঁর পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। বোতল গড়িয়ে জল পড়ল মেঝেতে। আমি চিৎকার করেছিলাম কি না, মনে নেই। দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ‘কী হয়েছে’, ‘কী হয়েছে’ করছিলাম। অদৃশ্য কিছু বুকে ভর করেছে—এমন অভিব্যক্তি আব্বুর চোখমুখে। এই দৃশ্য পরিবারের আর কেউ দেখেনি। চিৎকার করে বোনকে ডাকলাম। বোন ভাইদের ডাকল। খাওয়া ফেলে হাত না ধুয়েই তারা হাজির। আব্বু ততক্ষণে একটু স্বাভাবিক, তবে এলোপাতাড়ি বুকে হাত দিচ্ছেন। এরপর…

খণ্ড খণ্ড জমাট রক্ত বের হলো আব্বুর মুখ দিয়ে। সামলানো যাচ্ছে না। বালতিভর্তি ঘন রক্ত তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমার বাবার কলিজাটাই বুঝি খণ্ড খণ্ড হয়ে বেরিয়ে আসছে! তিনি মূর্ছা যেতে যেতেও যাচ্ছেন না। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো। এল। অ্যাম্বুলেন্সে করে এলেন মাত্র দুজন। একজন ড্রাইভার, অন্যজন সাহায্যকারী। ওই একজন সাহায্যকারী একটা হুইলচেয়ার নিয়ে ওপরে এলেন। আব্বুর শরীর ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানি, ঠিক ওই মুহূর্তে আমি ছাড়াও বাড়ির সবাই টের পেয়েছিলেন, এই মানুষটাকে বুঝি আমরা হারাতে বসেছি…।

এক.
অ্যাম্বুলেন্সে মাত্র একজন সাহায্যকারী এসেছেন রোগীকে নিতে, ভাবা যায়? আব্বুকে দুই ভাই আর আমি মিলে হুইলচেয়ারে বসালাম। বাড়িতে লিফট নেই। আব্বুসহ এই হুইলচেয়ার নামাতে হবে সিঁড়ি দিয়ে উল্টো করে। আমি চিৎকার করছি, ‘না না, আব্বু পড়ে যাবে!’ ভাইয়েরা বললেন, ‘কিচ্ছু হবে না পারব।’ দুই ভাই মিলে নামাতে লাগলেন। বড় ভাই সাহায্যকারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, ড্রাইভার সাহেব কি একটু আসতে পারবেন? একটু ধরলে ভালো হয়।’ উনি গিয়ে ড্রাইভারকে জানালে ড্রাইভার অসম্মতি জানান ওপরে আসতে। অগত্যা নিজেদেরই নামাতে হলো। রাত ১২টায় দানবের মতো হুইসেল দিয়ে গড়াতে লাগল অ্যাম্বুলেন্সের চাকা। সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ মনে হচ্ছিল নিজেকে।

দুই.
অ্যাম্বুলেন্স থামল বারডেমে। আব্বু ততক্ষণে ‘একটু পানি খাব, একটু পানি খাব’ বলছেন। কিন্তু পারিবারিক বন্ধু ডাক্তার কিছুক্ষণ আগেই বলেছেন, পানি দেওয়া যাবে না, ব্লিডিং বাড়বে। দায়িত্বরত ডাক্তার ব্লাড প্রেশার মাপ‌লেন ও ইসিজি করলেন। আব্বুকে বললেন, ‘বাবা পানি দিচ্ছি, আগে টেস্টটা করে নিই।’ ডাক্তার অস্থির হয়ে বললেন, ‘এখনই আইসিইউ লাগবে।’ উনি পায়চারি করতে করতে সহকারীকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি স্যালাইন দাও।’ ‘আমাদের আইসিইউ খালি নেই।… নয়তো এখনই কলাপস করবে।’ আমরা ছুটলাম হলি ফ্যামিলির উদ্দেশে।

তিন.
শীতের রাত। ট্রলিতে আব্বুর শরীর নেতিয়ে পড়ে আছে। আইভরি রঙের একটা চাদর নিয়ে এসেছিলাম বাসা থেকে। সেটা গায়ে তুলে দিলাম। দুই ভাই রিসেপশনে কথা বলছে। দায়িত্বরত অ্যাটেনডেন্ট বলছেন, ‘আইসিইউ বেড খালি আছে। পার বেড ২৫ হাজার। ভর্তি করবেন?’ বাঁকা হাসি তাঁর ঠোঁটে। আমি আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু একদিকে তাকিয়ে আছেন। ‘পানি দাও’ আবার বললেন। আব্বুর ডিমেনশিয়া ছিল। তিনি হিসাব রাখেননি এ যাবৎ কয়বার বলেছেন এক কথা…। পেমেন্ট করার পর ভদ্রলোক বলে দিলেন আইসিইউ বেডের হদিস। দুজন আয়া চোখমুখে বিরক্তি নিয়ে আব্বুর গায়ে হাসপাতালের সাদা চাদর ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই শীতের মধ্যে কম্বল আনে নাই এরা!’

চার. 
আব্বু আইসিইউর অজানা ঘরে আড়াল হয়ে গেলেন। বাইরের বেঞ্চে আমরা বসে। রাত সোয়া ৩টা তখন। আমরা তিন ভাইবোন আর পারিবারিক বন্ধু ডাক্তার সেখানে। বড় ভাই রয়ে গেলেন। বাকি দুই ভাইবোন চলে এলাম। বাড়ি ফিরে মনে হলো, ঘরে আলো কেমন কমে গেছে। সে কী দীর্ঘ রাত। আম্মু তখন এক মাসের রোগী। ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়েছে আবার। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছেন। তাঁর গা ঘেঁষে শুয়েছি। আম্মুর চুলে ভাটিকা হেয়ার অয়েলের ঘ্রাণ। অতীত ব্যাপারটা অদ্ভুত—চাইলে চোখের সামনে ধরা দেয়। কিন্তু ভবিষ্যৎটা দেখা যায় না।

ক্লাস ফাইভে যখন উঠলাম, তখন চট্টগ্রাম থেকে একবার আমার বড় বোন এল। আব্বু-আম্মুর জন্য নিয়ে এল ভাটিকা হেয়ার অয়েল। কী সুন্দর ঘ্রাণ তেলের, আবার মাথা ঠান্ডাও হয়ে যায়! আব্বুর রাতে ঘুম হতো না ভালো। ঘুমানোর আগে মাথার চাঁদিতে দেওয়ার জন্যই এনেছিল আমার বোন। এতে মাথা ঠান্ডা হবে আর আব্বু ঘুমাতেও পারবেন। কিন্তু ওই তেল আমার দেওয়া নিষেধ ছিল। কারণ ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। তবে মাঝেমধ্যে পড়ার সময় মাথা ঘোরাচ্ছে এই বাহানায় ওই তেল দেওয়ার সুযোগ পেতাম।

ভাটিকার ঘ্রাণটাই আমাকে টানত মূলত। সে সময় আম্মু চুলে তেল দেওয়ার কথা বললেই বলতাম, যদি ভাটিকা দিতে দাও তাহলে তেল দেব, নয়তো না। আম্মু তখন অকারণ বকবক করতেন। কিন্তু তাঁর মনে হতো তিনি যৌক্তিক কথা বলছেন। আব্বু আম্মুকে বলতেন, দাও না। কী হবে দিলে? তখন আব্বু বসতেন খাটের ওপরে আর আমি রান্নাঘর থেকে মোড়া এনে খাটের কাছে আব্বুর সামনে বসতাম। আব্বু পেছন থেকেই আমার মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুলকে দুই ভাগ করতেন। তারপর এক এক পাশ করে তেল লাগাতেন। বলতেন, তেল হচ্ছে চুলের খাবার। তুমি না খেলে যেমন পুষ্টি পাবে না, তেমনি চুলও তেল না পেলে পুষ্টি না পেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।

মাঝেমধ্যে তেল দিতে দিতে একটা হিন্দি গানও গাইতেন আব্বু। তখন জানতাম না গানটা আসলে কার বা কোন সিনেমার। গানটা হচ্ছে, ‘চান্দনি জেইসা রাঙ হ্যায় তেরা, সোনে জেইসে বাল/ এক তুহি ধানবান হ্যায় গোরি, বাকি সাব কাঙাল।’
এই রাত কখন শেষ হবে…।

পাঁচ.
পরদিন হাসপাতালে গিয়ে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে একবার আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে পারলাম। তাঁর বুক অবধি তুলে দেওয়া সবুজ কম্বল। এক হাতে স্যালাইন, আরেক হাতে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। বাইরে ডোনারদের লাইন। আব্বুর দুই হাত বেডের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আমাকে বললেন, ‘বাবা খুলে দাও। আমি এক কাত হয়ে ঘুমাব।’ আমি সিস্টারকে প্রশ্ন করলাম, ‘আব্বুর হাত-পা বেঁধে রেখেছেন কেন?’ বললেন, ‘আপনার আব্বা অনেক নড়াচড়া করে। খালি বলেন খুলে দাও। এত নড়াচড়া করলে ব্লাড স্যালাইন সব বেরিয়ে একাকার হবে। ওনাকে বারবার বলছি, তা-ও একই কথা বলেন!’ আমি জানালাম, ‘আমার বাবার ডিমেনশিয়া আছে। তিনি জানেন না ঠিক কতবার কী কথা বলছেন।’ তাঁদের তাড়াহুড়োয় আব্বুর কপালে একটু চুমু খেয়েই বেরিয়ে গেলাম। আব্বু কী বললেন শুনলাম না। এটাই শেষ চুমু।

ছয়.
করিডরে বসে আছি। আইসিইউ থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এলেন। আমার ভাই তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবার কী অবস্থা?’ নার্স এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বললেন, ‘আপনার আব্বা অনেক জ্বালায়!’ ভাই জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকালেন। তিনি আবারও বললেন, ‘এক কথা বারবার বলেন।’ আমি তাকিয়ে রইলাম। রোগ সম্পর্কে বুঝতে পেরেও একজন কীভাবে এভাবে বলে? এ ঘটনার পর আব্বুকে প্যাথেড্রিন দেওয়া হয়। চোখ খোলা অবস্থায় আর দেখিনি।

সাত. 
পরদিন সকালে আব্বুর নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর মাথার তালুতে বারবার স্পর্শ করছিলাম। আব্বু কি সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন? মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবীতে আব্বুর মৃতদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি একা। কী অদ্ভুত, না? বাবা ছাড়া বেঁচে থাকা যায়? অথচ ওরা কী অবলীলায় বলে দিল, ‘আপনার আব্বা অনেক জ্বালায়!’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বীর্যে বিরল অ্যালার্জি, নারীর বন্ধ্যত্ব নিয়ে চিকিৎসকদের নতুন সতর্কতা

কক্সবাজারে যাওয়ার পথে ২৩ মামলার আসামিকে কুপিয়ে হত্যা

আওয়ামী লীগ নেতাকে ধরতে গিয়ে ছেলের বঁটির আঘাতে এসআই আহত, আটক ২

নিহত ১১, আহত ৫০, ভারতের সেই মাঠ থেকে সরে যেতে পারে বিশ্বকাপ

এক টন কয়লাও ইসরায়েলে যাবে না, নির্দেশ কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত