Ajker Patrika

নাদাল পেরেছেন, জোকোভিচও আছেন

রহমান মৃধা
নাদাল পেরেছেন, জোকোভিচও আছেন

লেখাপড়া আর চাকরি করা—এই আমাদের পৃথিবী। এর বাইরেও জগৎ আছে, তা কি জানি না! যে কাজটি করার কথা ছিল গত ইউএস ওপেনে জোকোভিচের, তা সম্ভব হয়নি। সে কাজই সম্পন্ন করলেন রাফায়েল নাদাল; টেনিস দুনিয়ায় নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। 

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই প্রতিযোগিতা শুরু। টিকে থাকার প্রতিযোগিতা দিয়েই মানুষের যাত্রা। তার পর উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা, ধর্মের প্রতিযোগিতা, রূপ ও গুণের প্রতিযোগিতা। বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা, ভালোবাসার প্রতিযোগিতা—এমনকি ঘৃণারও প্রতিযোগিতা বিরাজমান সারা বিশ্বে। 

খেলাধুলার প্রতিযোগিতা তো সর্বজনস্বীকৃত। খেলাধুলায় দুটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় বিনোদনের, গড়ে উঠে উত্তেজনা, উদ্দীপনা এবং সবশেষে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তা। বিজয় অর্জনে দরকার সাহসিকতার এবং খেলতে দরকার সহযোগিতা। যুগ যুগ ধরে খেলাধুলোর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয় সেরাদের মধ্যে সেরা কে, যাকে বলে বিশ্বসেরা। এর মধ্যে কেউ আবার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে নিজের নামটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। 

পৃথিবী সৃষ্টির পর শুধু দৌড় প্রতিযোগিতায় কতবার বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে তা-কি আমরা জানি? ১০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড গড়ে উসাইন বোল্ট তো নিজেই এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। অতিসত্বর চীনে শুরু হতে যাচ্ছে উইন্টার অলিম্পিক, দেখা যাক এমন কেউ আছে কি-না, যিনি নতুন করে রেকর্ড বইয়ে নাম লেখাতে পারবেন। 

আজ আমি টেনিসের জগৎ এবং তার রেকর্ড এবং ভবিষ্যৎ রেকর্ড নিয়ে আলোচনা করব। অন্যান্য খেলাধুলোর মতো টেনিসেও বিশ্ব রেকর্ড বা খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব। 

কথায় বলে ‘everything is impossible until someone makes it possible’. যেমন পৃথিবী সৃষ্টির পর পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি টেনিসে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন, তিনি হলেন রজার ফেদেরার। গ্র্যান্ড স্ল্যাম হলো চারটি বড় স্ল্যাম টুর্নামেন্ট। এগুলো হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেন। এ টুর্নামেন্টগুলোকে বেশি পয়েন্ট, ঐতিহ্য, প্রাইজমানি ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেনিস ইভেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বড় টুর্নামেন্টগুলোই একের পর এক জিতে বাজিমাত করেছিলেন ফেদেরার। প্রথমে যা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল, এখন তা-ই যেন সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তিনজন বিশ্বসেরা খেলোয়াড় ২০টি করে গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা অর্জন করেছেন। এবং তাঁরা তিনজনই টেনিসের জগতে কিংবদন্তি হিসেবে স্বীকৃত, যারা এখনো খেলেই যাচ্ছেন। এবারের বছরের শুরুতে যে গ্র্যান্ড স্ল্যামটি শুরু হয়েছে, সেটা হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। ভাবতে অবাক লাগে একবার নয়, দুবার নয়, ২০ বার গ্র্যান্ড স্ল্যাম বিজয়ী বর্তমান তিনজন রয়েছেন একই সারিতে এবং তিনজনই সক্রিয় খেলোয়াড়। তাঁরা হলেন রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ। এবারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে এই তিনজনের মধ্যে শুধু নাদাল খেলেছেন। ফেদেরার ইনজুরির কারণে যোগ দিতে পারেননি। অন্যদিকে জোকোভিচ করোনা টিকা না নেওয়ায় অস্ট্রেলিয়া সরকার তাঁর ভিসা বাতিল করে দেয়। ফল—শিরোপা নাদালের হাতে। তাঁর ঝুলিতে এখন ২১টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা। 

যেহেতু খেলাধুলোয় রয়েছে প্রতিযোগিতা, সেহেতু ‘পুল অ্যান্ড পুশ’ কনসেপ্টটি ভীষণভাবে কাজ করে এখানে। টেনিসের জগতে বিশ্বের তিনজন নামকরা সুপারস্টার রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ পরস্পরকে সারাক্ষণ ‘পুল অ্যান্ড পুশ’ করছেন। আর এরই ফল হিসেবে একই সময়ে তিনজন কিংবদন্তিকে পেয়েছে বিশ্ব। 

বর্তমানের টেনিসে যা বেশি লক্ষণীয়, তা হলো শারীরিক যোগ্যতা। যেহেতু রজারের বয়স ৪০-এর বেশি; শারীরিক দিক দিয়ে আগের মতো পারদর্শিতা দেখাতে পারছেন না। তারপরও তাঁকে টেনিস কোর্টে সবাই দেখতে চায়; কারণ তিনি কিংবদন্তি এবং টেনিসে সেরাদের মধ্যে সেরা। 

নাদালের বয়সও কম নয়। আবার তাঁর খেলার যে ধরন, তাতে শারীরিক দক্ষতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিরোপা জয় দিয়েই দেখিয়ে দিলেন, এখনো দারুণ তিনি। কিন্তু বলা কঠিন, আসলেই কী অবস্থা তাঁর। তবে জোকোভিচের বর্তমান খেলার কৌশল, শারীরিক দক্ষতা এবং খেলার পারফরমেন্স দেখে মনে হচ্ছে, তিনিই ভবিষ্যৎ টেনিসে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম রেকর্ডধারী হয়ে থাকবেন অনেক দিন। কত দিন এই রেকর্ড ধরে রাখবেন সেটা নয়, প্রশ্ন এখন কত বছর ধরে রাখবেন? নতুন প্রজন্মের খেলা দেখে যতটুকু মনে হচ্ছে, তাতে বলতে চাই বারবার একই খেলোয়াড় সেরা ট্রফি জয়ী হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, প্রতিযোগিতার যুগে বলা মুশকিল কে, কখন, কাকে, কীভাবে পরাজিত করে! 

রজার ফেদেরার, নোভাক জোকোভিচ ও রাফায়েল নাদাল—একসঙ্গে তিন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়কে পেয়েছে বিশ্বআমি কিছুদিন আগে লিখেছি টেনিস এবং রজার ফেদেরার ও জোকোভিচকে নিয়ে। রজার ফেদেরারের টেনিস ক্যারিয়ারও একদিন শেষ হবে। প্রশ্ন হলো কবে, কখন ও কোথায়? তবে রজার ফেদেরারের টেনিসের প্রতি যে আসক্তি, তা শুধু তাঁর খেলা দেখলেই বোঝা যায়। রজার শুধু বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড়ই নন, তিনি টেনিস কোর্টের ‘আনন্দ’। তিনি সবার হৃদয়ের এক ভালোবাসার নাম। একদিন টেনিস জগৎ তাঁকে ছাড়া টেনিস খেলবে, হয়তো তাঁর কথাও ভুলে যাবে সময়ের সঙ্গে। নতুন চ্যাম্পিয়নের জন্ম হবে ঠিকই, তবে আমার মনে হয় রজার ফেদেরার সবার হৃদয়ে টেনিসের আইকন হয়ে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন। 

তবে যে বিষয়টি এখন তুলে ধরব, তা হয়তো নতুন ইতিহাসের এক পূর্বাভাস। সেটা আবার কী? রজার বা নাদাল যত সহজে বিশ্ববাসীর মন জয় করেছেন, জোকোভিচের পক্ষে সেটা তত সহজ হয়নি। কারণ একটাই, সেটা হলো জোকোভিচের জন্ম হয়েছে ইস্ট ব্লকে। পশ্চিমা দেশগুলো খুব সহজে পূর্ব ইউরোপের কারও প্রতিভা মেনে নিতে এখনো অভ্যস্ত হয়নি, বিশেষ করে টেনিসে। 

কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে বলে মনে হয় না। কারণ, জোকোভিচ ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতে যদি ২১ তম শিরোপাটি অর্জন করতে পারেন, তখন সব ভুলে বিশ্ব তাঁকেই বরণ করবে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে। যদিও আপাতত ঘটনার মোড় ঘুরে গেল। জোকোভিচ নন, ফেদেরার নন, নাদাল অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয় করে ২১ তম শিরোপাটা অর্জন করলেন। কী দারুণ এক অর্জন! 

জোকোভিচের সময় কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। তিনি যদি এভাবে খেলতে থাকেন, তাহলে কম করে হলেও আরও ৪-৬টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা অর্জন করবেন বলে আমার বিশ্বাস। প্রশ্ন হলো কে, কবে, কখন তাঁকে টপকে নতুন বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করবে? উত্তরটি কিংবা তার আভাস অন্তত এখন দেখা যাচ্ছে না।

এ লেখায় টেনিস কেন এত বেশি করে উঠে এল—এমন প্রশ্ন হতেই পারে। আমার ছেলেমেয়ে এর বড় কারণ। বিশেষ করে আমার ছেলে জনাথন মৃধা। খুব ইচ্ছে ছিল সে বাংলাদেশের হয়ে টেনিস খেলবে। সেখানে বাংলার পতাকা উড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রের সহযোগিতার অভাবে সুইডেনের হয়ে খেলে চলেছে। 

প্রশ্ন হলো—আমরা কবে লাল-সবুজের পতাকা দেখতে পাব বিশ্বাঙ্গনে। কীভাবে সেটা সম্ভব! উত্তর সহজ—সৃষ্টিশীল হতে হবে। শুধু কানাডার পরিকাঠামোর দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা সম্ভব। বিশেষ করে তাদের ফুটবল নিয়ে পরিকল্পনার দিকে তাকালে বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে। যে দেশে বাংলাদেশের অর্থে বেগম পাড়া গড়ে উঠেছে এবং যারা এর পেছনে জড়িত, তাঁরা অতি সহজে কানাডাকে অনুসরণ করতে পারেন। কানাডা লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলোয় গুরুত্ব দিয়েছে এত বেশি যে, তাদের প্রতিটি জাতীয় একাডেমি থেকে সৃজনশীল খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে গত দশ বছর ধরে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ও জনপ্রিয় সব খেলায় কানাডার অবদান লক্ষণীয়। 

আমরা ফুটবলার হান্ট একাডেমির কাজ শুরু করেছি। ধীর গতিতে চলছে আমাদের কাজ রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর দুর্বলতার কারণে। লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলার সম্পৃক্তি ঘটাতে না পারলে মানসম্পন্ন জীবন, শিক্ষা ও ফুটবলকে বিশ্বাঙ্গনে আনা সম্ভব হবে না। 

জন্মের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ এক স্বপ্নতাড়িত দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরও সেই স্বপ্ন অর্জিত হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষা, কর্ম, খেলাধুলাসহ নৈতিকতার প্রয়োজন, আমরা তা এখনো গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন-রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সবার সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন। 

২০৩৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব। সম্ভব হবে না এমনটি না ভেবে, বরং ভাবতে হবে কীভাবে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যায়। 

এই মুহূর্তে দূর থেকে আমি ৬৮ হাজার গ্রামের কথা ভাবছি। ভাবছি, ৬৪টি জেলার কথা। আমি নতুন প্রজন্মের কথা ভাবছি, আমি সোনার বাংলার কথা ভাবছি। আমি মানুষের কথা ভাবছি। আমি ক্রীড়া জগতে লাল-সবুজের পতাকা উড়তে দেখতে চাই। আমি শুনতে চাই আমার জাতীয় সংগীত—‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। 

লেখক: সাবেক পরিচালক, প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ফাইজার, সুইডেন
ই-মেইল: [email protected]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল দিল্লি

‘শেখ হাসিনা আসবে, বাংলাদেশ হাসবে’ ব্যানারে বিমানবন্দর এলাকায় আ.লীগের মিছিল

ইটনায় এবার ডিলার নিয়োগে ঘুষ চাওয়ার কল রেকর্ড ফাঁস

কুষ্টিয়ায় গভীর রাতে বিএনপি নেতার বাড়িতে গুলি, দেখে নেওয়ার হুমকি

‘ওরা সোনার তৈরি, আমরা মাটির’, কারখানার ভেতর আত্মহত্যার আগে শ্রমিকের ফেসবুক পোস্ট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত