Ajker Patrika

চিরকিশোর এক রঙিন প্রজাপতি

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৭: ৪৩
চিরকিশোর এক রঙিন প্রজাপতি

বইগুলো ছিল পেপারব্যাক। লেখার হরফ দেখা যেত কম দামি নিউজপ্রিন্টে। প্রচ্ছদে থাকত রহস্যের ইঙ্গিতবাহী সব উপকরণ। আর এক কোনায় জ্বলজ্বল করত হলুদরঙা প্রজাপতি। তার চারপাশে লাল ছিল স্বমহিমায়। আর এই লাল ও হলুদে মিশে আমাদের মনে তৈরি হতো এক নয়া রঙিন দুনিয়া! 

সেই দুনিয়ায় ঢোকার টিকিটের দাম উৎসাহীদের হাতের নাগালেই থাকত। সেখানে অন্তত ছিল না ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা দেখাত যৎসামান্য দর্শনীর বিনিময়ে। পাঁচ দশকের বেশি সময় গড়ালেও জাদুকর তাঁর প্রজাপতির দর্শনী কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশে চড়াননি। হয়তো প্রজাপতি দেখে দর্শনার্থীদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠা আলোকচ্ছটা অবলোকনের এক দুর্নিবার নেশা ছিল তাঁর। 

সেই জাদুকর ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ‘ছিলেন’ শব্দটি ব্যবহার করে অতীতচারী হতে হচ্ছে মোটে কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা এক সংবাদের কারণে। সেই সংবাদ জানিয়েছে, সবার প্রিয় ‘কাজীদা’ নাকি চলে গেছেন! আসলেই কি গেছেন? নাকি বাহ্যিকভাবে থাকা একটা মানুষ এখন হৃদয়ের বা বিজ্ঞানের হিসাবে মস্তিষ্কের গভীরতম নিউরনে ঘাঁটি গেড়েছেন? সেখান থেকে কি আর কাজীদাকে সরানো সম্ভব! 

শৈশব-কৈশোরে আমাদের রঙিন দুনিয়া দিয়েছে তিনজন গোয়েন্দা। সেই গোয়েন্দাদের গড়ে-পিটে মানুষ করেছিল কাজীদার প্রজাপতি ‘সেবা’। আমাদেরও কি গড়েনি? অন্তত দুর্ধর্ষ সব গোয়েন্দা অভিযানে বুঁদ করে কল্পনার আকাশটাকে বড় তো করতে শিখিয়েছে। হ্যাঁ, ওই বয়সটা এমন ছিল যে সচেতন অভিভাবকেরা কখনো কখনো মাসুদ রানার সঙ্গে পরিচিত হতে গেলেই সিনেমার ‘চৌধুরী সাহেব’ হয়ে যেতেন। নিষেধাজ্ঞা আসত। আর আমাদের তখন জেদ চাপত বয়সের কাঁটাকে রকেটের গতিতে ঘোরানোর! আরে, বড় না হলে ড্যাশিং স্পাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেকটা হবে কীভাবে? কেউ কেউ নিশ্চয়ই বয়সের কাঁটার নিয়মমাফিক চলাকে বরদাশত করতে না পেরে বাড়ির বা স্কুলের কোনো কোণে গোপনে দেখা করত বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেই দুঃসাহসী গুপ্তচরের সঙ্গে। আজ নিশ্চয়ই সেসব নির্দোষ লাগে বড়, ঠোঁটের কোণে আসে মুচকি হাসি। এই বড় বেলায় সেই প্রশান্তি এনে দেওয়া হাসিটুকুও কিন্তু কাজীদার সৌজন্যেই। 

এ তো গেল রোমাঞ্চ। তার পাশেই ছিল আরও ঘন রহস্যে ঘেরা পত্রিকা। এর বাইরে সেবা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বের সঙ্গে, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় হাঁটতে শিখিয়েছে। সেখানে এই পৃথিবীর কালজয়ী প্রায় সব লেখকই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সাগ্রহে। সেবার কিশোর ক্ল্যাসিক আমাদের হাতে কম খরচে তুলে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের মণি-মুক্তো। উদাহরণ দেওয়ার কি দরকার আছে? ছোটবেলার কিছু নাম মনে করুন না! দেখবেন, প্রজাপতি থাকবে ঠিকই। 

হ্যাঁ, সমালোচনা থাকতেই পারে। মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্নও তোলা যায়। তাই বলে কি যৌগিক পদার্থের গুরুত্ব ফিকে হয় একেবারে? হাইড্রোজেন, অক্সিজেন মিলে জল হয় বটে। তাই বলে জলের অপর নাম জীবন নয়! তেষ্টায় গলা ভেজাতে কিন্তু জলই লাগে হাতের কাছে। সেই তেষ্টা মেটাতে সেবার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিল না। বরং চাইলেই অনতিদূরত্বে পাওয়া গেছে গেলাস ভরা জল। শতকের পালাবদল বা মুক্ত বাজার অর্থনীতি—কিছুই সেখানে নাক গলাতে পারেনি। বরং পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের ‘থ্রিলড’ করে গেছে অবিচলচিত্তে। 

এক সাক্ষাৎকারে বছর কয়েক আগে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, শৈশব থেকে থ্রিলার বই তাঁকে টানত প্রবলভাবে। তা থেকেই থ্রিলারে তাঁর আগমন। আর ওই বইগুলোর কারণেই তিনি চিরকিশোর রয়ে গেছেন নিজের ভালোবাসার জগতে। সেই সঙ্গে আমাদেরও তিনি দিয়ে গেছেন এক চিরকিশোর রঙিন প্রজাপতি। সেই প্রজাপতি বুড়ো হবে না কখনো, বয়স যতই হোক! বরং পাখার রং খোলতাই হবে আরও।

আড্ডা সম্পর্কিত আরও পড়ুন: 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঢাকাবাসীর দেশবন্ধু

সম্পাদকীয়
ঢাকাবাসীর দেশবন্ধু

আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন। বলা হয়, চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনদর্শনে প্রভাবিত হয়েই শচীমোহন রেস্তোরাঁটির নাম দেন ‘দেশবন্ধু সুইটমিট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। এর উল্টো দিকে তখন ছিল ইত্তেফাক পত্রিকার অফিস।

সেখানকার সাংবাদিকেরা দেশবন্ধুর পরোটা-লুচি-ভাজি-হালুয়া খেতে যেতেন নিয়মিত। কবি-সাহিত্যিক-অভিনয়শিল্পীরাও পছন্দ করতেন এই রেস্তোরাঁর খাবার। এমনকি এফডিসিতে ফরমাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো দেশবন্ধুর নাশতা। এখন হয়তো মানিক মিয়া, রাজ্জাক, কবরী কিংবা শাবানাদের মতো বিখ্যাতরা সেখানে যান না কিন্তু তাতে দেশবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখনো ঢাকাবাসীর ভিড় দেখা যায় এই রেস্তোরাঁয়। ভাবা যায়, সারা দিনই এখানকার পরোটা-ভাজি বিক্রি হতে থাকে! দুপুরে অবশ্য খাবারের তালিকায় ভাত-মাছ-মাংসও আছে। ছবি: মেহেদী হাসান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কুমারখালীতে কবি শাহীনা সোবহানের সম্মানে সাহিত্য আড্ডা

কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
কুমারখালী পৌর শহরের সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরে ড. নাসের ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এই আড্ডার আয়োজন করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
কুমারখালী পৌর শহরের সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরে ড. নাসের ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এই আড্ডার আয়োজন করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে কবি শাহীনা সোবহানের সম্মানে কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাহিত্য আড্ডা। গতকাল শনিবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে কুমারখালী পৌর শহরের সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরে ড. নাসের ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এই আড্ডার আয়োজন করা হয়।

কবি ও নাট্যকার লিটন আব্বাসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দা শাহীনা সোবহান।

ড. নাসের ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. আবু নাসের রাজীবের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা বিশ্বজিৎ সাহা, কুমারখালী সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি রহমান আজিজ, কবি রজত হুদা ও কবি সবুর বাদশা। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক সোহেল আমিন বাবু, কবি বাবলু জোয়ার্দার, কবি ও সাংবাদিক মাহমুদ শরীফ, জিটিভির কুষ্টিয়া প্রতিনিধি সাংবাদিক কাজী সাইফুল, দৈনিক নয়া দিগন্তের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি (মাল্টিমিডিয়া) সোহাগ মাহমুদ প্রমুখ।

এ সাহিত্য আড্ডায় কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর কবি-সাহিত্যিকেরা অংশ নিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন সংগীতশিল্পী জিয়াউর রহমান মানিক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নান্নার মোরগ পোলাও

সম্পাদকীয়
নান্নার মোরগ পোলাও

১৯৬০-এর দশকে হাজি নান্না মিয়া তাঁর দুই ভাই জুম্মুন মিয়া ও চান মিয়ার সঙ্গে শুরু করেন খাবারের ব্যবসা। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ছোট্ট একটা দোকানে পাতলা মাদুর বিছিয়ে তাঁরা পরিবেশন করতেন মোরগ পোলাও। সেই মোরগ পোলাওয়ের সুঘ্রাণের সঙ্গে এর সুখ্যাতি ছড়াতে সময় লাগেনি। মৌলভীবাজার থেকে পরে বেচারাম দেউড়ির সরদার ভবনে সরে আসে নান্না মিয়ার ব্যবসা। দোকানের নাম হয় হাজি নান্না বিরিয়ানি।

একে একে লালবাগ চৌরাস্তা, নবাবগঞ্জ বাজার, ফকিরাপুল ও নাজিমুদ্দিন রোডে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। একই নামে শত শত ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও আসল নান্নার মোরগ পোলাওয়ের স্বাদকে টেক্কা দিতে পারেনি কেউ। তাই তো ভোজনপ্রেমীরা ঠিকই চিনে নেন আদি রেসিপিটি। মোরগ পোলাওয়ের পাশাপাশি হাজি নান্না বিরিয়ানিতে পাওয়া যায় খাসির বিরিয়ানি, খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, বোরহানি, টিকিয়া, লাবাং ও ফিরনি। প্রতি মাসের ৫ তারিখে থাকে বিশেষ আয়োজন—আস্ত মুরগির পোলাও। ছবি: জাহিদুল ইসলাম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতি ও সামাজিক দায়িত্ব

সম্পাদকীয়
চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতি ও সামাজিক দায়িত্ব

চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতি-টদ্ধতি বুঝি না মশাই। আমার কাছে আজও প্রমথেশ বড়ুয়া ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক। আমরা কেউই তাঁর পায়ের নখের যোগ্য নই। আমার আজও মনে পড়ে ‘গৃহদাহ’র সেই অসম্ভব ট্রানজিশন—সেই যে হাইহিল জুতো-পরা দুটো পা থেকে সোজা কেটে দুটো আলতা-মাখা পা পালকি থেকে নামছে—আমি কখনো ভুলব না। ব্যাপারটা ভদ্রলোক করেছিলেন ১৯৩৬ সালে, এ কথা ভুলবেন না। আর সেই যে সেই ‘উত্তরায়ণ’-এ বড়ুয়া সাহেবের জ্বর হওয়ার পরে ক্যামেরা সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে আছড়ে পড়ল—সেটাই কি ভোলা যায়! কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন ভদ্রলোক ডেভিড লিনের ‘অলিভার টুইস্ট’-এর বহু আগে। সাবজেকটিভ ক্যামেরা সম্পর্কে অনেক কথা আজকাল শুনতে পাই, বিভিন্ন পরিচালক নাকি খুব ভালোভাবে ব্যবহার করছেন।

...আমার কাছে গুলিয়ে গেছে সিনেমার প্রাচীন আর আধুনিক বলতে আপনারা কী বোঝাতে চেয়েছেন। এসব ধরনের কথা শুনলে আমার একটা কথাই মনে হয়, কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’।

...চলচ্চিত্রের সামাজিক দায়িত্ব সব সময়ে হয়েছে। হয় পজিটিভ, না হয় নেগেটিভভাবে। ছবিটাকে আমি একটা শিল্প বলি। কাজেই মনে করি সর্বশিল্পের শর্ত পালিত হচ্ছে এখানেও। আমি মনে করি না যে সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ চ্যাপলিনের ‘এসানে’ যুগের এক রিলের ছবিগুলোর চেয়ে বেশি সচেতন।

১৯২৫ সালে তোলা আইজেনস্টাইনের ‘স্ট্রাইক’ ছবির চেয়ে বেশি সমাজসচেতন ছবি কি আজ পর্যন্ত তোলা হয়েছে? পাবস্ট-এর ‘কামেরা ডে শেফট’ আজও পর্যন্ত আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বেশি সমাজসচেতন একটি ছবি। চারু রায়ের ‘বাংলার মেয়ে’ বহু আগে তোলা—প্রথম বাংলা ছবি, যাতে আউটডোর ব্যবহৃত হয় সবচেয়ে বেশিভাবে, তাতেও সমাজচেতনা পরিপূর্ণ ছিল।

...রবিঠাকুর মশায় একটা বড় ভালো কথা বলে গিয়েছিলেন, ‘শিল্পকে শিল্প হতে হলে সর্বাগ্রে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তারপরে সৌন্দর্যনিষ্ঠ’। কথাটা ভাবার মতো। যদি পারেন ভেবে দেখবেন।

সূত্র: ঋত্বিক ঘটকের গৃহীত সাক্ষাৎকার, ‘সাক্ষাৎ ঋত্বিক’, শিবাদিত্য দাশগুপ্ত ও সন্দীপন ভট্টাচার্য সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ১৮-১৯

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত